মার্ক টোয়েনের প্রথম সাক্ষাতকার
ঘাবড়ানো কিন্তু স্বপ্রতীভ, নির্লজ্জ লোকটিকে আমি চেয়ারে বসতে বললাম। সে বলল যে সে “দৈনিক বজ্রঝড়” পত্রিকা থেকে এসেছে। সে আরো বলল, “আশা করি আপনার ইন্টারভিউ গ্রহন কোন ক্ষতিকর কিছু হবে না।”
“কি জন্য এসেছো?”
“আপনার ইন্টারভিউ নিতে”
“উমম...আচ্ছা, আচ্ছা...ও আচ্ছা।”
সেদিন সকালে আমি খুব একটা ভাল বোধ করছিলাম না। প্রকৃতপক্ষে, নিজেকে খুব অসাড় লাগছিল। যাহোক, আমি একটা বইয়ের তাকের কাছে চলে গেছি। ছয়-সাত মিনিট বই খোজার পর আমি যুবক ছেলেটির দিকে মনোযোগ দিলাম। বললাম, “তুমি কি এটা বানান করতে পারবে?”
“কোনটা?”
“ইন্টারভিউ”
“হায় ঈশ্বর! আপনি কেন এটা বানান করতে চান?”
“আমি এটার বানান করতে চাই না। আমি এটার অর্থ বুঝতে চাই।”
“সত্যিই অদ্ভুত! আমি অবশ্যই এটার অর্থ আপনাকে বলব। যদি আপনি...যদি আপনি...”
“আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যদি উত্তরটা দাও তবে তোমার কথা মেনে নেব।”
“আই এন...ইন...টি ই আর...টার...”
“তাঁর মানে তুমি এটা ‘আই’ দিয়ে শুরু করছো?”
“নিশ্চয়ই!কেন নয়?”
“ওহ। এটা তাই যা আমাকে অনেক ভাবিয়েছিল।”
“কেন স্যার? আপনি এটা কি দিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলেন?”
“আই...আই...আমি আসলে এটা জানতাম না।”
“বেশ। আপনি জানেন কি? ইন্টারভিউ এখন এমন একটা ব্যাপার হয়ে গেছে যে, শুধুমাত্র কুখ্যাত ব্যক্তিদেরই ইন্টারভিউ নেওয়া হয়।”
“বাহ, বেশ মজার তো। আমি এটা আগে কখনো শুনি নি। তুমি কুখ্যাতদের সাথে কি কর?”
“হুম। এটা আমার জন্য একটি হতাশাজনক ঘটনা। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমেই ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। আমি কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি? নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন, যা দ্বারা আমি আপনার ইতিহাস-পাতিহাস, আদ্যেপান্ত সব জানতে পারব।”
“সানন্দে...সানন্দে...তবে আমার স্মৃতি খুব খারাপ। আশা করি তুমি এতে কিছু মনে করবে না।”
“ওহ না এটা কোন ব্যাপার না। আপনি আপনার সাধ্যমত চেষ্টা করবেন।”
“অবশ্যই। আমি আমার সমগ্র মনোযোগ এর ওপর আনার চেষ্টা করব।”
“ধন্যবাদ। আপনি কি শুরু করার জন্য প্রস্তুত?”
“প্রস্তুত।”
প্রশ্নঃ আপনার বয়স কত?
উত্তরঃ এই জুনে উনিশ হল।
প্রশ্নঃ আমি ভেবেছিলাম আপনি পয়ত্রিশ ছত্রিশ বয়সী কেউ হবেন। আপনি কোথায় জন্মেছেন?
উত্তরঃ মিসৌরি তে।
প্রশ্নঃ কবে থেকে লেখালেখি শুরু করেন?
উত্তরঃ ১৮৩৬
প্রশ্নঃ তাহলে আপনার উনিশ বছর বয়স হওয়া কিভাবে সম্ভব?
উত্তরঃ জানি না। আমি নিজেও এটা জানতে আগ্রহী। সে যেভাবেই হোক না কেন।
প্রশ্নঃ হুম। এমনটা হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত আপনার দেখা কে সবচেয়ে মনে রাখার মত ব্যাক্তিত্ব বলে আপনি মনে করেন?
উত্তরঃ আরোন বার।
প্রশ্নঃ কিন্তু আপনি যদি উনিশ বছর বয়সী কেউ হয়ে থাকেন তবে আরোন বারের সাথে আপনার দেখা হওয়া অসম্ভব।
উত্তরঃ বাহ, আপনি তো আমার চাইতেও আমার সম্পর্কে ভাল জানেন। তবে শুধু শুধু প্রশ্ন করছেন কেন?
প্রশ্নঃ না, এটা একটি পরামর্শ মাত্র। তা আপনি মিঃ বারের সাথে কখন কিভাবে সাক্ষাত করেছিলেন?
উত্তরঃ হুম। সেদিন ছিল তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়া। তিনি আমাকে কম শোরগোল করতে বলেছিলেন।
প্রশ্নঃ কিন্তু আপনি যদি তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে গিয়ে থাকেন তবে তিনি অবশ্যই মৃত ছিলেন। আর তিনি যদি মৃত হয়েই থাকেন, তবে আপনার শোরগোল করা নিয়ে তো তাঁর কোন মাথাব্যাথা থাকার কথা না।
উত্তরঃ আমি জানি না। তবে তিনি সবসময়ই এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন।
প্রশ্নঃ আমি ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারিনি, আপনি বলছেন যে তিনি আপনার সাথে কথা বলেছিলেন, আবার এও বলছেন যে তিনি মৃত ছিলেন।
উত্তরঃ আমি তো বলিনি তিনি মারা গেছেন।
প্রশ্নঃ তার মানে তিনি মারা যান নি?
উত্তরঃ অনেকে বলে তিনি মারা গেছেন, অনেকে বলে না।
প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন?
উত্তরঃ ওহ না, এটা আমার জানার কথা না। কারণ ওটা আমার অন্তেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান ছিল না।
প্রশ্নঃ যা হোক। আমরা কখনই এই ব্যাপারটার একটা সহজ সমাধান করতে পারব না। আমাকে অন্য কিছু বলুন। আপনার জন্ম সাল কত?
উত্তরঃ ১৬৯৩ সালের ৩১ অক্টোবর, সোমবার।
প্রশ্নঃ এটা কিছুতেই হতে পারে না। তাহলে আপনার বয়স হবে এখন ১১৮ বছর। আপনার এত বয়স না।
উত্তরঃ আমি তো বলিনি আমার এত বয়স।
প্রশ্নঃ আপনি একবার বলেছেন আপনার বয়স উনিশ। কিন্তু জন্মসাল অনুযায়ী আপনার বয়স ১১৮। এটা ভয়ংকর অসংগত একটি বিষয়।
উত্তরঃ ওয়াও। আপনি তা বুঝতে পেরেছেন! (আমি তাঁর সাথে উষ্ণভাবে করমোর্দন করলাম)। অনেক কিছুই আমার কাছে অসংগত মনে হয়, কিন্তু আমি কিছুতেই তা ধরতে পারি না। আপনি কিভাবে এত দ্রুত তা ধরতে পারেন?
প্রশ্নঃ আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। মাঝে মাঝে এমনটা হয়ে যায়। আচ্ছা, আপনার কোন ভাই-বোন ছিল বা আছে?
উত্তরঃ আঃ...ম...হ্যা...না, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
প্রশ্নঃ বেশ। এটি আমার জীবনে শোনা সবচেয়ে অসাধারন কথা।
উত্তরঃ কেন? কি জন্য আপনার এটা মনে হল?
প্রশ্নঃ কিভাবে? এখানে দেখুন। দেয়ালের এই ছবিটা। ছবির মানুষটি কে? তিনি কি আপনার ভাই নন?
উত্তরঃ ওহ, হ্যা হ্যা...আপনি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। ও আমার ভাই ছিল। উইলিয়াম। আমরা ওকে বিল নামেই ডাকতাম। আহা বেচাড়া বিল!
প্রশ্নঃ কেন? কি হয়েছে তাঁর? তিনি কি মারা গেছেন?
উত্তরঃ আমারও তাই মনে হয়। আসলে আমরা কেউ জানি না। এটা আমাদের জীবনে একটা রহস্যই রয়ে গেল।
প্রশ্নঃ এটা খুবই দুঃখজনক। সত্যিই দুঃখজনক। তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন?
উত্তরঃ হুম। একরকম সাধারণভাবেই বলা যায়। আমরা তাঁকে কবর দিয়েছিলাম।
প্রশ্নঃ কবর দিয়েছিলেন? সে বেঁচে আছে কি নেই, না জেনেই তাঁকে কবর দিয়েছিলেন?
উত্তরঃ ওহো, তা নয়। সে যথেষ্টই মারা গিয়েছিল।
প্রশ্নঃ আচ্ছা, আমি স্বীকার করছি যে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। যদি আপনি তাঁকে কবর দিয়ে থাকেন তবে আপনি জানেন যে তিনি মারা গেছেন...
উত্তরঃ না না তা নয়। আমরা ভেবেছিলাম সে মারা গেছে।
প্রশ্নঃ তার মানে, সে জীবন ফিরে পেতে পারত।
উত্তরঃ আমি হলফ করে বলতে পারি সে পারত না।
প্রশ্নঃ বেশ। আমি জীবনেও এরকম কথা শুনিনি। কেউ মারা গেছে, তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে, তবে এখানে রহস্যটা কোথায়?
উত্তরঃ হুম। সেটাই তো। দেখ, আমরা দুজন জমজ ছিলাম। মৃত বিল আর আমি। আমাদের বয়স যখন দু সপ্তাহ ছিল তখন আমরা একটা বাথ টাবে পরস্পর মিলে মিশে যাই। আমাদের মধ্যে একজন পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু আমরা জানি না কে ডুবে যায়। অনেকে মনে করে ওটা বিল, আবার অনেকে মনে করে ওটা আমি।
প্রশ্নঃ হুম। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনার কি মনে হয়?
উত্তরঃ ঈশ্বর জানে। এই ভয়ংকর রহস্য সারা জীবন আমাকে নিরাশ করে রেখেছে। কিন্তু আমি তোমাকে এখন একটি গোপন কথা বলতে পারি। যেটা আমি এপর্যন্ত কাউকে বলিনি। আমাদের একজনের একটি অদ্ভুত চিহ্ন ছিল। যার বাম হাতের পিছনে একটি বড় আচিল ছিল, সে-ই ছিলাম আমি। আর সে-ই কিন্তু পানিতে ডুবে মরে।
প্রশ্নঃ খুবই ভাল। তাহলে আমি তো এর মাঝে কোন রহস্য খুজে পাচ্ছি না।
উত্তরঃ তুমি পাবেও না, কিন্তু আমি পাই। আমি বুঝি না, তারা কিভাবে এত বড় একটা ভুল করতে পারে যে তারা অন্য শিশুটিকে কবর দিয়ে দিল! শশশশশস, এটা আমার পরিবারের কাউকে বল না, একমাত্র ঈশ্বরই জানে, এ কথাটা না জেনেও তারা কতটা হৃদয় বিদারক কষ্ট পাচ্ছে।
প্রশঃ বেশ। আমার মনে হয় আজকের মত আমি যথেষ্ট কিছু জেনেছি এবং আমি খুবই দুঃখিত আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি এরোন বারের অন্তেষ্টি ক্রিয়া সম্পর্কে এখনও বুঝি নি। যদি কিছু মনে না করেন, আপনি কি সত্যিই বলবেন যে ঠিক কোন কারনে তাঁকে আপনার দেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি বলে মনে হয়েছে?
উত্তরঃ ঔ, এটা খুবই সামান্য একটা ব্যাপার। কোন পঞ্চাশ বছর বয়সী লোকও এটা পুরোপুরি বুঝতে পারবে না। তাঁর অন্তেষ্টি ক্রিয়া অনুষ্ঠানে যখন ধর্মীয় কথাবার্তা শেষ হল এবং যখন গোরস্থানে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে, যখন তাঁর দেহকে শবযানে উঠানোর ব্যাবস্থা করা হয়েছে, ঠিক তখন তিনি বলেছিলেন, “আমি শেষবারের মত প্রকৃতিকে দেখতে চাই।” এ বলেই তিনি উঠে পরেন এবং গাড়ির ড্রাইভারের সাথে চলে যান।
এটি ছিল আমার জীবনে প্রথম ইন্টারভিউ। ছেলেটি আমাকে শ্রদ্ধা দেখিয়ে বিদায় নেয়। সে খুব ভদ্র গোছের ছেলে। তাঁর চলে যাওয়া দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিল।
(মার্ক টোয়েন এন্ড দ্যা ইন্টারভিউয়ার এর বাংলা অনুবাদ। মার্ক টোয়েন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখনীর একটি চমৎকার বিষয় ছিল কৌতুকপূর্ণ লেখা। তিনি মজার মজার সংলাপ ব্যবহার করে লেখনীকে করে তুলতেন অনবদ্য।মার্ক টোয়েন এন্ড দ্যা ইন্টারভিউয়ার- তেমনি একটি লেখা।)
ইংরেজি সাক্ষাতকারটি অনুবাদ করেছি। একজন সাংবাদিকের সাথে মার্ক টোয়েন। মজার মানুষ মার্ক টোয়েন নিজের ভাষায় লিখেছিলেন সাক্ষাতকারটি। আর এটি বাংলায় অনুবাদ করার প্রয়াস চালিয়েছি আমি। আগে কখনো এটির বাংলা হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। নিতান্তই শখের বসে করা।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:৫৮