somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সম্মিলিত নিরাপত্তা ব্যর্থতায় ভঙ্গ শান্তির প্রতিশ্রুতি

০৩ রা আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৪:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব ছিল এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে, কিন্তু রেখে গিয়েছিল একটি আশাবাদ—শান্তির, সহযোগিতার, আর ভিন্ন এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার। এই আশার ফলশ্রুতিই ছিল "League of Nations" বা জাতিসংঘের পূর্বসূরি—একটি সাহসী উদ্যোগ, যেখানে সব রাষ্ট্র একসঙ্গে একে অপরকে আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করবে, এবং কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, মাত্র দুই দশকের মধ্যেই সেই বিশ্ব আবার জড়িয়ে পড়ল এক ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যা আগের চেয়ে অনেক বেশি বিধ্বংসী ও বৈশ্বিক ছিল।

সম্মিলিত নিরাপত্তার ধারণা: এক সুন্দর স্বপ্ন
ধারণাটা ছিল খুবই সহজ আর মানবিক—যদি একজনের উপর আক্রমণ হয়, তাহলে সবাই মিলে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। পুরনো জোটের রাজনীতিকে বদলে দিয়ে এটি ছিল একটি সার্বজনীন প্রতিশ্রুতি—শান্তি রক্ষার জন্য একত্রিত হওয়া। ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির অংশ হিসেবে গঠিত হয় "League of Nations", যার লক্ষ্য ছিল:
- যুদ্ধ প্রতিরোধে মধ্যস্থতা ও আলোচনার পথ খোলা রাখা
- আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া
- অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান
কাগজে-কলমে চমৎকার, কিন্তু বাস্তব ভিন্ন।

কেন ব্যর্থ হলো এই উদ্যোগ?
লিগ অফ নেশনস অনেক আশার জন্ম দিলেও, এর ভিতরে ছিল মারাত্মক দুর্বলতা:
- বলপ্রয়োগের ক্ষমতা ছিল না, নিজের কোনো স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না। সদস্য রাষ্ট্রদের উপর নির্ভর করতে হতো, কিন্তু তারা নিজেরাই প্রস্তুত ছিল না ঝুঁকি নিতে।
- মূল শক্তিগুলো এর বাইরে ছিল, যুক্তরাষ্ট্র—যা এই ধারণার মূল প্রণেতা—অবশেষে লিগে যোগই দেয়নি। জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দেরিতে যোগ দেয় বা বেরিয়ে যায়। জাপান ও ইতালি তো সম্পূর্ণভাবে লিগকে অস্বীকার করে।
- ধীরগতি ও কার্যহীনতা, ১৯৩১ সালে জাপান যখন মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে বা ১৯৩৫ সালে ইতালি ইথিওপিয়া দখল করে—তখন লিগ কিছু নিন্দা করেছিল, কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ কিছুই নেয়নি।
- মহামন্দা, ১৯৩০-এর দিকের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট (Great Depression) দেশগুলোকে আরো গুটিয়ে ফেলে। তখন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নয়, বরং নিজের দেশের টিকে থাকাটাই সবার মুখ্য হয়ে ওঠে।
ফলে, আগ্রাসী রাষ্ট্রগুলো বুঝে ফেললো—তাদের কেউ থামাবে না। শান্তির রক্ষক প্রতিষ্ঠানের হাত ছিল কার্যত বাঁধা।

তিনটি শক্তির উত্থান
এই শূন্যতার মধ্যে উঠে এল তিনটি আগ্রাসী শক্তি:
- জার্মানি, যেখানে হিটলার ভেরসাই চুক্তি উল্টে দিয়ে সামরিক শক্তি ও বিস্তারবাদ চালু করলেন
- ইতালি, মুসোলিনির নেতৃত্বে আফ্রিকায় সাম্রাজ্য গড়ার স্বপ্নে মত্ত
- জাপান, পূর্ব এশিয়ায় একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে গেল
তারা সবাই বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থাকে অন্যায্য ও দুর্বল মনে করতো। এবং যখন দেখলো প্রতিরোধ নেই, তখন তারা আরও সাহস পেয়ে গেল।

আপোষনীতি: শান্তি না, বরং দুর্বলতার ছাপ
যুদ্ধ এড়াতে ইউরোপের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো—বিশেষত ব্রিটেন ও ফ্রান্স—চলল "Appeasement" নীতিতে। মানে, যদি একটু ছাড় দিই, তাহলে হয়তো বড় যুদ্ধ এড়ানো যাবে। এর সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো মিউনিখ চুক্তি (১৯৩৮)—হিটলারকে চেকোস্লোভাকিয়ার একটা অংশ দিয়ে দেয়া হয়, বিনিময়ে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন আর কিছু চাইবেন না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি ভাঙে দ্রুত। আর দেখা গেল—আপোষ শান্তি আনে না, বরং হিটলারকে আরও এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
১৯৩৯ সালে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করলে, অবশেষে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তীব্র গতি ও নিষ্ঠুরতার সাথে। গণহত্যা, যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক, ক্যাম্প—সব মিলিয়ে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সময়। এর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল এক নির্মম সত্য—যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাটি যুদ্ধ ঠেকাতে গড়ে তোলা হয়েছিল, সেটিই ব্যর্থ হয়েছিল সবচেয়ে করুণভাবে।

ইতিহাস আমাদের কী শেখায়?
এই ব্যর্থতা থেকে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাঠ নিতে পারি:
- কেবল ইচ্ছা নয়, প্রয়োগযোগ্য শক্তিও জরুরি। কোনো ব্যবস্থার কাজ করতে হলে তার বাস্তব বল দরকার।
- সবার অংশগ্রহণ ছাড়া কোন ব্যবস্থাই টিকবে না। বড় শক্তিগুলো পাশে না থাকলে পুরো কাঠামো ভেঙে পড়ে।
- সব সময় শান্তির জন্য আপোষ ভালো না। কিছু আপোষ ভবিষ্যতের আরও বড় সংঘাত ডেকে আনে।
- অর্থনৈতিক অস্থিরতা রাজনীতিকেও অস্থির করে তোলে। মহামন্দা না এলে হয়তো হিটলারের উত্থান এত দ্রুত হতো না।
সবচেয়ে বড় শিক্ষা: শান্তি খুবই ভঙ্গুর জিনিস। এটাকে সযত্নে গড়ে তুলতে হয়, প্রতিনিয়ত রক্ষা করতে হয়। সম্মিলিত নিরাপত্তা গঠনের স্বপ্ন সুন্দর ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যেসব শক্তি, নীতিমালা ও নেতৃত্ব দরকার ছিল—তা তখনকার বিশ্ব দিতে পারেনি। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শান্তি কখনোই স্বতঃসিদ্ধ নয়। এটি অর্জন করতে হয়, রক্ষা করতে হয়, এবং যখন প্রয়োজন—তখন তার জন্য দাঁড়াতে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৪:২৫
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×