- চলে যাচ্ছ?
- হুম.. ওদের ভিজিটিং আওয়ার শেষ যে..
- আমার না খুব মন খারাপ হচ্ছে..
- মন খারাপ.. কেন বলতো?
- আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার এই শেষ দেখা..
- কি যা তা বলছ? কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই তুমি আমায় সামনে পাবে..
- ......
- অদ্ভুত তো.. এমনিই তোমায় ছাড়া আমার বাসায় ফিরে সময় কাটেনা, তার উপর যদি তোমার মন খারাপ দেখে যাই তাহলে আমার রাত কীভাবে কাটবে বলতো?
- একটা কথা বলি?
- একটা কথা বলবে? নাহ, তিনটা কথা না বললে হবেনা..
- শোনোই না.. রাগ করবেনা শুনে হুম?
- উফফ.. আমার বউটা না! বলে ফেলতো..
- আর যদি কখনো আমার সাথে তোমার দেখা না হয়.. তুমি নিজের ঠিক-ঠাক যত্ন নিতে একদম ভুল করবেনা..
- আমি যাচ্ছি..
- রাশেদ.. তুমি বলেছ রাগ করবেনা..
- কিন্তু তুমি এমন উলটো পালটা কেন বলছ?
- চুপ.. শোনো.. যদি কখনো আমার সাথে আর তোমার..
- দেখ ডাক্তার বলেছেন সব কিছু ওকে আছে। একদম নরমাল ডেলিভারি হবে। কোন প্রকারের কমপ্লিকেশন যে নেই তা তো তুমি নিজেও জানো..। তবুও যেন সমস্যা না হয় তার জন্যেও যথা সম্ভব ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। কখনো শুনেছ এই যুগেও নরমাল ডেলিভারিতে কেউ মারা গিয়েছে? তুমি একটুও ভয় পেওনা..। আর মা তো রইলই.. তাছাড়া সকালেই আমি আসছি..। তুমি একদম টেনশন না নিয়ে চমৎকার একটা ঘুন দাও, আচ্ছা?
- সব বুঝলাম, কিন্তু তুমি আমার কথাতো শোনো..
- চুপ! আমি যাচ্ছি। নার্সটা দেখছোনা দুবার করে বলে গেল.. মহিলা একেবারেই বদ.. থাকো তুমি..
- আচ্ছা শোনো..
- উমহু.. কাল সকালে!
- আচ্ছা, কাছে এসে কান এগিয়ে দাও.. তোমাকে তোমার তিনটা কথাই না হয় শেষবারের জন্য শুনিয়ে যাই..?
- উফফ.. শুনবো না তোমার তিনটা কথা। কাল ভোরে এসে তারপর শুনবো..
- শোনো রাশেদ.. শোন..
- [দূর থেকে রাশেদের কন্ঠ ভেসে আসে] কালকে..
---------
পরদিন, একদম ভোর বেলা। রাশেদ হাসপাতালের চারতলায় উঠেই মায়ার কেবিনের সামনে ওর মামাদের দেখতে পায়। মায়ার বাবা-মাও এসে হাজির। রাশেদের মা কেবিনের দরজার পাশে বসে একটা ছোট্ট কি যেন কোলে নিয়ে নি:স্বব্দে কেদে চলছে..। রাশেদের বুকটা ধক করে ওঠে, অজানা আশংকায় বুকের ভেতরটা যেন মুচড়ে ওঠে। ও ধীরে ধীরে এগুতে থাকে ভীরের দিকে..। রাশেদের ছোট মামা রাশেদকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে,
- তোর মোবাইল বন্ধ কেন?
- মোবাইল বন্ধ না মামা.. কাল বাসায় ফিরতে রাতে বৃষ্টির মাঝে পড়েছিলাম। পানি ঢুকে মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে.. কিন্তু তোমরা এত সকালে?
- শোন.. শান্ত হ.. একটা দূর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে..
রাশেদ যেন ধীরে ধীরে স্বাস প্রশ্বাস নেয়ার কথাই ভুলে যাচ্ছে। কেন যেন বুকের ভেতর প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। রাশেদ মামাকে খুব কষ্ট করে প্রশ্ন করে..
- কী হয়েছে?
- মায়ার হঠাত করে পেইন উঠেছিল কাল..
- না না! কাল রাতে কেন পেইন উঠবে? ওর ডেলিভারি ডেটতো আরও এক সপ্তাহ..
- শোন.. এটাতো পুরোটা হিসাবের উপর ডিপেন্ড করেনা..
- আচ্ছা তুমি থাকো, আমি মায়ার সাথে আগে দেখা করে আসছি..
রাশেদ মামার পাশ কাটিয়ে যেতেই ছোট মামা ওর হাত শক্ত করে ধরে..
- রাশেদ..
- কী ব্যাপার? আমি আসছিতো.. দেখে আসি জাস্ট.. ওকে বলেছিলাম ওর ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। তুমি তো জানোই পাগলিটা কত অভিমানী..থাকো, আসছি..
- রাশেদ.. শোন বাবা?
- কীই?
- মায়া আর নেই..
রাশেদের চারপাশ যেন মুহুর্তেই ফঁাকা হয়ে যায়। মাথার মধ্যে হঠাত করেই কোত্থেকে যেন হাজার খানেক প্রজাপতি এসে ডানা ঝাপটানো শুরু করে। একটু আগে বুকের মধ্যে থাকা অসংখ্য ভয় যেন মুহুর্তেই দূর হয়ে গিয়ে রাশেদকে করে দেয় একদম অনুভূতি শূন্য। ওর গলা ভিজে আসে.. কাঁপা গলায় মামার দিকে তাকায়..
- মামা, কি বলো..
- ওর ভোর ৪ টার দিকে হঠাত করেই পেইন ওঠে। ডাক্তাররা খুব দ্রুত ওকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যায়..। তোর মা, আমি, দুলাভাই সবাই তোকে অনেক ফোন করেছিলাম কিন্তু তোকে ফোনে পাইনি। ওর অনেক ব্লিডিং হয়েছিল..। যাদের রক্ত দেয়ার কথা ছিল তারাও ফোন ধরেনি। আরও কি যেন একটা সমস্যা হয়েছিল, ডাক্তার বললেন.. আমিতো বাবা অত কিছু বুঝিনা..। একটা সময়, ডাক্তার এসে বললেন রুগির অবস্থা খুব খারাপ। তোর মাকে ডাকছে।
কথা বলতে বলতেই রাশেদের মামা খেয়াল করেন রাশেদের গাল বেয়ে যেন বর্ষার ধারা বয়ে যাচ্ছে..। মামা থামতেই রাশেদ শীতল গলায় প্রশ্ন করে..
- ওকি মাকে কিছু বলে গিয়েছে..
- না, তোর সাথে ফোনে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু..
- তারপর?
- আপার কাছ থেকে একটা কাগজ চেয়ে কিছু একটা লিখে তোকে দেয়ার কথা বলেছে..
- হুম..
- তার কিছুক্ষণ পরই..
- কী?
- .....
- মরে গেল, তাইনা?
- শোন বাবা..
- এরকম জেদি মেয়ে আমি দেখিনি মামা জানো.. ও বললো যে আর দেখা হবেনা, ওকে তাই করতে হবে?
- বাবা, শান্ত হ..
- কীসের শান্ত হব আমি? কেন হব?
- রাশেদ..
- ও যা বলবে তাই?
- বাবা..
- মরে গেল না.. যাবার আগে সে কিছু বলেও যাবেনা..
- তুই একটু শান্ত হ..
- আমি যাচ্ছি..
- কোথায় যাস?
- জানিনা..
- ওকে দেখবিনা?
- কেন দেখব? কী দেখব? আমি কিছু দেখবোনা..
- বাবা, পাগলামি করিস না..
- কী পাগলামি করছি মামা আমি? কী দেখতে বল আমাকে? মায়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে এটা?
- বাবা একটু শান্ত হ..
- ও শুয়ে থাকবে.. আমার সাথে কথা বলবে না.. এটা দেখব? আমি ডাকলে শুনবে না, তাকাবে না.. চুলে চিরুনি দেইনি বলে বকবেনা.. আর আমি।সহক্স করব?
রাশে ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বারাতেই একটা ছোট্ট শিশুর কান্না শুনে দাঁড়িয়ে যায় ও। ফিরে তাকাতেই দেখে শিশুটি ওর মায়ের কোলে শুয়ে কাঁদছে। রাশেদের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে..। মামার দিকে তাকায়..
- তোর মেয়ে হয়েছেরে রাশেদ..
- মামা, কাগজটা তোমার কাছে আছে?
- হ্যাঁ..
- দাও।
ছোট মামার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে হাটতে থাকে রাশেদ। সারা সকাল হেটে হেটে পার করে দেয়। একটা সময় হাটতে হাটতে রমনা পার্কের বেঞ্চিতে এসে বসে বেঞ্চের পেছনের গাছটার দিকে তাকায় ও। ঐতো..! মায়ার হাতে খোদাই করে M+R লেখা। এখানেইতো প্রথম দেখা করেছিল দুজন। লাল শাড়িতে মায়াকে প্রচন্ড মায়াবতী লাগছিল। এরপর কত রোদ-বর্ষা-শীতে এই বেঞ্চটায় বাদাম খেয়ে কাটিয়েছে দুজন। ভাবতে ভাবতেই রাশেদের চোখ ভিজে ওঠে আবারও। ও মায়ার দেয়া কাগজটা খুলে নেয়..
"আজ তোমার জন্মদিন। তোমার জন্য একটা ছোট্ট চমৎকার উপহার রেখে যাচ্ছি। যদিও আমি আমার হাতে উপহারটা দিতে পারলে ভালো হত, তবে ভাগ্যে নেই যে..! আমার কিন্তু উপহারটা নিজেরও অনেক পছন্দ হয়েছে। চোখগুলো ঠিক তোমার মত হয়েছে, দেখে নিও..! এবার জন্মদিনটা তোমার একটু কষ্টে কাটবে, এজন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি..। আর শোনো, ওর নাম তুমি যা বলেছিলে সেটাই রাখবে। লোক হাসাহাসি করলো কিনা সেটা দেখে লাভ আছে? আমি মুখে মুখে মানা করলেও নামটা কিন্তু আমার অনেক পছন্দের ছিল..! 'রাজকন্যা'..। আমাদের রাজকন্যাইতো...!
আচ্ছা যাই হোক, কাল রাতেতো তুমি আমার শেষ তিনটা কথাও শুনলেনা। এখন আবার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছ.. তাই শেষবারের মত কথাগুলো না হয় লিখেই যাচ্ছি..
আমি তোমাকে ভালোবাসি..
শুভ জন্মদিন।
ভালো থেকো রাজকন্যার বাবা..!"