ভোর.. ওর নাম ভোর। সম্পর্কে আমার চাচাতো বোন, আমার এক বছর কি বড়জোর দু'বছরের ছোট হবে..
অনেক ভালবাসতাম ওকে..
যখন থেকে ও পুতুল খেলত, তখন থেকেই..
ওর পুতুলের বিয়েতে আমাকে যেতে হত; ছেলের বাবা হয়ে যেতে হত। আর ও হত মেয়ের মা..।
মাঝে মাঝে আমরাও জামাই বউ খেলতাম..
ও চাচীর ওড়না গায়ে জড়িয়ে বউ হত.. আর আমি বাবার টুপি মাথায় দিয়ে জামাই সাজতাম..
তখন থেকেই ওকে ভালবাসতাম..
কিন্তু এই ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম যখন ও প্রথম আরিফের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।
আমাকে যেদিন ও ব্যাপারটা জানায় সেদিন অনেক কষ্টে কান্না চেপে রেখেছিলাম আমি; মনে হচ্ছিল যেন বুকের ঠিক মাঝখানটাতে একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে, এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার সব কিছু..
এটা জানায় অবশ্য ভালোই হয়েছিল, কেননা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক করাটা আমাদের পরিবারের কেউই ভালোভাবে দেখতেন না..
যাই হোক, দিন কেটে যাচ্ছিল..
ধীরে ধীরে দিনগুলো একত্র হয় মাস আর মাস গুলো একত্র হয়ে বছরে রূপ নিলো।
আমিও আমার কষ্টগুলোর সাথে ডিল করতে শিখে নিলাম..
একই বিল্ডিং-এ থাকতাম তাই না চাইলেও প্রতিদিনই ওর সামনে পড়তে হত আর স্বার্থপরের মত আমার ভালোবাসাও বাড়তে থাকলো, জেনেও ও অন্য কাউকে ভালোবাসে..
একদিন খেয়াল করলাম ওর ফেসবুক প্রোফাইল ডিঅ্যাক্টিভেট করা, অবাক হলাম..
তবে জিজ্ঞেস করেনি সেদিন..
পরদিন বিকেলে ভার্সিটি থেকে ফিরে এসে মা'র কাছে শুনলাম চাচী বলেছেন ভোর দু-তিন ধরে খাওয়াদাওয়া করছে না বললেই চলে। কি হয়েছে সেটাও চাচীকে বলেনি। মা বললেন খোঁজ নিতে..
আমি গেলাম ওদের ফ্ল্যাটে। গিয়ে শুনি ও সেই দুপুর থেকে ছাদে। শুনেই ছাদে গিয়ে দেখি ও রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে.. আমি পিছে গিয়ে দাঁড়ালাম..
- ভোর..
ও আমার দিকে ফিরতেই দেখি কেঁদে চোখটা একদম লাল বানিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। ছোটবেলার পর এই প্রথম মেয়েটার কান্না দেখছি আমি.. কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমার বুকে মুখ গুজে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল পাগলিটা। সেই কান্না যেন থামতেই চায়না..! প্রায় ৭ থেকে ৮ মিনিট চেষ্টা করে ওর কান্না থামালাম আমি.. কান্না থামার পর জানলাম, আরিফ ওর সাথে চিট করেছে। ওর অনেক আগে থেকেই রিলেশন ছিল। গত সপ্তাহে মেয়েটা এসে ওকে সব বলে দিয়েছে.. আর এরপর ও ব্রেকআপ করেছে।
আমি কিছুক্ষণ সময় নিলাম, এই সময়টার মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেল আমার মাঝে। ওর কান্নায় দু:খও যতটা পেলাম, কারণ শুনে ওকে পাবার আশায় আনন্দও পেলাম.. এ যেন একটা চমৎকার বাজে রকমের মিষ্টি একটা অনুভূতি..
- কাঁদিস না.. ওঠ.. বাসায় যা, ভাত খা..
- না..
- কথা শুনবিনা তুই?
- একটু পরে যাই..
- এখন যা..
- উফ, বিরক্ত করিস না তো..
- আচ্ছা যা, আমিই যাচ্ছি..
- আচ্ছা আচ্ছা হইছে, রাগ হতে হবেনা.. যাচ্ছি..
সিঁড়ি দিয়ে নামছি আমরা, হঠাত ও প্রশ্ন করে বসে..
- আচ্ছা শোন, আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম.. তুই আগের মত নাই.. আগে না সব সময় আমারা একসাথে থাকতাম..?
- হুম..
- কিন্তু.. তুইতো এতদিন ছিলিনা..
- হুম..
- কেন?!
- কারণ তোর সাথে থাকার জন্য তুই অন্য কাউকে বেছে নিয়েছিলি..
- কিন্তু, তুই তো...
এটুকু বলেই ও থেমে যায়.. আমার চোখের দিকে তাকিয়ে যেন আমার ভেতরটা পড়ে নিতে চেষ্টা করে। তখন আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, 'হ্যাঁ, যা ভাবছিস তাই.. আমি তোকে অনেক ভালোবাসি...'.. সেটাও অনেক কষ্টে দমিয়ে রাখলাম.. এখন ভালোবাসি বললে হয়তোবা সেটা সিচ্যুয়েশনের অ্যাডভানটেজ নেয়া হয়ে যাবে।
চোখ নামিয়ে নিলাম আমি..
- যাহ বাসায় যা.. খেয়ে নে.. সব ঠিক হয়ে যাবে..
কথাগুলো বলেই ওর উত্তর না নিয়েই আমি বাসায় চলে এলাম।
ঠিক এক সপ্তাহ পর রাত বারোটার দিকে ও আমাকে মুঠোফোনে কল দিলো..
- আমি অনেক স্বার্থপর, না?
- এ কথা কেন বলছিস ভোর?
- সত্যিইতো.. আরিফকে পাবার পর তোর খোঁজ খবর পর্যন্তও আমি নেইনি..
- আমিও তো নেইনি.. দুজনই ব্যস্ত ছিলাম হয়তো..
- তুই তো নিয়েছিস..
- কই? নাহ..
- কেন প্রতিদিন এয়ারটেল একটা নম্বর থেকে তুই আমাকে সকাল আর রাতের শুভেচ্ছা জানাতিস না?
- আমিই? কি বলিস এসব..
- মিথ্যে বলছিস কেন?
- ভোর, রাত হইছে ঘুমা..
- আজ আমি মামুন ভাইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম, ফ্লেক্সি করতে..
- ..........
- কেন আননোন নম্বর থেকে পাঠাতি তুই? তোর নম্বর থেকে কেন নয়..?
- .........
- চুপ করে আছিস কেন? আর আমি কিছুই দিতাম না, তার পরেও দিনের পর দিন তুই এটা করতি.. একটা দিনও মিস হতনা তোর.. কেন?
- আচ্ছা সরি.. ভুল হইছে..
- হ্যাঁ, ভুলতো হইছেই..
- আর হবেনা..
- সত্যিইতো?
- হুম..
- পারবি তুই মেসেজ না দিয়ে থাকতে?
- হুম..
- কেন, এরকম মেসেজ না দিয়ে আমি যে তোকে সময় দিতাম না এই ভুলটা ধরিয়ে দেয়া যেতো না? আমাকে বলা যেতো না?
- হুম..
- আমি ভুল করলে তুই আমাকে ভুল দেখিয়ে দিবানা?
- হুম..
- রাখলাম..
সারাটা রাত আমার ঘুম হল না। হ্যাঁ, প্রতিদিন দিয়েছি ওকে মেসেজ। থাকতে পারিনি না দিয়ে..! আরে বাবা ভালোবাসিতো.. এই আট-নয় দিনে যেন এই ভালোবাসা ব্যাপারটার অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'ভালোবাসি' কথাটা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে.. এতদিন ধরে রাখা ব্যাপারটা নিজের মধ্যে যেন আর রাখতেই পারছি না..
ফোন দিলাম..
- হ্যালো..
- বল..
- আমি একটা ভুল করে ফেলেছি..
- কি ভুল?
- আমি আমার বউকে আটকাই নি..
- মানে? বউকে আটকাস নি মানে?
- ছোট বেলায় বাবার টুপি মাথায় দিয়ে একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম.. বিয়েটা খেলা ছিল, কিন্তু..
-....... কিন্তু..?
- ভালোবাসাটা আসল..
- .......
- আমি জানি, আমি ভুল করছি.. তোর বাবা-মা কখনোই এমন কিছু নেবেন না.. আর তোর কথাতো বাদই দিলাম.. বাট আই হ্যাভ টু ফিনিশ দিস টু নাইট.. আর নিজের মধ্যে রাখতে পারছি না.. ক্ষমা করে দিস আমাকে.. শোন ভোর, 'আমি তোকে এত্তগুলা ভালোবাসি.. ছোট্ট বেলা থেকেই বাসি.. আর তুই না বাসলেও আমি বেসেই যাবো......'
বলেই ফোনটা কেটে দিলাম..। আর দম ধরে রাখতে পারছিলাম নাহ আমি। হয়ত ও আমাকে ঘৃণা করবে, হয়ত আর কখনও ওর সাথে কথা হবেনা.. না হোক.. এটাই ভালো.. অন্তত ভালোবাসাটা থেমে থাকুক, আর না বাড়ুক.. এত ধারণ ক্ষমতা নেই আমার.. এসব ছাইপাঁশ ভাবছি, অমনি একটা মেসেজ এলো.
"" হ্যাঁ, তুই ভুল করে ফেলেছিস.. নিজের বউকে আটকে রাখতে পারিস নি.. আমি কি করবো? তোর মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম সেই বউ হয়েছি থেকে.. পরে ভাবলাম তুই বুঝি অন্য কাউকে........ নাহ, আমার দোষ নেই.. সবটুকু দোষ তোর...."