somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঢাকা "হাতিরপুল" এর নামকরণের ইতিবৃত্ত...

০৭ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১০:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

# ঢাকা "হাতিরপুল" এর নামকরণের ইতিবৃত্ত...

হাতিরপুলের নীচে ছিল একটি রেললাইন। তৎকালীন বৃটিশ সরকারের শেষ সময়ে ঐ স্থানে রেললাইন তৈরি করা হয়। এই পুল দিয়ে একসময় হাতি পারাপার হতো। হাতিদেরকে রেললাইনের উপরের পুল দিয়ে পিলখানা থেকে হাতিরঝিলে নিয়ে যাওয়া হতো গোসল করাতে। নুড়ি পাথর আর স্লিপারের কারণে রেললাইনের উপর দিয়ে হাতিগুলো হাঁটতে পারতো না। তাই তারা যেতো তৈরিকৃত উপরের পুল দিয়ে। আর সেই থেকেই এটির নাম হলো হাতিরপুল।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় মোঘল ও ইংরেজ আমলে ঢাকায় সরকারের মালিকানাধীন অনেক হাতি ছিল। পরিবহন আর যাতায়াত করা ছাড়াও এই হাতিগুলো নানাধরণের কাজে ব্যবহৃত হতো।

পিল মানে হাতি, আর খানা মানে আশ্রম। সরকারের এই হাতিগুলো থাকতো পিলখানায়। পিলখানা জায়গাটার নামের উৎপত্তি এভাবেই। বর্তমানে এই এলাকাটি বিজিবি হেডকোয়ার্টার আর 'সীমান্ত স্কয়ার মার্কেট' নামেই অধিক পরিচিত।

পিলখানা থেকে বর্তমান হাতিরপুল এলাকায় হাতি চলাচলের জন্য ইস্টার্ন প্লাজা ও পরিবাগ বরাবর যে সেতু বা পাকা পুল নির্মাণ করা হয়েছিল হাতি পারাপারের জন্য, সেটিই হাতিরপুল।

পিলখানা থেকে রমনা পার্কে হাতি চারণের জন্য নেয়া হতো। যে রাস্তা দিয়ে নেয়া হতো সেটাই এলিফ্যান্ট রোড। গাউছিয়া মার্কেটের পাশ দিয়ে বাটা সিগনাল ক্রস করে হাতিরপুল দিয়ে পরিবাগ হয়ে রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজার ওয়্যারলেস মোড় পেরিয়ে মধুবাগের দিকে যে রাস্তাটি গেছে এই পুরো রাস্তাটির নাম ছিল এলিফ্যান্ট রোড। এটিই আদি ইতিহাস।

ইতিহাস থেকে আরও জানা যায় আজকের জনবহুল এলিফ্যান্ট রোড এলাকাটি ১৮০০ সালে ছিলো বিশাল আকৃতির গাছ-গাছালিতে ঘেরা ছোটখাট বনাঞ্চল। পরবর্তীতে গাছ-পালা কেটে হাতি চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়। এই এলিফ্যান্ট রোড দিয়েই শত শত হাতির পাল চড়িয়ে বেড়াতেন মাহুতরা। পরবর্তীতে সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ পর্যন্ত 'নিউ এলিফেন্ট রোড' নামের আড়ালে আদি এলিফ্যান্ট রোডের পরিচয়টি হারিয়ে গেছে।

বর্তমানে এলাকাটি হাতিরপুল নামেই পরিচিতি লাভ করে। তখন মানুষেরা এই পুল, হাতি আর ট্রেন দেখতে এখানে আসতো। পুলের নিচে কাছাকাছি অবস্থানে ছোট ছোট কয়েকটি খাবারের হোটেল ছিল। আর ছিলো ছোট্ট একটি বাজার। বাজার বলতে তখন রেল লাইনের উপর কয়েকটা অস্থায়ী দোকান।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সেখানে বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। হাতিরপুল বাজার তখনও হয়নি। নতুন বাসিন্দারা নিজেদের প্রয়োজনে পুঁজি বিনিয়োগ করে কিছু লোককে এখানে বেচাকেনা করতে বলেন, সেখান থেকেই এ বাজারের গোড়াপত্তন।

১৯৬৯ থেকে ৭৪ পর্যন্ত পুলে ওঠার জন্য টাকা দিয়ে রিকশা ঠেলে দেয়ার জন্য লোক পাওয়া যেতো। এই পুল পারাপারের জন্য যে সব ছোট ছোট ছেলেরা ছিলো, তাদেরকে প্রতিবার পারাপারের জন্য দিতে হতো ২ থেকে ৩ আনা। এরা ৪/৫ জনে দলবেঁধে রিকশা ঠেলতো। এভাবে রিকশায় চেপে পুল পার হওয়া যেতো।

এই পথেই ছিলো শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীদের পৈতৃক বাড়িটা। হালকা হলুদ রঙের বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটির নাম ছিল দারুল আফিয়া। হাতিরপুল পার হয়ে যাতায়াত করতে হতো দারুল আফিয়ায়, শহীদ মুনীর চৌধুরীর বাড়িতে। ১৯৭১ সালে সেখান থেকেই তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকাররা।

তৎকালীন রমনা এলাকার চারপাশে বেশ কিছু খাল ছিল। যেগুলো এখন মানচিত্র আর কাগজে-কলমে আছে, বাস্তবে নেই। হাতিগুলোকে নেওয়ার জন্য খালের উপর নির্মিত হয়েছিলো সেতু। এগুলোকে উদ্ধার করে খালগুলোকে মুক্ত করে নগর পরিকল্পনা করলে শহরটি অনেক সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। যেমনটা হয়েছে হাতিরঝিলের ক্ষেত্রে।

সীমান্ত স্কয়ার থেকে হাতিরঝিল হয়ে একদিকে গুলশান পর্যন্ত অন্যদিকে ডেমরা পর্যন্ত নৌ চলাচল পথ তৈরি করা এখনো সম্ভব। হাতিরপুল ভেঙ্গে নীচের লাইন বরাবর যে রাস্তাটি নির্মাণ করা হয় সেই রাস্তার নাম রাখা হয়েছিলো পেনিট্রেটর রোড। কেন এমন একটা অদ্ভুত নাম রাখা হয়েছিল, আর কীভাবেই বা এলাকাটা হাতিরপুল বাজার হয়ে গেল জানা যায়নি।

এখন যেখানে মোতালেব প্লাজা টাওয়ার গড়ে উঠেছে, সেখানে ছিল একটি সুইপার কলোনি। নাম ছিল 'মোতালেব কলোনি'। মোতালেব কলোনির মধ্যে পাঁচটি দোতলা বাড়ি ছিল। কাঁঠালবাগানের ঢালে পরিত্যক্ত রেললাইন ছিল। ঢাকার নবাবরাও হাতি পার করার জন্য খাল ভরাট না করে বানিয়েছিলো হাতির পুল, আমরা তো আরো বড় নবাব, তাই খালটাই ভরাট করে দখল করে ফেললাম।

ওপাশে ছিল পরীবাগ মসজিদ, ছিল পাওয়ার হাউসটাও। সেসময় হাতিরপুল সংলগ্ন পরিবাগ এলাকায় অনেক গাছগাছালি ও খাল ছিলো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা না-কি এই পুলের উপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গুলিবর্ষণ করেছিল। হাতিরপুলটি ছিল খাড়া এবং উঁচু যার ফলে দুর্ঘটনা লেগেই থাকতো।

৭০ এর দশকে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল (ছবি সংযুক্ত) এই হাতিরপুল ভাঙা নিয়ে। রিপোর্টে উল্লেখ করা আছে, ৫০ বছরের পুরোনো এই পুলটি ভাঙা হবে নগরে নতুন রাস্তা তৈরি করার জন্য। পৌরসভা এই পুল ভাঙ্গার কাজটি করছে। নতুন রাস্তা তৈরির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় লক্ষ টাকা।

ফুলবাড়িয়া-তেজগাঁও রেললাইনের উপর দিয়ে পরিবাগ ও ধানমন্ডি এলাকার মধ্যে যান চলাচলের সহজ উপায় ছিলো এই হাতিরপুল বা রেলওয়ে ওভার ব্রিজটি। নগর সংস্কারের জোয়ারে ও আকাশচুম্বি অট্টালিকা তৈরির জন্য এই পুলটি ভাঙ্গা হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিলো, যদিও এই পুলটি ঐতিহাসিক এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিলো, কিন্তু সেসময়ের নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেছিলেন রেলওয়ে স্টেশন কমলাপুরে সরিয়ে নেয়ার পর এই পুলের আর দরকার নাই।

ছবিতে ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাস পাতায় 'বিদায় হাতীরপুল' শিরোনামে ইত্তেফাকের সংবাদটি পড়ে আর যাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই হাতিরপুল, ভুতের গলির সাথে, সবার স্মৃতি রোমন্থনের উদ্দেশ্যে এই পোস্টের অবতারণা।

তথ্যসূত্র : শাহানা হুদা রঞ্জনা। সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×