সাদা কালো রং
(আগের পর্ব)
তিন
বিছানা থেকে নেমে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত নয়টা বাজে৷ অবাক হয়ে গেলাম! এতোক্ষণ ঘুমিয়েছি নাকি আমি? আশ্চর্য, আমার তো মনে হচ্ছিলো মাত্র দু'মিনিট ঘুমিয়েছি!
হুমায়ূনের সাথে নীচে নেমে ওর বাইকটা দেখে সত্যিই খুব বিস্ময় জাগে আমার৷ বাইকটার মধ্যে কেমন একটা শক্তিশালী রাজকীয় ভাব আছে, দেখলেই মনের মধ্যে একটা সম্ভ্রম জেগে ওঠে৷ সত্যিই ট্যারা করে দিবার মতো একটা জিনিস সেটা!
হুমায়ূন বাইকের উপর হাত রেখে গর্বিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন হয়েছে বল?”
“ঘ্যাম! রীতিমতো ঘ্যাম বাইক৷ এ জিনিস রাস্তায় নিয়ে বের হলে তোকে একটা চোখের ক্লিনিক দিতে হবে৷”
“কেনো?!”
“কেনো? যতো লোকের চোখ ট্যারা হবে সবার চোখ সারাই করতে হবে না?”
হুমায়ূন আনন্দে হাসতে লাগলো৷ বাইকের উপর আদর করে হাত বুলিয়ে বললো, “বিশ সেকেণ্ডের মধ্যে স্পিড তিনশ' কিলোমিটারে তুলে নিতে পারবি৷ এটা সাতশো কিলোমিটার স্পিডে চলতে পারে৷”
শুনে আমি বেশ অবাক হলাম৷ আমাদের ছেলেবেলায় উড়োজাহাজগুলো ঐরকম গতিতে চলাচল করতো৷ এখন অবশ্য ঘণ্টায় সাতশো কিলোমিটার খুব বেশী ব্যাপার না৷ এখনকার আকাশ গাড়িগুলো মারদাঙ্গা গতিতে চলাচল করতে পারে৷ কিন্তু একটা বাইকের জন্য এরকম গতি এই সময়েও আশ্চর্যের ব্যাপার বইকি৷
“চমৎকার!” আমি বললাম৷
হুমায়ূন শ্বাস ফেলে বললো, “আফসোস যে এখনো একটা পঙ্খীরাজ কিনতে পারলাম না৷”
পঙ্খীরাজ এক জাতীয় কৃত্রিম ঘোড়া৷ দেখতে ঘোড়ার মতই, অবিকল ঘোড়ার মতই ছুটতে পারে, ছোটার সময় শব্দটাও ঘোড়ার মতই হয়৷ তবে তফাৎ হলো সেটা আকাশেও উড়তে পারে৷ একটা পঙ্খীরাজের আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা বড় সুন্দর দেখায়৷ দু'পাশে সুন্দর পাখনা মেলে পাগুলো গুটিয়ে যখন সেটা উড়ে যায়, দেখতে খুব ভালো লাগে৷ তবে ঐ জিনিসটার দাম অত্যধিক বেশী৷ হুমায়ূন অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে বটে, তবে সেও এখনও পঙ্খীরাজ কিনে উঠতে পারেনি৷
বললাম, “কিনবি, অসুবিধা কোথায়? সময় তো এখনও শেষ হয়ে যায়নি৷”
হুমায়ূন আমার হাতে চাবি দিয়ে বললো, “নে, একবার চালিয়ে আয়৷”
চাবি নিয়ে বাইকটা চালু করলাম আমি৷ মৃদু একটা মিষ্টি শব্দ করে চালু হলো সেটা৷ আমি আমাদের গলি থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে বড় রাস্তায় চলে এলাম৷ রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা৷ মানুষ এখন হাওয়াই গাড়িতে চলাচল করে বলে রাস্তার উপর চাপ থাকে অনেক কম৷ তার উপর এখন রাত প্রায় দশটা৷ রাস্তায় কিছু গাড়ি ঘোড়া আছে বটে, তবে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়৷ আমি বাইকের সুইচবোর্ডের উপর একটা বোতাম টিপে দিলাম৷ আমার চারপাশে স্বচ্ছ একটা আবরণ তৈরি হয়ে আমাকে ঢেকে ফেললো৷ এখন আর বাতাস আমার শরীরে লাগছে না৷ আমি স্পিড তুললাম৷ মুহূর্তের মধ্যে বাইকের স্পিড একশ' ছাড়িয়ে গেলো৷
রাস্তা ধরে ছুটে যেতে থাকি৷ কিছুদূর গিয়ে গতি আরো বাড়িয়ে দেই৷ একটা আকাশ গাড়ি নেমে এসে আমার পাশ দিয়ে উড়তে থাকে৷ তাকিয়ে দেখি দু'জন ছেলে আর দু'জন মেয়ে বসে আছে গাড়িটায়৷ আমার চারপাশের আবরণটা একটু নামাতে শুনতে পেলাম প্রচণ্ড জোরে গান বাজছে ওদের গাড়িতে৷ আমার পাশ দিয়ে চলতে চলতে ছেলেগুলো হাত নেড়ে তারস্বরে চীৎকার করে আমাকে উৎসাহ দিতে লাগলো, আর মেয়েগুলো হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো৷ আমি তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বললাম, “হু উ উ উ... আমি উড়ছি...!”
ছেলেগুলো আমার উদ্দেশ্যে অশ্লীল একটা ভঙ্গি করে হুশ করে গাড়ি নিয়ে উড়ে গেলো৷ আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো৷ ওরা এখন আমার আয়ত্তের বাইরে, তবু বিড়বিড় করে বললাম, “হুহ, অশ্লীল ভঙ্গি করার অর্থই স্মার্টনেস না!”
আমার বিড়বিড় কেউ শুনলো না৷ না শুনলো তো আমার বয়েই গেলো৷ আমি বাইকের গতি আরো বাড়িয়ে দিলাম৷ হুউউউ.... আমি সত্যিই উড়ছি...
গতির একটা সুবিধা আছে৷ যখন খুব অস্থির লাগে, হতাশ লাগে, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা যখন বড় বেশী পীড়া দেয়, তখন প্রচণ্ড গতিতে ছুটলে সে অস্থিরতা অনেকটা কেটে যায়৷ জীবনের হতাশাগুলো তখন যেনো টের পাওয়া যায় না৷ আমি ক্রমাগত গতি বাড়াতে থাকি৷ গতির উত্তেজনায় আমার অস্থিরতা কমে আসতে থাকে৷ আমি আনন্দিত বোধ করি৷ হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি, সামনের সিগন্যালে এক ট্রাফিক পুলিশ আমাকে থামার জন্য ইশারা করছে৷ যাহ শালা, কেস তো ঢিলা হয়ে গেলো৷ আমার বাইকের স্পিড এখন একশ' ছাড়িয়েছে৷ শহরের মধ্যে এই স্পিডে বাইক চালানোর নিয়ম নাই৷ এখন আমি কি করি? এই রোবট ট্রাফিক পুলিশগুলো বড়ই যন্ত্রণা করতে পারে, রাত নেই দিন নেই এরা রাস্তার মোড়ে ঠায় খাড়িয়ে থাকে৷ মানুষ ট্রাফিক হলে এতোক্ষণে বাড়ি গিয়ে বউয়ের ফষ্টিনষ্টি করতো, বা বাচ্চাদের পড়াতে বসতো, বা টিভির বস্তাপচা প্রোগ্রাম দেখতো, বা পরকিয়া করতো, কিন্তু এই রোবটগুলার এরকম কোনো বালাই নেই৷ শালা! তিক্ততায় আমার ভিতরটা ভরে গেলো৷
আমি দ্রুত চিন্তা করলাম৷ আমার না থেমে কোনো উপায় নেই৷ আমি যদি এখন রোবটটাকে উপেক্ষা করে চলে যাই, দু'মিনিটের মাথায় আমাকে দুনিয়ার রোবট পুলিশ ঘিরে ফেলবে৷ আমাকে থামতেই হবে৷
আমি রোবটটার কাছে এসে বাইক থামালাম৷ রোবট পুলিশটা বললো, “আপনি একশ' চুয়াল্লিশ কিলোমিটার স্পিডে বাইক চালাচ্ছিলেন৷ শহরের মধ্যে এতো জোরে কোনো যানবহন চালানো নিষেধ, আপনি জানেন না?”
আমি উত্তর দিলাম না, রোবটটার দিকে চেয়ে একটু কাঁধ ঝাকালাম শুধু৷ সে আবার বললো, “আপনার আইডি দেখান৷”
আমি পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করতে করতে দ্রুত চিন্তা করতে থাকি৷ এই ব্যাটা রোবট এখন আমাকে একটা জরিমানার অংক ধরিয়ে দিবে৷ এদের জরিমানাগুলো হয় আকাশচুম্বি, অতো টাকা জরিমানা দিতে গেলে আমি সমস্যায় পড়ে যাবো৷ আমাকে এমন একটা কিছু করতে হবে যাতে কোনো জরিমানা ছাড়াই এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়৷ কিভাবে এমন কিছু করা যায়? আমি ভাবতে থাকি৷ আমার প্রাচীন আমলের অনেক গল্প মনে পড়ে যায়৷ সেই সময়কার বিজ্ঞান কল্পকাহিনীগুলোতে রোবটকে বোকা বানানোর নানা রকম প্রচেষ্টা দেখা যেতো৷ কোনো বিচিত্র কারণে সেই সময়কার লেখকরা তাদের গল্পে রোবটকে বোকা বানিয়ে মজা পেতো৷ হয়তো এভাবে নিজেকে বুদ্ধিমান প্রমাণ করে সেই লেখক আনন্দ লাভ করতো৷ সেইসব গল্পের রোবটগুলোকে পাইয়ের মান বের করতে দিলে, বা উদ্ভট কোনো অংক কষতে দিলে হ্যাং হয়ে যেতো৷ এটাকে সে রকম কোনো উদ্ভট অংক করতে দিয়ে দেখবো নাকি? নাহ, এতো গতানুগতিক কোনো কিছু আমি কখনো করি না৷ পাইয়ের মান বের করতে গিয়ে রোবটটা সত্যি সত্যি হ্যাং হয়ে গেলেও আমি কখনও তাকে সেটা করতে বলবো না৷ আর সত্যি কথা হলো পাইয়ের মান বের করতে গিয়ে রোবটের হ্যাং হয়ে যাওয়ার সত্যি কোনো কারণ নেই৷ কোনো রোবটকে ওরকম করে তৈরি করা হয় না৷
আমি রোবটটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম৷ অবিকল মানুষের মতই দেখতে একটা রোবট৷ লম্বা প্রায় ছ' ফুটের কাছাকাছি৷ মাথাভর্তি সিনথেটিক চুল৷ চোখ দু'টো এতো জীবন্ত যে মনে হয় সত্যি সত্যি রোবটটার প্রাণ আছে৷ এটা কোন জেনারেশনের রোবট আমি বুঝতে পারছি না৷ কোনো রোবটকে দেখেই আমি তার জেনারেশন বুঝতে পারি না৷ মানুষের সৃষ্টির মধ্যে বৈচিত্র নেই, পৃথিবীর তাবৎ রোবটকে আমার একই রকম মনে হয়৷
এই রোবটটার মধ্যে কি আবেগ আছে? না থাকার সম্ভাবনাই বেশী৷ খুব কম রোবটকেই আবেগ দিয়ে তৈরি করা হয়৷ রোবটের আবেগ ব্যাপারটা এখনও খুব বেশী দূর এগোতে পারেনি৷ যে সব রোবটের মধ্যে আবেগ দেয়া হয় সেগুলোর মধ্যে আবেগের বাড়াবাড়ি দেখা যায়৷ প্রায় সময়ই আবেগের বশে সেগুলো উল্টাপাল্টা করতে শুরু করে৷ সে কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই আবেগ প্রবণ রোবট নিষিদ্ধ৷ চীনে একবার কয়েক হাজার আবেগ প্রবণ রোবট তৈরি করা হয়েছিলো, সেগুলো এমন উল্টাপাল্টা শুরু করেছিলো যে চীন সরকার সেগুলোকে নিষিদ্ধ করে বাজার থেকে তুলে নেয়৷ শুনেছি বাংলাদেশ সরকার পরে সেই রোবটগুলোকে কিনে নিয়েছিলো৷ নিতেই পারে, পৃথিবীর তাবৎ রদ্দি মাল অনেক আয়োজন করে অনেক বেশি পয়সা দিয়ে কিনে না আনলে আর বাংলাদেশ সরকার কেনো? পত্রিকাগুলো অবশ্য সেই রোবট কেনা ন্য়ে কিছুদিন বেশ হৈ চৈ করেছিলো, কিন্তু তারপর আর কিছু শোনা যায় নি৷
আমি আইডি কার্ড বের করে রোবটটার দিকে বাড়িয়ে ধরে একবার হাসলাম৷ রোবটকে আপনি করে বলা উচিৎ না তুমি করে সে প্রশ্নের মীমাংসা আমি কখনো করতে পারিনি বলে আমি সাধারণত রোবটের সাথে কথা বলি না৷ কিন্তু এখন তো কিছু বলা দরকার৷ বললাম, “কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে আজকে দেখেছো?”
রোবটটা বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকালো৷ তারপর আকাশের দিকে৷ সেখানে সত্যিই এক রূপালী চাঁদ ঝলমল করছে৷ তার চোখের সপ্রশংস দৃষ্টি দেখে আমি আবার বললাম, “এমন সুন্দর রাতে প্রিয় কারো হাত ধরে বেড়াতে খুব ভালো লাগে, না? আচ্ছা, তোমার প্রিয় কেউ নেই?”
কি বলবো? আমার চোখের সামনেই রোবটটার মুখের চেহারা হঠাৎ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো৷ রোবটের মুখে অবশ্য ফ্যাকাসে ভাবটা ঠিক মানায় না, তবু আমি এটাকে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়াই বলবো৷ কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো সে৷ তারপর হঠাৎ “ওহ” জাতীয় একটা শব্দ করে ফুটপাতে তার চেয়ারটায় বসে দু'হাতে তার মুখ ঢাকলো৷
সত্যি বলতে কি, আমি খুব বোকা বনে গেলাম৷ আহ, এটা সেরকমই একটা আবেগ প্রবণ রোবট দেখা যাচ্ছে!
সে কিছুক্ষণ মুখ ঢেকে বসে রইলো৷ তারপর বিড় বিড় করে বললো, “হ্যাঁ, একজন ছিলো আমার খুব প্রিয়, জানেন৷ খুব ভালো লেগেছিলো তাকে৷ সে ছিলো আমাদের পুলিশের আই জির মেয়ে৷ আমি তখন ছিলাম তার সহকারী, মানে তার টুকটাক কাজ করে দিতাম, সে বাইরে কোথাও গেলে তার সাথে সাথে থাকতাম৷ কি যে সুন্দর ছিলো সে, আর কি যে সহানুভূতিশীল ছিলো আমার প্রতি৷ এতো মিষ্টি ব্যবহার করতো আমার সাথে! আমি না, দিনে দিনে খুব দুর্বল হয়ে পড়লাম৷ খালি তার কথা ভাবতাম৷ সব সময় তার কথা চিন্তা করতাম৷ একদিন তাকে বললাম আমার ভালোলাগার কথা৷ শুনে সে আমাকে কি বললো জানেন? বললো, বললো... হাউ ডেয়ার ইউ, তুমি একটা রোবট হয়ে আমাকে পছন্দ করো? ইডিয়ট, স্টুপিড, গেট লস্ট... তারপর সে আমাকে বের করে দিলো৷ সে আমাকে বুঝলো না বুঝলেন... সে আমার ভালোলাগাটা বুঝলো না৷ কিন্তু বুঝলো না তাও ঠিক আছে, কিন্তু সে আমাকে ইংলিশে গালি দিলো, হাহ হাহ হাহ...”
রোবটটা মুখ চেপে ধরে হাহ হাহ শব্দ করতে লাগলো৷ সম্ভবত এটা তার কান্নার ভঙ্গি৷ আমি, সত্যি বলতে কি, কি করবো বুঝতে পারছিলাম না৷ রোবটের প্রেম কাহিনী আমি কখনো শুনিনি৷ সহানুভূতি জানানোর চাইতে আমার আসলে হাসিই পাচ্ছিলো বেশী৷ বিশেষ করে ইংলিশে গালি দেয়ার বিষয়টা শুনে আমার হাসি চেপে রাখাই শক্ত হয়ে পড়েছিলো৷ কিন্তু হাসাটা ঠিক হবে কিনা সেটাও বুঝতে পারছিলাম না৷ তার আবেগটা মানুষের তৈরি, মানুষ তার ভিতরে আবেগ দিয়েছে, হয়তো ঠিক মতো দিতে পারেনি, কিন্তু সেটার কিছু মূল্য বোধহয় আছে, নাকি? কে জানে!
রোবটটা কান্না থামিয়ে আমার আইডি কার্ড ফিরিয়ে দিয়ে কোনো জরিমানা না করেই বললো, “যান৷”
আমি কার্ডটা নিলাম৷ একটু ইতস্তত করে তার হাত চেপে ধরে আন্তরিকভাবেই বললাম, “তোমার জন্য আমার সহানুভূতি রইলো৷ ভালো থেকো৷”
বাইক চালু করে আবার চলতে শুরু করলাম৷ এবারে আর জোরে না, ধীরে ধীরে চলতে থাকি৷ হুড তুলিনি, রাতের ঠাণ্ডা বাতাস আমার উপর দিয়ে বয়ে যায়৷ ধীরে ধীরে পিছে পড়ে যেতে থাকে পুরোনো শহরটা৷ আমার হঠাৎ ইশরাতকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে৷ ইশরাতকে আমার বড় বেশি মনে পড়ছে৷ মনে হচ্ছে, ইশরাতের পাশে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি৷ পাশাপাশি, কোনো ব্যস্ত রাস্তার ধারে, অথবা কোনো শান্ত নির্জন লেকের পাড়ে বসে থাকবো আমরা দু'জন৷ তাকে ফিস ফিস করে বলবো তার কথা, আমার প্রিয় একজন মানুষের কথা৷
ওর নাম ছিলো দিহান৷ আমরা ঠিক করেছিলাম, বিয়ে করবো৷ সে খুব উৎসাহভরে আমাদের ঘর সাজাবার জিনিস কিনতে শুরু করেছিলো৷ আমরা একটা বাসা ভাড়া করেছিলাম, বিয়ের আগেই সে জিনিস কিনে কিনে বাসাটা ভরে তুলতে শুরু করেছিলো৷ আমাদের খুব বেশি টাকা পয়সা ছিলো না, সে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই গভীর আনন্দ নিয়ে টুকিটাকি জিনিস কিনে আনতো৷ কখনো আমি ব্যস্ততার জন্য তার সাথে যেতে পারতাম না, তখন সে তার মা অথবা তার ছোট বোনকে সাথে নিয়ে শপিংয়ে চলে যেতো৷ যেদিন তার বিয়ের শাড়িটা কিনলাম আমরা দু'জনে মিলে, আনন্দে, লজ্জায় সে এমন হয়ে গিয়েছিলো যে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে ভেসে গিয়েছিলাম৷ সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিলো, আমার চেয়ে সুখী পৃথিবীতে কেউ নেই৷
তারপর সে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো৷
চার
মানুষের জীবন বড় বিচিত্র গল্প৷ প্রতিটি মানুষেরই আলাদা আলাদা গল্প আছে৷ সে গল্পে সুখ আছে, দুঃখ আছে, আছে হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা৷ আমার জীবনের গল্পও সেরকম নানা বিচিত্র অনুভূতিতে ভরপুর৷ সে সবের মধ্যেই আমি বেড়ে উঠছিলাম৷ কিন্তু বড় হয়ে উঠতে উঠতে আমি টের পাই, আমি বড় একা, বিশাল বিপুল পৃথিবীতে নিজের বলতে আমার কেউ নেই৷ সেই একাকী বিশাল পৃথিবীতে আমার যে খুব খারাপ লাগতো, তা বলবো না৷ শুধু মাঝে মাঝে অন্যদের সুখী পরিবার, সুখী মুখ যখন দেখতাম, টের পেতাম, বুকের কোথায় একটা হাহাকার বেজে উঠতো৷ কোথায় যেনো আশ্চর্য শূন্যতার অনুভূতি৷ এভাবেই চলে গেলো দীর্ঘকাল৷ তারপর একদিন দিহান এসে দাঁড়ালো আমার পাশে৷ আমাকে এক ঘরের স্বপ্ন দেখালো৷ আমি স্বপ্ন দেখলাম৷ বড় বিস্মিত হয়ে ভাবলাম, আমার মতো তুচ্ছ মানুষের জন্যও পৃথিবী কিছু আয়োজন করে রাখে!
আর তখনই তার যাওয়ার সময় হলো৷ সেটা আমার সমস্ত চিন্তা, সমস্ত কল্পনার বাইরে ছিলো৷ আমি কখনো ভাবিনি, সে এভাবে চলে যাবে৷ আমার সুদূরতম দুঃস্বপ্নেও আমি কখনো এটা কল্পনা করতে পারিনি৷
আমাদের বিয়ের দু' দিন আগে, মাত্র দু'দিনের জ্বরে দিহান, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো৷
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমরা মানুষেরা ঐ রোবটের মতো৷ আমরা মানুষেরা রোবটের মধ্যে আবেগ তৈরি করে মজা দেখি৷ আবেগের বশবর্তী হয়ে সে যখন উল্টাপাল্টা কিছু করে, আমরা তাই নিয়ে হাসাহাসি করি৷ হয়তো তেমনই কোনো অসীম শক্তিধর কেউ আমাদের মাঝে আবেগ দিয়ে মজা দেখছে৷ তার সেই মজার শিকার হচ্ছি আমরা৷ আমরা হাসছি, আমরা কাঁদছি, আর সে বসে বসে তাই দেখে আনন্দ লাভ করছে৷
রাতের ঠাণ্ডা বাতাস কেটে বাইকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়৷ আমার কেমন শীত করে৷ বাইকটা রাস্তার একপাশে থামিয়ে ফুটপাতে বসে মোবাইলটা বের করি৷ সেটা তার স্মৃতি ঘেটে দিহানের একটা হলোগ্রাম আমার সামনে তৈরি করে দেয়৷ বহুদিন আমি দিহানকে দেখিনি৷ বহুদিন আমি চেষ্টা করেছি তাকে ভুলে থাকার৷ কতোদিন পর আমি দেখলাম তার মুখ!
বেঁচে থাকতে আমি দিহানকে তুমি করে বলতাম৷ সে মারা যাবার পর কি করে যেনো আমি মনে মনে তাকে তুই করে বলতে শুরু করেছি৷ হয়তো মেয়েটি মারা গিয়ে আমার মধ্যে এমন একটি ঘোর তৈরি করেছে যা আমাকে দিয়ে তুই করে বলাচ্ছে৷
আমি ফিস ফিস করে বললাম, “দিহান, তুই আমার পাশে একটু বসবি?”
“এই যে আমি তোমার পাশে আছি!”
আমি ওর হলোগ্রাফিক মুখটা দু'হাতে ধরার চেষ্টা করে বললাম, “জীবনটা এমন কেনো দিহান? এমন অস্থির, শূন্যতায় ভরা?”
দিহান হাসলো৷ ফিস ফিস করে বললো, “তোমার স্বপ্নের সেই দৈত্যটা তোমাকে কি বলেছিলো ভুলে গেছো? জীবন আসলে দুঃখ৷ মাঝে মাঝে যেটুকু সুখ আমরা পাই তার স্মৃতি নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়৷”
আমি ওর হলোগ্রাফিক চুলের উপর আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি৷ হলোগ্রামটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়৷ আমার আবার অস্থির বোধ হয়৷ বাইকে উঠে চলতে শুরু করি৷ ধীরে ধীরে গতি বাড়তে থাকে৷ হাইওয়ে ধরে বাইকটা আমাকে নিয়ে উড়ে যায়৷ আমি প্রাণপণে গতি বাড়িয়ে ছুটতে থাকি৷ আমি পালিয়ে যেতে চাই, হারিয়ে যেতে চাই অনেক চেনা এই পৃথিবী থেকে৷ পালিয়ে যেতে চাই দূরে, দিগন্তের ওপাড়ে, অচেনা সুখের রাজ্যে, যেখানে আমি কখনো পৌঁছতে পারবো না৷
[সমাপ্ত]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১০ দুপুর ১২:৩৭