হায়ার ম্যাথ পরীক্ষার আগের রাতে কাকতালীয়ভাবে ফটোকপির দোকানে আনিস স্যারের করা প্রশ্নটা পেলাম। সর্বনাশ!! প্রশ্ন সেই লেভেলের কঠিন হইছে। বেশির ভাগ প্রশ্নই আনকমন।
আমি আর হযরত সারা রাত ধরে প্রশ্নটা সলভ করলাম। পরদিন, অন্যদের মন খারাপ থাকলেও আমাদের পরীক্ষা হলো ফাটাফাটি।
রেজাল্টের দিন দেখি আমি পাইছি পঞ্চাশে উনপঞ্চাশ, ক্লাসের হায়েস্ট মার্ক আর হযরত আলী ফেল!! ক্যামনে!!!
ক্লাশ থেকে বের হয়ে আমি হযরতকে জিজ্ঞাস করলাম, কিরে, কি ভুল করছিস? হযরত আলী ক্ষেপে গেলো। মেজাজটা আমারো খারাপ হয়ে গেলো। বললাম, পাগলা, তোকেও ব্যাঙের মাংস খাওয়াতে হবে। তাহলে তোর মাথা ঠান্ডা হবে, ব্রেইন শার্প হবে। একবার দেখলেই সব পড়া মনে থাকবে।
-তুই পরীক্ষার আগে ব্যাঙ খেয়ে আসছিস?
আমি গল্পটা বলা শুরু করলাম।
-শোন, ছোটবেলায় আমার মারাত্মক রকমের জেদ ছিল। বাপ মায়ের প্রথম সন্তান, অতিরিক্ত আদরে বাদর হয়ে গেছিলাম। সামান্য কিছুতেই শুরু করতাম চিৎকার আর গালিগালাজ। এ থেকে এম পর্যন্ত সমস্ত গালিই আমার মুখস্ত ছিল। আমার জেদের কাছে বাড়ির সবাই ছিল অসহায়। খেলতে গেলে প্রায়ই মারমারি করে বাড়ি ফিরতাম। আমার জেদ নিয়ে আম্মা সারাক্ষণই টেনশনে থাকতো।
আমার দাদাবাড়ী থানাহাট হাইস্কুলের ঠিক পাশে। সেসময় এস.এস.সি পরীক্ষা ছিল উৎসবের মত। পরীক্ষার দিন একজন পরীক্ষার্থীর সাথে কম করে চারজন সাহায্যকারী আসতো। একজন ব্যাস্ত থাকতো পরীক্ষায় কি প্রশ্ন আসছে সেই খোঁজ নেয়ায়, একজন নোটবই থেকে উত্তর বের করায়, অন্যরা ব্যস্ত থাকতো পরীক্ষার্থীকে সেই নকল পৌছে দেয়ার জন্য। নকলের যুগের সেই পরীক্ষার পুরো সময় ধরে, পুলিশ আর নকল সরবরাহকারীর মধ্যে চলতো বৌচি খেলা। পুলিশের ধাওয়া, লাঠিচার্জ এর ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত বিরতিতে দেখা যেতো এক্সপেল হওয়া পরীক্ষার্থীরা মাথা নিচু করে হল থেকে বের হয়ে আসছে। কেউ কেউ আবার কেঁদে কেটে অজ্ঞান হয়ে যেত। আনন্দ, বিনোদন, কান্না, শোক কি ছিলোনা তখনকার পরীক্ষায়।
আমার আম্মা বেশিদুর লেখাপড়া করতে পারেন নাই। এইসব দেখে, আম্মার জীবনে তখন একটাই স্বপ্ন তার ছেলেও একদিন এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে!!
আম্মার স্বপ্ন পূরণে প্রথমে আমাকে স্কুলে ভর্তি করানো দরকার। এদিকে, আমার জেদ আর রাগ দেখে আম্মার মনে ভয়, কোন স্যার আমাকে কিছু বললে, আমি যদি স্যারের হাত থেকে বেত কেড়ে নিয়ে উল্টা মাইর শুরু করে দেই। অথবা, কোন স্যারকে এ থেকে এম পর্যন্ত গালি শুনিয়ে চলে আসি।
কি করা যায়? সেসময়, আম্মাকে যে যা সাজেশন দিতো আম্মা আমার উপর তাই এপ্লাই করতো। না, কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছিলো না। শেষমেশ কেউ একজন আম্মাকে বুদ্ধি দিলো, ব্যাঙ যেহেতু শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রানী। ব্যাঙের মাংস খাওয়ালে আমার মাথা ঠান্ডা হবে!!
ছোটমামাকে দায়িত্ব দেয়া হলো ব্যাঙ ধরে আনার। ছোটমামা কোত্থেকে একটা বিশাল সাইজের কোলাব্যাঙ ধরে আনলো। ব্যাঙের পা রান্না করা হলো, খেলাম!!!
এরপর, ব্যাঙয়ের মাংসের কুদরতে; নাকি, শিশু নিকেতনের আমাদের সময়কার স্যারদের আদরে আমি পুরোপুরি চেঞ্জ হয়ে গেলাম।
এতক্ষণ হযরত আলী হা করে আমার গল্প শুনতেছিল। সে বলল, চল আমরাও একদিন ব্যাঙ এর মাংস খাই। আমি মনে মনে ভাবলাম, প্রস্তাবটা মন্দ না। ব্যাঙ এর মাংস খাওয়ার গল্পটা আমি আম্মার কাছে শুনেছি। আমার ভালো মনেও নেই। আরেকবার খেয়ে দেখলে মন্দ হয়না।
যা ভাবা তাই কাজ। পরদিন আমি আর হযরত গেলাম রুবেলের বাড়িতে। সব শুনে রুবেলও যোগ দিলো আমাদের সাথে। তিনজন মিলে সারাবেলা খুঁজেও একটা ব্যাঙ ধরতে পারলাম না। এদিকে আকাশ ভেঙ্গে ঝুম বৃস্টি নামলো। আমরা তিনজনই ভিজে একাকার। রুবেলের মাথায় শয়তানি বুদ্ধি আসলো। সে একটা মুরগী দেখিয়ে বলল, আজকে ব্যাঙ বাদ দে। চল আজকে এই মুরগীটা জবাই করে নিয়ে যাই। প্রথমে অসম্মতি জানালেও শেষমেশ আমরাও রাজি হলাম। হযরতের বাড়িতে সবেমাত্র রান্না শুরু করেছি। কিভাবে যেন, হযরতের মিয়া ভাই ঘটনা জেনে ফেলেছে।
এরপর, হযরতের পিঠ আর মিয়াভাইয়ের লাঠি। আমি আর রুবেল মাইর না খেলেও, আমাদের শাস্তি ঠিক করা হলো মুরগীর মালিককে খুঁজে বের করা। মিয়া ভাই আমাদের হাতে মুরগীর দাম দিয়ে বললেন, মালিককে খুঁজে বের করে এই টাকা দিয়ে আসবা।
না, অনেক চেস্টা করেও মুরগীর মালিককে খুঁজে পেলাম না। শেষমেশ জামে মসজিদের দান বাক্সে মুরগীর দামের টাকা দান করে, তওবা করায় মিয়াভাই আমাদের মাফ করলেন।
গতকাল অফিস থেকে ফেরার পর বউ বলতেছে, তোমার ছেলের সেই রকমের জেদ হইছে। ওকে রেখে একটু বাথরুমেও যাওয়া যায়না। চিৎকার করে পুরা বাড়ী মাথায় তোলে। আমি হাসলাম। মনে মনে বললাম, হযরত আলী দুবাই থেকে ফিরুক। আগেরবারের ব্যর্থ অভিযানটায় আরেকবার বের হতে হবে
গল্পের পেছনের গল্পঃ
উপরের লেখাটা একটা নিছক গল্প, বাকৃবিতে পড়ার সুবাদে জানি,
* ব্যাঙের মাংস খাওয়ার সাথে মাথা ঠান্ডা গরমের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই।
* একটা কোলা ব্যাঙ তার পুরো জীবনে কৃষকের ৭৬ লক্ষ টাকার ফসল বাঁচায়।
* ইসলাম ধর্মেও ব্যাঙ হত্যা সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা আছে।
* নানা কারনেই কৃষকের বন্ধু- ব্যাঙ আজ বিলুপ্ত-প্রায়।
* ব্যাঙ সংরক্ষণে আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিৎ।
হযরত আলী বর্তমানে ইউনাইটেড আরব আমিরাত-দুবাইয়ে থাকে। রুবেল, ইউনাইটেড স্টেটস অব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব হয়ে এখন নরসিংদীতে আস্তানা গেড়েছে। আমি কিছুদিন আগে নোয়াখালি-মহাদেশ থেকে ফিরে এখন ঢাকায়। গত কয়েকদিন থেকেই কেন জানি স্কুল জীবনের ঘোরাঘুরির মজার স্মৃতিগুলো খুব মনে পড়ছে। সংসার জীবনের চাপকে সাইডে রেখে, আগেরকার মত আরেকবার গন্তব্যহীন পথে বের হতে পারলে ভালো হতো।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১০:১৩