চোখের সামনে বসা লেখক জাফর ইকবাল, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আনিসুল হক, অপি করিম, আইয়ুব বাচ্চু সহ আরও কত সেলিব্রেটি।
গনিত অলিম্পিয়াডে ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রতিযোগিতায় সেকেন্ড রানার-আপ হওয়ার পর কেন্দ্রীয় প্রোগ্রামের জন্য ঢাকায় এসেছি। আমাদের কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে কেবল আমি আর মেহেদি চান্স পাইছি, বাকি সবাই সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।
অবাক কান্ড, অনুষ্ঠানে এতো এতো সেলিব্রেটি থাকতে আমার ভাল লাগলো ড. জেসমিন ম্যাডামকে। জেসমিন ম্যাডাম ঢাকা ইউনিভার্সিটির জেনেটিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। একজন মানুষ এতো সুন্দর হয় কিভাবে! এতো সুন্দর করে কথা বলে কিভাবে!! ক্রাশ শব্দটা তখন পর্যন্ত বোধয় আবিষ্কারই হয়নি। না হলে হয়তো বলতাম, প্রথম দর্শনে ম্যাডামের উপর ক্রাশ খাইছি!!
অনুষ্ঠানের ফাঁকে সবাই সেলিব্রেটিদের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিচ্ছিলো। আমি ছুটলাম জেসমিন ম্যাডামের কাছে। অটোগ্রাফ চাইলে ম্যাডাম বললেন, “তুমি ভুল করছো, আমি কিন্তু কোন সেলিব্রেটি না”। আমি বললাম, “ম্যাডাম, আপনার কথাগুলো আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি। যাক, ম্যাডাম অটোগ্রাফ দিলেন”। এটাই ছিলো আমার জীবনে প্রথম কারো অটোগ্রাফ নেয়া।
প্রোগ্রাম শেষে, ট্রেনে করে ময়মনসিংহ ফিরছি।
অবাক কান্ড! সেকেন্ড ইয়ারের ভাইয়ারাও জেসমিন ম্যাডামের গল্প করতেছে! এইটা কোন কথা।
আমি ভাইয়াদের বললাম, “আপনারাও”?
সবাই প্রায় একসাথে বললো, “মানে”?
আমি ব্যাগ থেকে ম্যাডামের অটোগ্রাফের কাগজটা বের করলাম। সবাই একেবারে ‘থ’। অটোগ্রাফ নিয়ে সবার মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে গেলো। ট্রেনের বাকি যাত্রীরা সব হা করে আমাদের পাগলামি দেখছিলো।
সবাই শান্ত হলে, তানভীর ভাই আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, “কলেজের পর টার্গেট কি”? বললাম, “এখনো ঠিক করিনি”।
অন্য সবাই টার্গেট হিসেবে হয় বুয়েট না হয় মেডিকেলের কথা বললো।
শুধু তানভীর ভাই বললেন, উনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চান! জেনেটিক্স ডিপার্টমেন্টে!! জেসমিন ম্যাডামের সাবজেক্টে!!! আমরা সবাই আবারো চিৎকার করে উঠলাম।
এইচ.এস.সির পর তানভীর ভাই সত্যি সত্যিই মেডিকেল-বুয়েট কোচিং বাদ দিয়ে ভার্সিটি ভর্তি কোচিং শুরু করলেন। সবাই অবাক। এর চেয়েও অবাক করা বিষয় হলো, তানভীর ভাই, বুয়েট-মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষাই দিলেন না!!
কি আজব মানুষ! আমি ভাইকে বললাম, “এবার কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আচ্ছা, আপনার কি ভয় লাগেনা”?
ভাই হেসে বললেন, “জীবনে টার্গেট করতে হবে টার্গেটের মত। তা না হলে সফল হব কি করে। আর পছন্দের জিনিসটা যখন কারো টার্গেট হয়, তখন পরাজয়ের কোন ভয়ই থাকেনা”।
ঢাবি ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ হলো। তানভীর ভাইয়ের পজিশন পঞ্চাশের আশেপাশে। জেনেটিক্সে সিট মাত্র ১০ টা। তানভীর ভাইয়ের জেনেটিক্সে চান্স হবে তো?
তখনকার সময় বেশির ভাগ স্টুডেন্ট জেনেটিক্স চয়েস দিতো না। আলহামদুলিল্লাহ্। ভাইয়ের চান্স হলো।
একদিন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বেড়াতে গেছি। তানভীর ভাই আমাকে ওনার ডিপার্টমেন্ট, ক্লাশরুম ঘুরে দেখালেন। আমি জেসমিন ম্যাডামের কথা জানতে চাইলে, হেসে বললেন, ম্যাডাম দেশের বাইরে আছেন। অন্য কোনদিন দেখা করিয়ে দেবেন।
আমার নিজের ভর্তি পরীক্ষার আগে ভাই আবারো জিজ্ঞাস করলেন, “টার্গেট কি?”
আমি সেদিনও বললাম, "এখনো ঠিক করিনি"।
মনে মনে অবশ্য ঠিক করা ছিল, বুয়েট কোচিং করব। চান্স না হলে কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট তো আছেই। আর এসবে না হলে ঢাবিতেও কি চান্স পাব না।
না, স্পেসিফিক টার্গেট না থাকায়, বাকৃবি বাদে আর কোথাও চান্স হলো না।
অনার্স-মাস্টার্স পড়া শেষেও আমি জানতাম না আমার টার্গেট কি।
শেষমেশ লাইফে দুইজন মানুষের সাথে আমার দেখা হলো, অস্ট্রেলিয়ার ইওমিন বাও আর শ্রীলংকান আশান রাতওয়াতে। এই দুইজন অবশ্য এখনো জানেই না উনারা আমার কি উপকার করেছেন!
এরপর?
এরপর, আমি কি বা* ছিড়ছি? এখনো কিছু ছিড়ি নাই।
তবে, এরপর আমি বুঝতে পারছি, জীবনে চলার পথে টার্গেট জিনিসটা আসলে কেন দরকার। আর হা, টার্গেট আর ভালবাসা যখন সেইম হয়। তখন সেই কাজে পরাজয় বলে কোন শব্দ থাকে না। সেই কাজে থাকে শুধুই আনন্দ। শেখার আনন্দ, জানার আনন্দ।
গল্পের পেছনের গল্পঃ
গত সপ্তাহে ছুটিতে বাড়ি গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, আমার আম্মা, বউ, শ্বশুর, শাশুড়ি আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে বেড়ানোর সময় নিজেদের জীবনের কস্ট আর সুখের গল্পগুলো বলেন।
সাড়ে তিনমাস বয়সের আমার ছেলেটা গল্পগুলো বুঝতে পারে কিনা, জানিনা।
একবার আমি কোলে নিয়ে বেড়ানোর সময়, ওকে তানভীর ভাইয়ের গল্পটা শোনালাম।
বললাম, "বাবারে, লাইফে যা মন চায় করিস। যদি কোন কাজের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করিস সেটাকেই টার্গেট বানিয়ে নিস, এরপর শুধু দরকার যথাসাধ্য পরিশ্রম"।
ছেলে জবাবে একটু পরপর বলতেছে, হ্যাঁআ...!! হ্যাঁআ...!! হ্যাঁআ...!!! হ্যাঁআ....!!!! এই সাংকেতিক ভাষার অর্থ আমার জানা নাই।
ছবিঃ প্রথম আলোতে পাতায় জেসমিন ম্যাডাম, গনিত অলিম্পিয়াডের কোন এক আসরে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০২১ বিকাল ৩:১৬