সেদিন জানালার পাশে দাড়িয়ে থেকেও কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। চারিদিকে কেমন যেন এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। মাঝে মাঝে টিলার ওপাশ থেকে ভেসে আসা শেয়ালের ডাকগুলো জানালার গায়ে এসে বাড়ি খায়। মনে হয় এই বুঝি জেগে উঠবে আরতি। কিন্তু কই?? অনেকনই তো হল!!! জানালার গায়ে কান পাতে সুনিল। ওপাশ থেকে আজ আর কোন শব্দ আসেনা। মৃদ স্বরে নাক ডাকা কিংবা গোঙ্গানির কোন শব্দ নেই। নেই কোন নীচু কথার অস্পস্ট আওয়াজ।
মাঝরাতে এমন অনেক দিনই এসেছে। কিন্তু এমন একা মনে হয়নি তাকে। প্রায় প্রতিদিনিই জানালার পাশে কিছুন দাড়িয়ে থাকার পর আরতি চলে আসে। মাঝ রাতে দুজনের মধ্যে যে সখ্য গড়ে ওঠে তা স্বর্গীয়, কোন কলুষতা নেই, নেই কোন প্রতারনাও। সুনিল-আরতির এমন প্রেমলীলায় কেউ বাধা হয় না। কিংবা বারন করে না কেউ তাদের।
আজ আর আরতি আসেনি। কিন্তু কোথায় যেতে পারে সে! ভেবে ভেবে সুনিল অস্থির হয়। এতদিনের চেনা-জানা আরতি কি তাহলে আজ না বলেই কোথাও চলে গিয়েছে???
তা কি করে সম্ভব!! কোথাও চলে গেলে তো সুনিলকে জানিয়েই যায়।
তাহলে আজ??
এমন প্রশ্নের কোন জবাব নেই সুনিলের কাছে। একটি রাত ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকা আর নিস্ফল অপো তার। জানালার গ্রিল ধরে দাড়ায়...ভবনের ছাদে উঠে পায়চারি করে।
শরতের এই চাদিমা রাতে আকাশের অস্পস্ট আলোতে সুনিল আবিস্কার করে ধান তে পেরিয়ে খোলা মাঠটায় কয়েকটি ছায়া মূর্তি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ছায়াগুলো কেমন যেন অশরীরি মনে হল.....
মনের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠলো তার।
এতরাতে ওখানে এত লোক কেন? কিই বা করছে তারা সেখানে?
এরকম অনেক প্রশ্ন আর উত্তেজনায় সুনিলের শরীরে বার কয়েক ঝাকুনি দেয়। সহসাই ছাদ থেকে নেমে দরজার পাশে গিয়ে দেখে দরজাটা আস্তে করে ভেজানো। মনের মধ্যে খটকা লাগে। সাহস সঞ্চার করে ধান ক্ষেতের সরু আল দিয়ে সামনে এগোয়। অমনি ক্ষেতের মধ্য দিয়ে কয়েকটি শেয়াল এক যোগে দৌড় দেয়। খানিক দুরে গিয়েই ডাক দেয়। হুয়াক্কা হু, হুয়াক্কা.....হু.. । এই রাতে শেয়ালের এমন হঠাৎ ডাকে হুশ ফেরে ছায়া মানবগুলোর। আগাম কোন সংকেত। এটা নিঃসন্দেহে কোন বিপদের বার্তা নিয়ে আসছে। অমনি বস্তাটায় বার কয়েক ঘা দিয়েই শিষ দেয় একটি ছায়া। আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় ছায়াগুলো। সুনিলের বুুকের মধ্যে বজ্র নিনাদ হয়। ভয় আর আতংকে ঝাকুনি দিয়ে উঠে পুরো শরীর। ভীরু পায়ে সামনে গিয়ে দেখে একটি বস্তা বন্দী কি যেন পড়ে আছে। একটু অদূরে ছড়িয়ে আছে একজোড়া জুতো,একটি স্যালোয়ার।
সুনিলের বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠলো। জুতোটা যে আরতির। তাহলে কি আরতি!!!!!
বস্তায় হাত উঠে যায়। মুখটা একটা কাপড় দিয়ে বাঁধা। সেটি আরতির ওড়নাই হবে। বস্তার মূখ দিয়ে একগোছা রেশমী চুল বেরিয়ে আছে। অমনি চিৎকার দিয়ে উঠে সুনিল।
-হায় ভগবান....
গহীন রাতে সুনিলের সে চিৎকার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে যায়। ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় টিলার গায়ে লেগে।
-কে খুন করলো আমার আরতিকে?? ি
-ক কারনে চলে গেল সে?
কোন উত্তর নেই, কেবল হাহাকারই ফিরে আসলো তার কাছে। এত রাতে কোন জনমানুষও নাই। কি করবে কোথায় যাবে সে।
-বাড়ীতে কি আরতিদের কারো ঘুম ভাঙ্গলো? নাকি সবাই এখনো ঘুমে।
আরতির মা কি এখনো তার মেয়ের খোঁজ নিতে জাগে নি । নাকি ওর বাবা আজ আর মাঝ রাতে কাশির ট্যাবলেট চায় নি।
সুনিল এখন পাথর হয়ে গেছে। বিলীন হয়ে গেছে তার ভাষা আর বুদ্ধি। এই রাতে আরতির নিখোঁজ হবার কারন বুঝতে পারে সে। সুনিলের আসার খানিক আগেই আরতি ঘরের বাইরে এসেছিল। আর সেটাই তার জীবনের জন্য কাল হয়ে গেল। বাইরে ওৎপেতে থাকা হায়েনাগুলো তাকে ধরে নিয়ে প্রথমে গনধর্ষন পরে চিরতরে নিভিয়ে দিল জীবন প্রদীপ।
-এখন আমি কি করবো কোথায় যাব কাকে গিয়ে জানাবো। অমনি বস্তা থেকে আরতির নিথর দেহখানা বেরকরে কাঁধে নিয়ে চললো আরতিদের বাসার কাছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে চিৎকার করে উঠলো সুনিল।
-যোগেশ কাকা....যোগেশ কাকা.....
এতরাতে বাইরের দরজায় চিৎকার শুনে লাফ দিয়ে উঠে যোগেশ আর তার স্ত্রী জয়ারানী। লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই সুনিলের চিৎকার আর চেচামেচিতে বিপদের হাতছানি টেল পায়। একটু আবছা আলোতেই তার কাঁধে দেখতে পায় আরতির নিথর দেহ।
সাজোরে চিৎকার দেয় আরতির বাবা-মা।
-হায়! ভগবান,,এ কি সর্বনাশ হলো....