॥ মাসুদ মজুমদার ॥
বিস্মৃত ও চাপা দেয়া ইতিহাস নিয়ে আলোচনার প্রথম পর্বটি অনেকের মনে দাগ কেটেছে। সেটা ছিল মুসলিম শাসনের শেষ প্রান্তে ইংরেজ আধিপত্যের প্রেক্ষিত। ‘ইতিহাসের সেই বাঁকে’ শিরোনামে লেখাটি ছিল ইতিহাসকেন্দ্রিক ধারাবাহিক লেখার প্রথম কিস্তি। ’ ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি’ নামে দ্বিতীয় কিস্তিতে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা তুলে ধরা হয়েছে। চলতি পর্বে ষড়যন্ত্র থেকে ইংরেজদের বিজয় পর্যন্ত একটি সাধারণ বর্ণনা তুলে ধরা হলো। তারপর ইংরেজদের দিওয়ানি লাভ ও দ্বৈতশাসন নিয়ে আলোচনা ঠাঁই পাবে।
আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি, কোন প্রেক্ষাপটে মুসলিম শাসনের অবসান হলো। কোন মাত্রার ষড়যন্ত্রের ফলে দেশ স্বাধীনতা হারাল। ইংরেজেরা কাদের সাহায্যে এই দেশ দখল ও শাসন করার সুযোগ পেয়েছিল। কাদের বিশ্বাসঘাতকতার খেসারত দিয়েছিল বাংলা, বিহার উড়িষ্যার মানুষ। কাদের কারণে শেষ পর্যন্ত ভারত পদানত হলো ইংরেজদের কাছে।
অনেকেই ইতিহাস-আশ্রয়ী না হয়ে মুসলিম শাসনের ওপর তির্যক মন্তব্য করতে চান। বোঝাতে চান মুসলিম শাসকদের সাথে জনগণের যোগসূত্রতার অভাব ছিল। প্রকৃত ইতিহাস সেই সত্য মেনে নেয় না। কারণ শাসকদের সাথে সাধারণের দূরত্ব সব সময় থাকে। তখনো ছিল, এখনো আছে। শাসক ও শাসিতের মাঝে দূরত্বের কারণে স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়া যায় না। ইতিহাস এমন খোঁড়া যুক্তি সমর্থন করে না।
এভাবে নিবিড় ইতিহাস চর্চার মূল লক্ষ্য অতীতচারী হওয়া নয়। ইতিহাসের সাথে বর্তমানের সাযুজ্য খুঁজে পেতে সচেষ্ট হওয়া। আমরা বুঝতে চাই- আমাদের বর্তমান কূটনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্যনীতি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার ভাবনা ও জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিতে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে না তো! আমাদের কাছে ইতিহাসের শিক্ষাটাই মুখ্য। সিরাজউদ্দৌলা উপলক্ষ মাত্র।
সিরাজবিরোধী ষড়যন্ত্রের একপর্যায়ে জগৎশেঠের বাড়িতে অনুষ্ঠিত বৈঠক অনুযায়ী সিরাজউদ্দৌলাকে সরিয়ে মীরজাফরকে বাংলার মসনদে বসানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ওয়াটস এই কাজে ইংরেজদের সর্বাত্মক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপর কোম্পানির প্রধানেরা গোপন ও প্রতারণামূলক চুক্তিপত্রের খসড়া প্রস'ত করেন। সংশ্লিষ্টরা ১৯ মে এতে স্বাক্ষর করেন। মীরজাফর ৪ জুন সেই গোপন চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী সৈন্য সাহায্যের বিনিময়ে মীরজাফর ইংরেজদের কয়েকটি বাড়তি বাণিজ্য-সুবিধা দিতে চুক্তিবদ্ধ হন। তা ছাড়া তিনি ইংরেজ সৈন্যদের ব্যয়ভার বহন করতে এবং কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণস্বরূপ দুই কোটি টাকা দিতে সম্মত হন। নবাবের কোষাগার থেকে উমিচাঁদকে ২০ লাখ টাকা দেয়া হবে বলে বলা হয়। উমিচাঁদকে প্রতারিত করার জন্য ক্লাইভ চুক্তিপত্রের দু’টি খসড়া প্রস'ত করেন। আসল খসড়ায় উমিচাঁদকে টাকা দেয়ার শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়নি। নকল খসড়ায় এই শর্তটি লিখিত হয়। এর স্বাক্ষরগুলো সবই ক্লাইভ জাল করেছিলেন। রায়দুর্লভকেও লুটের মালের অংশ দেয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারলেন। তাৎক্ষণিক মীরজাফরকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারিত করেন এবং বিশ্বস্ত আবদুল হাদী খানকে সে পদে নিয়োগ দেন। আবদুল হাদী ও মীর মদন বিশ্বাসহন্তা মীরজাফরকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য নবাবকে পরামর্শ দেন। জগৎশেঠ ও অন্যান্য কুচক্রী বিশ্বাসঘাতক উপদেষ্টারা নবাবকে ভিন্ন পরামর্শ দেয়। তারা নবাবকে বোঝায় যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তি বৃদ্ধির জন্য মীরজাফরের সহযোগিতা লাভ করা নবাবের পক্ষে সুবিবেচনার কাজ হবে। নবাব সরল মনে তাদের উপদেশ গ্রহণ করেন। নবাব মীরজাফরের বাড়িতে গিয়ে মাতামহ নবাব আলীবর্দীর নামে তার কাছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য হৃদয়গ্রাহী ভাষায় মর্মস্পশী আবেদন জানান। পবিত্র কুরআন হাতে নিয়ে মীরজাফর এই সময় অঙ্গীকার করেন, তিনি নবাবের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিশ্বস্ততার সাথে যুদ্ধ করবেন। পবিত্র ধর্মগ্রনে'র নামে অঙ্গীকার করায় মীরজাফরকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ ছিল না। নবাব তাকে বিশ্বাস করে আবার প্রধানসেনাপতির পদে নিয়োগ দেন। স্বভাবগত বিশ্বাসঘাতক ও লোভী মীরজাফরকে বিশ্বাস করে নবাব মারাত্মক ভুল করলেন। যদি ওই সময় মীরজাফর ও তার সহচরদের বন্দী করতেন, তাহলে অন্য ষড়যন্ত্রকারীরা ভয় পেয়ে যেত। ক্লাইভ তার ক্ষুদ্র সৈন্যদলসহ কলকাতা দুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হতো। বাংলার ইতিহাস হতো ভিন্নতর।
গোপন চুক্তি অনুযায়ী ক্লাইভ ইংরেজ সৈন্যদল নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। পথে হুগলি ও কাটোয়ার বিশ্বাসঘাতক ফৌজদারদ্বয় ইংরেজ সৈন্য বাহিনীকে কোনোরূপ বাধা দেয়নি। ক্লাইভের অভিযানের খবর পেয়ে বাধ্য হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে রওনা হয়ে ২২ জুন পলাশী প্রান্তরে শিবির স'াপন করেন। ক্লাইভ সে দিন রাতে পলাশীতে পৌঁছে আমবাগানের মধ্যে সৈন্য সমাবেশ ঘটান। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকালে নবাবের সৈন্যদের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ আরম্ভ হয়। মীরজাফর, খাদেম হোসেন, রায়দুর্লভ ও অন্য বিশ্বাসঘাতক সেনানায়কেরা তাদের সৈন্যসহ দুই মাইল দূরে থেকে দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে। নবাবের বিশ্বস্ত কর্মকর্তা ও সেনানায়ক মোহনলাল আর মীরমদন ক্ষিপ্রতার সাথে ইংরেজদের আক্রমণ করেন। তাতে ক্লাইভের সৈন্যরা পিছু হটে আমবাগানের আড়ালে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মোহনলাল ও মীরমদন সেখান থেকেও তাদের বিতাড়িত করতে অগ্রসর হওয়ার সময় একটি বিক্ষিপ্ত গুলিতে মীরমদন মারা যান। বিশ্বস্ত মীরমদনের মৃত্যু সংবাদে নবাব কিছুটা বিচলিত হন। তখনই তিনি মীরজাফরকে ডেকে পাঠালেন। ষড়যন্ত্র অনুযায়ী মীরজাফর সেদিনকার মতো যুদ্ধ বন্ধ রাখতে কুপরামর্শ দেন। তিনি নবাবকে আশ্বাস দেন যে, তিনি পরের দিন তার সব সৈন্যবাহিনী নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। নবাব বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের পরামর্শে মোহনলালকে যুদ্ধ বন্ধ করতে আদেশ দেন। মোহনলাল ও অপর কয়েকজন সেনানায়কের তীব্র আক্রমণে তখন ক্লাইভের সৈন্যদের অবস'া সঙ্কটজনক হয়ে পড়েছিল। মোহনলাল নিশ্চিত জয়ের মুখ থেকে ফিরে আসতে সম্মত হননি। নবাব আবার মীরজাফরের সাথে পরামর্শ করেন। মীরজাফর কেবল তার পূর্ব-প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করেন। নবাব মীরজাফরের ইচ্ছা পূর্ণ করতে দ্বিধান্বিত হলেও শেষ পর্যন্ত তারই পরামর্শ মেনে নেন। তিনি পুনঃপুন মোহনলালকে যুদ্ধক্ষেত্র হতে ফিরে আসতে আদেশ দেন। অবশেষে মোহনলাল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শিবিরের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন।
মোহনলালের সৈন্যরা যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে অনেকটা অলস অবস'ায় ফিরছিল, তখন চতুর ক্লাইভ ষড়যন্ত্র অনুযায়ী তার সৈন্যদল নিয়ে আশ্রয়স'ল থেকে বের হয়ে আসে এবং অতর্কিতে আক্রমণ করে। হঠাৎ আক্রমণে নবাবের সৈন্যদল পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ততক্ষণে মীরজাফর তার সৈন্যসহ ক্লাইভের সাথে যোগ দেয়। ভেতরের শত্রুর এমন আচরণে হতাশ হয়ে নবাব মনের বল হারিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পরদিন সকালে মুর্শিদাবাদ পৌঁছেন। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পলাশীতে নামমাত্র যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতক ও ইংরেজদের জয় হয়।
মুর্শিদাবাদে ফিরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার সৈন্যদের একত্র করতে চেষ্টা করে সফল হননি। ক্লাইভ ও মীরজাফরকে বাধা দেয়ার কার্যকর ব্যবস'া গ্রহণ করতে না পেরে তিনি বেগম লুৎফুন্নেসা ও কন্যাকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজমহলের দিকে যাত্রা করেন। তিনি আজিমাবাদে তার নায়েব নাযিমের সাথে যোগ দিতে ইচ্ছা করেছিলেন। তার আশা ছিল আবার তিনি বাঁকঘুরে দাঁড়াবেন। কিন' রাজমহলের কাছে নবাব মীরজাফরের জামাতা মীর কাসিমের হাতে ধরা পড়েন। নবাবকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। ২ জুলাই রাতে মীরজাফরের পুত্র মীরনের আদেশে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যে মুহম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলার বাবা জৈনুদ্দীন কর্তৃক প্রতিপালিত হয়েছিল, সেই মুহম্মদী বেগই নিষ্ঠুর ঘাতকের কাজটি করেছিল।
পলাশী যুদ্ধের ফলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতার কার্যত অবসান ঘটে। ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন ক্লাইভ ও অন্যান্য ইংরেজ প্রধানেরা মীরজাফরকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসান। মীরজাফর ইংরেজদের উপঢৌকনস্বরূপ বহু অর্থ দিয়েছিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তিনি কোম্পানিকে প্রচুর টাকা ও বিশেষ বাণিজ্য সুবিধাও দান করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া তিনি কোম্পানিকে ২৪ পরগনার জমিদারি স্বত্ব দিতেও বাধ্য হন। এত সব দেয়ার বিনিময়েও মীরজাফর নামমাত্র বাংলার নবাব হন। তাকে নবাব করে ইংরেজরাই প্রকৃতপক্ষে বাংলার শাসন ও সামরিক বিষয়ে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। ইংরেজদের সুবিধার জন্যই নবাবকে যুদ্ধ বন্ধ করতে চক্রান্তমূলক পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এর ফলে নবাবের পরাজয় অনিবার্য হয়ে পড়ে। তা ছাড়া নবাব সময়োচিত দৃঢ়তার পরিচয় দেননি। মীরজাফর ও অন্য কর্মচারীদের ষড়যন্ত্রের বিষয় তিনি জানতে পেরেছিলেন; কিন' কার্যকর ব্যবস'া নিয়ে ষড়যন্ত্র গুঁড়িয়ে দিতে পারেননি। এই সময় যদি তিনি শক্ত হাতে ব্যবস'া গ্রহণ করতে পারতেন, তাহলে বাংলার ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো।
পলাশীর পরাজয়ের আরো কয়েকটি কারণ ছিল। সেই সময় বাংলাদেশে ক্ষমতার সাথে সংশ্লিষ্টদের নৈতিক অবক্ষয় ও চরিত্রের সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। কর্মচারীদের মধ্যে বিবেকহীন স্বার্থপরতা মারাত্মকভাবে দেখা দিয়েছিল। সঙ্কীর্ণ স্বার্থের জন্য তারা জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করত না। পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফর ছাড়াও খাদেম হোসেন, ইয়ার লতিফ, রহিম খান, রায়দুর্লভ, মানিকচাঁদ, নন্দকুমার এবং আরো অনেক সেনানায়ক বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ব্যবসায়ী ও জমিদারদের অনেকেই নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল, তারা বাংলার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটাতে ক্লাইভকে অন্ধভাবে সাহায্য করেছিল।
বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা- এই তিনটি সমৃদ্ধ প্রদেশ নবাবের রাজ্যভুক্ত ছিল। এই রাজ্যের শক্তি ও উন্নতির যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন' নবাবেরা এই সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে পারেননি। নৌশক্তি ছিল নামে মাত্র। সমুদ্র-উপকূলবর্তী ও নদীবহুল বাংলাদেশের জন্য নৌবহরের প্রয়োজন ছিল বেশি। ইউরোপীয় নৌশক্তি থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে বিপদ আসতে পারে সে বিষয়ে আভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল। কিন' নবাবেরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। তা ছাড়া নবাবেরা মারাঠা হামলা ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনেও ব্যস্ত ছিলেন।
পলাশী যুদ্ধের পর বাংলাদেশে কার্যত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। নামমাত্র নবাব মীরজাফর ইংরেজদের হাতের পুতুল ছিলেন। শাসনের ব্যাপারে তিনি ক্লাইভ ও কোম্পানির অন্য কর্মকর্তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে বাধ্য ছিলেন। মসনদ রক্ষার জন্য তাকে ইংরেজ সৈন্যদের ওপরই নির্ভর করতে হতো। ১৭৫৯ সালে শাহজাদা আলী গহর বা সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম যখন বিহার আক্রমণ করেন, তখন ইংরেজ সৈন্যরা মীরজাফরের রাজ্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। মীরজাফর ইংরেজদের যুক্তিহীন অনুগত ও অপমানজনক বাধ্যতায় ছিলেন বলে তাকে ‘ক্লাইভের গর্দভ’ নামে আখ্যায়িত করা হতো।
১৭৬০ সালে ক্লাইভ বিলেত চলে যান। ক্লাইভের মতো পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক হারিয়ে মীরজাফর অসহায় হয়ে পড়েন। তা ছাড়া খড়কুটো ধরে বাঁচার লক্ষ্যে ওলন্দাজদের সাথে ষড়যন্ত্র করার পর তিনি ইংরেজদের বিশ্বাস ও সমর্থন হারিয়েছিলেন। অধিকন' ইংরেজদের পুনঃপুন টাকার দাবি মেটাতে পারছিলেন না। সে জন্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ হলওয়েল ও ভেনসিটার্ট মীরজাফরকে সরিয়ে তার জামাতা মীর কাসিমকে মসনদে বসানোর পরিকল্পনা করে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭৬০ সালের অক্টোবরে মীর কাসিমকে মসনদে বসায়। নবাবীর বিনিময়ে মীর কাসিম ইংরেজ প্রধানদের বহু অর্থ উপঢৌকন দেন। তা ছাড়া বর্ধমান, মেদেনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা কোম্পানিকে দান করে দিতে বাধ্য হন।
মীর কাসিম অনেকটা স্বাধীনচেতা ছিলেন। ইংরেজ আশ্রিত অবস'া থেকে নবাবের শাসনক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন। নবাব এ সময় কয়েকজন হিন্দু কর্মচারী, জমিদার ও ব্যবসায়ীর অবাধ্যতায় বিরক্ত হয়ে ওঠেন। এ জন্য আজিমাবাদের নায়েম নাযিম রামনারায়ণ, গুপ্ত পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা রাজা মুরলী ধর এবং রাজবল্লভ, জগৎশেঠ ও অন্যদের গ্রেফতার করেন। ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে রামনারায়ণ, রাজবল্লভ, উমেদরায়, জগৎশেঠ এবং আরো কয়েকজনের প্রাণদণ্ড হয়। ইংরেজদের প্রভাব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য মীর কাসিম তার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স'ানান্তর করেন। বিলম্বিত বোধোদয়ের কারণে তিনি ইংরেজদের বিনাশুল্কে বে-আইনি ব্যবসায় নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করেন। কোম্পানির কর্মকর্তারা এর বিরোধিতা করায় তিনি সব বণিকের পণ্যদ্রব্যের ওপর হতে শুল্ক রহিত করে দেন। এই ব্যবস'ার ফলে বাণিজ্যে ইংরেজদের একচেটিয়া ও বিশেষ সুবিধা নষ্ট হয়। কারণ এর ফলে তাদের অন্য বণিকদের সাথে সমপর্যায়ে ব্যবসায়ে প্রতিযোগিতা করতে হতো। এ সব কারণে মীর কাসিমের সাথে ইংরেজদের স্বার্থের সঙ্ঘাত দেখা দেয়। ১৭৬৩ সালে ইংরেজদের সাথে তার সংঘর্ষ বেধে যায়। কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, গিরিয়া, সুতি, উদয়নালা ও মুঙ্গেরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাসিম ক্ষমতাহারা অবস'ায় অযোধ্যায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৭৬৩ সালে কোম্পানির কর্মকর্তারা দ্বিতীয়বার ক্লাইভের গর্দভ খ্যাত মীরজাফরকে বাংলার সিংহাসনে বসায়।
মীর কাসিম অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৭৬৪ সালের ২২ অক্টোবর তাদের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনীর সাথে বক্সার নামক স'ানে ইংরেজ সৈন্যদের ঘোরতর যুদ্ধ হয়। দুর্ভাগ্য, বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজেরা জয়লাভ করে। মীর কাসিম কয়েক বছর অজ্ঞাত অবস'ায় ঘুরে বেড়ান। ১৭৭৭ সালে দিল্লির কাছে এক জায়গায় তার মৃত্যু হয়। বক্সার যুদ্ধের পর ইংরেজেরা অযোধ্যাও দখল করে নেয়। সুজাউদ্দীন রোহিলাখণ্ডে আশ্রয় নেন। এমন প্রেক্ষাপটে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন।
‘স্বাধীনতার অস্তমিত সূর্য’খ্যাত মীর কাসিম বাঁক ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। তত দিনে ইংরেজেরা অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি অর্জন করে নেয়। অন্য দিকে দুর্বল সামরিক অবস'ান ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতাই মীর কাসিমের পরাজয়ের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজদের টাকার দাবি মেটাতে মীরজাফর রাজকোষ শূন্য করে ফেলেছিলেন। বহু টাকা ঋণগ্রস্ত ছিলেন। মীর কাসিমকে এই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। তা ছাড়া তিনি মসনদে বসার জন্য কোম্পানির কর্মকর্তাদের দুই লাখ পাউন্ড দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাতে রাজকোষ আরো শূন্য হয়ে পড়েছিল। এ জন্যই তার অর্থাভাব ছিল বেশুমার। অর্থাভাবের কারণে তিনি ভালোভাবে সৈন্যবাহিনী গঠন করতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, নবাবের কয়েকজন হিন্দু কর্মচারী ও জমিদার বিশ্বস্ত ছিল না। তারা ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে মেতে থাকত। জমিদারেরা নিয়মিত খাজনা দিত না। তা ছাড়া বক্সারের যুদ্ধে অযোধ্যার নবাবের মন্ত্রী মহারাজ বেণী বাহাদুর পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফর-জগৎশেঠদের মতোই বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের সাহায্য করে। সম্রাটের দিওয়ান সেতাব রায়ও কূটকৌশল অবলম্বন করে ইংরেজদের সাফল্যের পথ সহজ করে দিয়েছিল। তৃতীয়ত, মীর কাসিমের গোলন্দাজ বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা মর্কা ও আরাটোন দুইজনই আর্মেনিয়ান খ্রিষ্টান ছিল। তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশ্বস্ততার পরিচয় দেয়নি। সামরিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতায় নবাবের সৈন্যরা ইংরেজ সৈন্যদের সমান ছিল না। রণকৌশল ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল। নবাবের অনিয়ন্ত্রিত সৈন্যরা স্বভাবতই সুনিয়ন্ত্রিত ইংরেজ সৈন্যদের সাথে ভালো দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। সর্বোপরি বিশ্বাসঘাতকতা চারদিক থেকে নবাবকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছিল। তাই পলাশীর মতো বক্সারের যুদ্ধেও বিশ্বাসঘাতকতার জয় হলো, পলাশী ও বক্সারের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র সাত বছরের। যারা উৎসাহী ও অনুসন্ধিৎসু তারা আজকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও বিদেশনীতির প্রেক্ষাপটে ইতিহাসকে আরেকবার চেখে দেখতে পারেন। আড়াই শ’ বছরের পুরনো ইতিহাস যেন বর্তমানকে ঘিরে ধরেছে। সিরাজের ভুলগুলোই বর্তমান শাসকেরা করে চলেছেন। অর্থনৈতিক শোষণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক নিপীড়ন জুলুমের সীমা অতিক্রম করেছে। রাষ্ট্রে নিরাপত্তা হুমকির মুখে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার শেষ ভরসাস'লগুলোকেও নড়বড়ে করে তোলা হচ্ছে- সে দিন বিশ্বাসঘাতকেরা ইংরেজদের স্বার্থ ও নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থ দেখেছে। আমরা কি পুনরাবৃত্তি দেখার অপেক্ষায়?
View this link