somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কল্পবিজ্ঞানঃ মৃত্যু পরোয়ানা

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৮:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সকালে ঘুম থেকে উঠতেই শুনি আব্বার চিল্লাচিল্লি। ড্রয়িং রুমে বসে টেলিভিশনের চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন আর চিৎকার করে যাচ্ছেন – ‘যতো সব আলতু-ফালতু অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার’। হাতের কাছে রাখা খবরের কাগজটাও ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। সব জায়গায় এক খবর – ‘কী সব টেস্ট ফেস্ট করে মানুষ জেনে যাচ্ছে কে কবে মরবে’।

আব্বার দিকে যেতে আমার সাহস হয় না। আমি চুপেচুপে রান্নাঘরে আম্মার কাছে যাই। আম্মা এক চুলায় পরোটা ভাজছেন, অন্য চুলায় ভুনা গরুর গোশত। ঘ্রাণে আমার পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। আম্মাকে বলি, ‘আব্বা, এমন চিল্লাচিল্লি করছে কেনো? সারা দুনিয়া মেনে নিলো, আব্বারই কেবল আপত্তি’।
আম্মা শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মোছেন। বিড়বিড় করেন, কী বলেন বোঝা যায় না। আম্মার চেহারায় তাকিয়ে অনুমান করি, আম্মা বলছেন – ‘তোর আব্বা তো সারাজীবন এরকম’।
ফ্লোরে পড়ে থাকা পেপার কুড়িয়ে আমি বাথরুমে ঢুকি।

অনেকদিন আগে যেবার বাসায় ইন্টারনেট কানেকশন নিলাম, আব্বা এলেন আমার রুমে। আমি ইয়াহুতে জার্মানিতে থাকা মেঝ ভাইয়ার সাথে চ্যাট করছি। আব্বা এসে আমার পাশে বসলেন, দেখলেন – আমি টাইপ করছি – ha ha.
আব্বা জিজ্ঞেস করলেন – হা হা মানে কী?
বললাম, হাসছি।
শুনে তাঁর চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো, ‘তুই তো গম্ভীর হয়ে বসে আছিস আর টাইপ করছিস – হাসছিস কই?’
আমি আব্বাকে কী করে বোঝাই - এসব চ্যাট, এসব অনুভূতি অন্যরকম।

সেদিন কিছু না বলে চলে গেলেন। এরপর অনেকদিন আমি তাঁকে বলতে শুনলাম, ফোনে অন্য কাউকে বলছেন – ‘কী আর বলবো বলেন, মুখ গম্ভীর করে টাইপ করে আর বলে হাসছি, একটা বিশাল জেনারেশন গ্যাপ, হা হা হা’।

আব্বা এরকমই। পরিবর্তন মেনে নিতে পারেন না।

আমাদের বাসায় ডিশ সংযোগ নেয়ার পর আম্মা নিয়মিত রান্নার অনুষ্ঠান দেখে, আমার ছোটো ভাই মেহেদী কার্টুন নেটওয়ার্ক, আর আমি রিমোটের বাটন চেপে চেপে ক্রিকেট ম্যাচ খুঁজি।
আব্বা কোত্থেকে শুনে এলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে প্রকৃতির নানান আজব জিনিশ দেখায়, দূর্লভ সব নাকি ব্যাপার স্যাপার! আব্বা অফিস থেকে ফিরে টানা কয়দিন ন্যাশনাল জিওগ্রাফি দেখলেন। সপ্তাহ খানেক পরে সাত্তার মামা আমাদের বাসায় এলে আব্বা বললেন, ‘গোবরে পোকা কী খায়, এইটাও নাকি মানুষের আগ্রহের বিষয়?’

পত্রিকার প্রথম পাতা – শেষ পাতা – বিশেষ সম্পাদকীয় পড়া শেষে আমি আব্বার এসব কথা ভাবছিলাম। এই যে আজ এক মাস সব মিডিয়া তুলকালাম কান্ড করে দিচ্ছে, সামান্য একটা টেস্ট করে মানুষ জেনে যাচ্ছে সম্ভাব্য মৃত্যুর তারিখ – আব্বা এটাকে বিশ্বাস তো করছেই না, বরং পুরো ব্যাপারটিকে তুচ্ছ করে মানুষের ওপর ক্ষেপে যাচ্ছে।

আমিও প্রথমে আব্বার মতো অবিশ্বাস করতাম। কিন্তু, সেদিন বিল্লু যখন ভার্সিটির ক্যাফেতে এসে বললো– তার এক ফুপা বাইপাস সার্জারি করতে সিঙ্গাপুর যাবে, লাখ বিশেক টাকার মতো খরচ হবে। কিন্তু যাওয়ার আগে ঢাকায় ঐ ডেথ-টেস্ট করালো, দেখা গেলো বাঁচবেন আর ৯ দিন। এরপরও বিল্লুর ফুপাকে সিঙ্গাপুর নেয়া হলো, অপারেশনের আগের রাতে আবার স্ট্রোক করে মারা গেলেন। বিল্লু আঙুলের কড়ে গুনে গুনে দেখিয়ে দিলো রবিতে রবিতে আট আর পরের দিন সোমবার মিলিয়ে ৯ দিনই ছিলো। সোমবারে ফুপা মারা গিয়েছিলেন।

রাতে বাসায় ফিরে খাবার টেবিলে বিল্লুর ফুপার ঘটনা বলার সাহস আমি পাই নি। কারণ, এর আগেই আম্মা বলছিলেন, আমারদের বাসার তিন ব্লক পরে লুৎফর কাকার মামা শ্বশুর এ টেস্ট করেছিলেন, টেস্টে দেখা গেছে বাঁচবেন আর ৬ দিন। পুরোদস্তুর সুস্থ মানুষটি ঠিক ৬ দিনের মাথায় বাজার করে ফেরার পরে রিকশার ঝাঁকুনিতে রাস্তায় পড়ে গেলেন। হাসপাতালে নেয়ার পর – ডাক্তার বললো, ব্রেইন হ্যামারেজ।

আম্মার কথা আব্বা মন দিয়ে শুনলেন, আম্মাকে বললেন – ‘কাল সকালে বের হয়ে সব ক’টা টিভি চ্যানেলে যাবে, রিপোর্টারের কাজ খুঁজবে, আর কোন বাসায় কী হলো সেসব লাইভ টেলিকাস্ট করবে’।
আব্বার এরকম প্রতিক্রিয়ায় আম্মা চুপ মেরে গেলেন। আব্বা বলেই যাচ্ছেন –
‘...ঘুরে ঘুরে পশ্চিম পাইকপাড়ায় যাবে, বের করবে কার বাসার তরকারী পুড়ে গেছে। ঐটা রেকর্ড করে রাস্তায় দাঁড়াবে, বলবে – পশ্চিম পাইকপাড়ায় অমুক বাসার তরকারী পোড়া তীব্র গন্ধে জনজীবন স্থবির, অনিতিবিলম্বে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে অবস্থা স্বাভাবিক করার দাবী জানিয়েছে এলাকাবাসী, নূরজাহান বেগম, একুশে টেলিভিশন, পশ্চিম পাইকপাড়া’।

আম্মা চুপ, আমিও চুপ। আব্বা আর কথা না বলে - ভাত খাওয়া শেষ করলেন। বিল্লুর ফুপার ঘটনাটি তাই সে রাতে আর বলা হয়নি।



“টানা তিনদিনে তিনটা ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে আসে। মনে হয় – কতো রাত ঘুমাইনি। বাসায় বলে রেখেছিলাম, ১৮ ডিসেম্বর আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে দরজার হুক বন্ধ করে একটানা ঘুম দেবো, কেউ যেনো আমাকে এই তিনদিন না ডাকে, আমাকে যেনো খাবারের জন্যও না ডাকা হয়।

তাই আজ সব ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে বিল্লুরা যখন রাঙ্গামাটি যাচ্ছে, তখন আমি বাসায় ফিরি। কলিংবেল চাপতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা। আমি ভেতরে পা দিতেই আম্মা এসে আমাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। আম্মার কান্নায় যতো না অবাক হই, তারচেয়ে বেশি অবাক হই যখন দেখি সোফায় সুমনা বসা। আমাদের বাসায় ও আগে কখনো আসেনি, ওর কথা আমার বাসায় জানাইনি এখনো।
আমি সুমনার দিকে তাকাই, আম্মা আমাকে ছাড়ছে না। শক্ত করে জড়িয়ে হাউমাউ কান্না বেড়েই চলেছে।

এবার সুমনা এসে যোগ দেয়। তার আগে আমার হাতে দেয় একটি সাদা খাম। খুলে দেখি – আমার ডেথ-টেস্ট রিপোর্ট। ভুলে গিয়েছিলাম দু’সপ্তাহ আগে সুমনার জোড়াজুড়িতে টেস্টে গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখি – আজই আমার মারা যাওয়ার কথা, স্পষ্ট লেখা এ বছরের তারিখ, আজই – আজ ১৮ ডিসেম্বর। জানি না কেনো, আমার অদ্ভুত ভালো লাগে। আমার হাসি পায়। আম্মা আর সুমনাকে সরিয়ে আমি আমার রুমে চলে আসি। দরজার হুক লাগিয়ে বলি – “আমি ৩ দিন ঘুমাবো, কেউ যেন আমাকে না ডাকে”।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৫ রাত ১০:২৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×