'থিয়েট্রিক্যাল রক ব্যান্ড' শব্দটাই প্রথম শুনি ২০১০ এর শেষের দিকে, শহরতলী ব্যান্ডটাকে নিয়ে করা একটা পত্রিকার ফিচারে, ব্যান্ডটির প্রথম অ্যালবাম 'বরাবর শহরতলী' রিলিজ হওয়ার পরপরই। আমি 'থিয়েট্রিক্যাল ব্যান্ড' বলতে ঠিক কী বোঝায় তখন জানতাম না। 'বরাবর শহরতলী' শুনলাম। খুব আহামরি কিছু না। তবে গানের আয়োজনে প্রচন্ড রকম বৈচিত্র। সঙ্গীতায়োজনে নতুনত্ব। গানের মধ্যেই কথোপকথন, গীতিকবিতা, আবৃত্তি। এককথায় প্রথাগত ব্যান্ডগুলো থেকে পুরোপুরি ভিন্ন স্বাদ। এরকম ভিন্নতা নিয়ে মাঝেমধ্যেই কিছু ব্যান্ড আসে। একটা দু'টো ভালো গান উপহার দিয়ে আবার হারিয়েও যায়। তাই এতটা গুরুত্ব দিয়ে আর খোঁজখবর রাখা হয়নি। পরে ব্যান্ড সদস্য এবং ভোকালিস্ট মিশুর একটা সাক্ষাৎকারে জেনেছিলাম 'থিয়েট্রিক্যাল' শব্দের ব্যাখ্যাটা। অনেকটা এরকম, থিয়েটারে যেমন নাচ, গান, অভিনয়, কবিতা দিয়ে সবকিছুকে একই বিন্দুতে এনে একটা আলাদা আবহ সৃষ্টি করা হয়, শহরতলী ব্যান্ডও অনেকটা তাই। গানের মধ্যে থেকেই সাথে গীতি কবিতা, কথোপকথন, আবৃত্তি যোগ করে আলাদা একটা আবহ সৃষ্টির চেষ্টা করে ব্যান্ডটি।
শহরতলীর প্রথম কাজ ছিলো সম্ভবত: 'নিয়ন আলোয় স্বাগতম' অ্যালবামে 'আসাদের খোলা চিঠি'। ২০০৭ এর এই দারুন কাজটা শুনেছি গত বছর। ব্যান্ড মিক্স অ্যালবামে 'ফেলানি' গানটি প্রচন্ড মুগ্ধ করার পর আর বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরই গুগলে শহরতলীর যাবতীয় কাজ খুঁজে প্রথম অ্যালবামের বাইরে মাত্র ওই একটা কাজই পাই। তিন বছর পর আরেক ডিসেম্বরেই এসেছে শহরতলীর দ্বিতীয় অ্যালবাম 'অপর পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য'। ভালো লাগার ব্যাপারটা পুরোটাই আপেক্ষিক জেনেই লিখছি, এটাই ২০১৩ এর সেরা ব্যান্ড অ্যালবাম। এই অ্যালবামও থিয়েট্রিক্যাল। গানের মধ্যেই চারটা কবিতা আছে; সলিল চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুন, পুর্ণেন্দু পত্রী আর ব্যান্ডেরই পারফরমিং ভোকাল সোহাগের। দু'টো গানে সংলাপ ব্যবহৃত হয়েছে। বাকি চারটা প্রথাগত রক আর মেলো রক।
পুর্ণেন্দু পত্রীর কবিতাকে গীতি কবিতায় রূপ দিয়ে অসাধারণ একটা সূচনা অ্যালবামের, 'মুখবন্ধ' শিরোনামে। 'বাঁধন' শিরোনামের গানটিতে নির্মলেন্দু গুনের 'তোমার বন্ধন' কবিতার গীতিরূপ দেওয়া হয়েছে। 'গণ জোয়ার' নিয়ে একটা গান আছে। শাহবাগ, শাহবাগের সব শ্লোগানের গীতিরূপই শুধু উঠে আসেনি গানটাতে, একই সাথে উঠে এসেছে জনপ্রিয়তা রক্ষার এই যুগে দাঁড়িপাল্লার দুই প্রান্ত ঠিক রেখে চলার নষ্ট সময়ে স্বাধীনতার পক্ষে ব্যান্ডটার পরিষ্কার অবস্থান। অ্যালবামে আছে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটের গান 'দেশমাতার কাছে চিঠি'। আছে হাহাকার, আর্তনাদ, বেদনা আর আর্তি এক করা একটা গান, 'মা'। 'আহবান' গানটাতে সলিল চৌধুরীর 'শপথ' কবিতার গীতিরূপের সাথে চে গুয়েভারারা কিছু সংলাপ, শপথ আর দ্রোহের মন্ত্র। মিশুর গায়কী আর সোহাগের আবৃত্তিতে গানগুলো এককথায় অসাধারণ। সাথে সানি'র ড্রাম, তপনের বেস গিটার, সৌরভের লিড গিটার, রূপমের কী-বোর্ড আর পিয়ানোতে মনোমুগ্ধকর সংগীতায়োজন। যাত্রী, মেঘদলের পর মাত্র কয়েকটা গান দিয়েই 'প্রিয়' বলার মত আরেকটা ব্যান্ড যোগ হলো।
শেষের আগে 'দেশমাতার কাছে চিঠি'র কয়েকটা লাইন শেয়ার করি, 'মা, নয়মাসের অবিচল ধৈর্য, উত্তাল বেদনার পরই তো তুমি না। শৈশবে যে শিশু উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতো, যৌবনে প্রাচুর্যের মোহে সে লাগামহীন টাট্টু ঘোড়া। বেয়াড়াপনা তার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। দু' দশক আগেও এটাকে বোধহয় দুষ্টুমি বলা যেত। কিন্তু এখন, কিন্তু এখন নষ্টামি বলা ছাড়া আর গতি দেখছি না। তোমার প্রসব বেদনার ক'বছর আগে যে ধ্বণী বা বর্ণমালার জন্য জীবন হারিয়ে শহীদ পেলাম, সেই সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের রক্তভেজা শার্ট জাদুঘরে না থেকে ওই শার্টের একটা সুতাও যদি আমার হৃদয়ে থাকতো তাহলে বুলিতে যে মিথ্যা আর ঝুলিতে যে পাপ তার সাধ কিছুটা হলেও মোচন হতো'।
এই আটপৌড়ে শহর, পথ ভেঙে চলা আটশো সাতাশ প্রজাতির মানুষ, ফ্যাকাশে আবেগ-অনুভূতির ঢেউ, বেরসিক জ্যাম, লোড শেডিং, কানে তালা লাগা গাড়ির হর্ণ, ভাজকরা বাদামের ঠোঙা, প্রেমিকার কড়ে আঙুল আর রাতভোরের গান গেয়ে চলতে থাকুক প্রিয় 'শহরতলী'। আর নতুন বছরে প্রিয় মানুষেরা পৃষ্ঠা উল্টাক। তাদের জন্যে কেনা উপহারে যোগ হোক 'অপর পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য'।
শহরতলী'র দ্বিতীয় অ্যালবাম 'অপর পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য': ২০১৩ সালের সেরা ব্যান্ড অ্যালবাম।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?
মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়
প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)
সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন
যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।
আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন
তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?
আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন