দশ-পনেরোটা সিনেমা বানিয়েছেন। তার বেশিরভাগই দেখে ফেলেছি। ব্যোমকেশ ফ্রাঞ্জাইজির গুলো বাদ দিলে তার চলচ্চিত্রে বড় ধরণের কোন সংযোজন চোখে পড়েনি আমার। চার-পাঁচ মিনিটের এক-একটা গানে যে বিশাল ক্যানভাসে গল্প, গল্পের পেছনের গল্প বলে গেছেন তার সিকিভাগও আড়াই-তিন ঘন্টার সিনেমাগুলোতে আনতে পারেননি। কমবেশি আর দশটা সিনেমার মতই সেগুলো। অভিনেতা হিসেবে লোকটা, আমার ধারণা, আরো সাধারণ। অথবা তার অসাধারণত্ব সমকালীন বাংলা সিনেমায় স্যুট করেনি। গানগুলো শোনার পর কখনো অভিনয় না করলে ভেবে নিতাম- গানে যে অবিশ্বাস্য ক্রিয়েটিভ লোকটা তাতে অভিনয় করলে নিশ্চয়ই সৌমিত্র লেভেলের কেউ হতেন। তা না হলেও সব্যসাচী-ঋত্বিক লেভেলের। নিদেনপক্ষে পরিচালক-অভিনেতা আদলের ঋতুপর্ণ ঘোষ-কৌশিক গাঙ্গুলির মত কেউ। হয়ে ওঠা হয়নি। সিনেমাতে একটা আলাদা ধারা, যেটা আমার কাছে খানিক 'কনফিউজিং' ঘরানার, তৈরি করতে যেয়ে হয়তো কিছুই হয়ে ওঠা হয়নি। 'মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার', 'চিত্রাঙ্গদা', 'নির্বাক' টাইপের বেশ কিছু ভালো সিনেমায় ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করেছেন। চলে। নামজাদা কিছু পরিচালকের সাথেও। কিন্তু একজন অভিনেতাকে চেনাতে যতটা ব্যাপ্তির দরকার পড়ে, ততটা স্পেস সিনেমাগুলোতে পাননি। সেসব পূরণ করতে কী-না জানিনা, নিজের পরিচালিত যেসব সিনেমায় নিজেই মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেগুলোতে নিজের চরিত্র এতই প্রাধাণ্য দেওয়া, অস্বীকার করার কিছু নেই, আমার বেশরকম বিরক্তি তৈরি হয়েছে! অথচ লোকটা মনেপ্রাণে অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন। একটা ছাপ রাখতে চেয়েছিলেন সিনেমায়। নিজেই বলেছেন, 'জীবনে যা হতে চেয়েছি, তা হতে পারিনি। সত্যি এ জীবনে আমি ভালো অভিনেতা হতে চেয়েছি। কিন্তু তা হতে পারিনি।’
সিনেমায় 'ব্যর্থ' হয়েই গানে আসা। শেষ বয়সে এসে নিজের কথা-নিজের সুরের একঘেয়েমি কাটাতে বড় ধরণের বিরতি নিয়ে উনষাটে এসে বা তার পর অন্যদের সুরে যেসব গান করলেন- তার বেশিরভাগ তার স্ট্যান্ডার্ডে স্রেফ বস্তাপঁচা বলা যায়। কিন্তু যে অঞ্জন দত্তকে কখনো উপেক্ষা করা যায় না, ভিতর থেকে তার জন্যে অবিশ্বাস্য রকম একটা টান তৈরি হয়, কিঞ্চিৎ আপনজন অনুভূত হয়, আর ঘোর লাগা কাটে না- সেটা গত কয়েক বছর বাদে তার বাকি সময়ের গানগুলোর জন্যে। সমুদ্র থেকে নুড়ি কুড়ানোর মত কুড়িয়ে আনা কয়েকগুচ্ছ নস্টালজিয়া। ছেলেবেলা, বোর্ডিং স্কুল, স্ট্রাগল, বড় হওয়া, প্রেম, গিটার মিলেমিশে একাকার। এখানে সেখানে বলা চক্ষুলজ্জাহীন, লুকোছাপাহীন, রগরগে, অকপট কথাগুলো।
অভিনেতা, পরিচালক অঞ্জনকে নিয়ে বলার কারণ তৈরিই করেছে তার গানের সাথে তীব্র সংযোগ। কতশত বাংলা ক্ল্যাসিক সিনেমাই দেখা হয়ে ওঠেনি, অথচ গানের কারণে অঞ্জনের প্রায় সবই দেখে ফেলেছি। কোনো অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন, কোনো কনসার্টে বা টিভি শোতে গিয়েছেন জানতে পারলে ইউটিউবে খুঁজতে শুরু করেছি। বুঝিনি সবসময় জিন্স, কালো চশমা পরা ফ্রেন্স কাটের কাঠখোট্টা দর্শনের লোকটা আমার এতখানি আপনজন বনে গেছেন। একবার ফোন হ্যাং হয়ে যাচ্ছিলো কয়েকদিন পরপর। ফোন খালি করতে পিসিতে ব্যাক আপ রেখে গ্যালারি শুদ্ধ ফেলে দিয়েছিলাম। তাও অঞ্জনের গানগুলো ফেলতে পারিনি। ওগুলোতে আমার ক্যাসেটে ফিতে আটকে ছিঁড়ে যাবার পর কান্না চলে আসা ছেলেবেলা। আর বড় হতে থাকা। বাপি রবীন্দ্রনাথ শুনতো, হেমন্তের গলায়। মা গাইতো। কিন্তু আমাকে ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ টানেনি। রবীন্দ্রনাথ এখনও আমার আপনজন হতে পারেননি।
অঞ্জন আমার কাছে বেলা বোস, জয়িতা, রঞ্জনা, রমা, জেরিমি, মেরি অ্যান, স্যামসন, মিসেস মুখার্জি, নীলা, রুবিনা, রাজা রায়, হরিপদ, দেবলীনা, আলীবাবা, মিস্টার হল। অথবা কাঞ্চনজঙ্ঘা, পুরানো গিটার, বৃষ্টি, চ্যাপ্টা গোলাপ, রং পেন্সিল। অথবা, অদ্ভুত ভালো লোকটা। তুমি আসবে বলে। তুমি না থাকলে। তেমন মেটাফোর নেই। জটিল কাব্য নেই। তাল লয়ে জটিলতা নেই। সরল ব্যঞ্জনায় পাশের একজন হয়ে আমাদের আশপাশ থেকে চরিত্র তৈরি করা। প্রেম, বিরহ আর জীবনের গল্প বলা। ইনফ্যাচুয়েশন। বড় হতে হতে মনোজগত বদলাতে থাকে। মেঘদল ভালো লাগতে থাকে, রবীন্দ্রনাথের লাইনের মানে পরিষ্কার হতে থাকে কিন্তু কিশোর বয়স থেকে ইল্যুশন তৈরি করা অঞ্জন অবচেতন কোনো অজুহাতেই বিচ্যুত হন না; বরং আরো লেপটে থাকেন।
অন্য যে কারো গানের দু'একটা লিরিক লেখা যায়। অঞ্জনের ক্ষেত্রে সেটা বেশ কঠিন। পুরো গানই আস্ত একটা ক্যানভাস। বিশাল তার পরিসর। চলচ্চিত্র থেকে বড় হলে এখন টিভি সিরিজ বানানো হয়। অঞ্জনের গান আকারে-আয়তনে তার থেকেও বড়সড় লাগে। রঞ্জনায় ধর্মকে উপেক্ষা করে প্রেম। সারা পৃথিবীর ইন্টাররিলিজিয়াস প্রেমকে তুড়ি মেরে বলে ফেলা- 'ধর্ম আমার আমি নিজে বেছে নেইনি পদবীতে ছিলো না যে হাত'। বেলা বোসের বেলায় বেকারত্বের অভিশাপ। 'আর কিছু দিন তারপর বেলা মুক্তি /কসবার ঐ নীল দেয়ালের ঘর /সাদাকালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে /তোমার আমার লাল-নীল সংসার'। চ্যাপ্টা গোলাপের দাম্পত্যের সঙ্গা না বোঝা স্কুল জীবনের বাধনহীন প্রেম। ক্যালসিয়ামের নিয়ম ভাঙার গান- 'দুপুর বলছে কান্না পেলে /ছাদে উঠে গিয়ে /সবাই যা বলছে ভুলে যা'। তুমি না থাকলেতে- 'মেঘ করে যেত বৃষ্টি হতো না'। তুমি আসবে বলেতে- 'আমার বয়স বাড়ে আমি বাড়ি না'। ডাক্তার লেন, ১০৪ এর কোনোমতে টিকে থাকা সংসারের জয়িতা। দু'টো মানুষের টেবিল ল্যাম্পের আধো অন্ধকারে মুখ ফুটে কিছুই না বলা। 'লাল রঙের কাক, নীল রঙের কোকিল' এর রঙ পেন্সিল। সাদামাটা ছোটখাটো হরিপদ। 'ছোট্ট বেলার প্রেম, আমার কালো মেম' মেরি এ্যান। রাজা রায়ের একটা ব্রেক, একটা চান্স। বিস্তর ফারাকের, চোখের ভুলের দেবলীনা। বৃষ্টির 'চারটি দেয়াল মানেই নয়তো ঘর'। মান্না দে'র কফি হাউজের মত করে সস্তা দাস কেবিন। যাচ্ছে চলের- 'যাচ্ছে না এড়ানো শেষ শুয়ে পড়াটা, যাচ্ছে না থামানো শেষ কাঁধে চড়াটা'। জামার মাপ জানা, মনের খবর না রাখা মিসেস মুখার্জি, মিসেস সেন। 'ওরে মানুষ যখন আছে তখন হাতও জুটে যায়'। মা'কে চিঠি লিখে নিজের সংসার করতে ঘর ছাড়া রমা। পনেরোতে আটকে যাওয়া বয়সে সাবিনাকে তোমাকে চাই বলার ভয়। হুট করে ভালোলেগে ভালোবেসে কাউকে তাড়াহুড়া করে লেখা গান আর জীবনে প্রথমবার ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়া পুরোনো গিটার। মনের মাথার ক্ষিধেটা মিটিয়ে গান গেয়ে কথায় সুরে কাছে আসার চেষ্টা। আর মাঝে মাঝে লোডশেডিংয়ের রাতে বেজে ওঠা জেরেমির বেহালা।
বাংলা গানে কবিতায় পাহাড় ততটা খুঁজে পাই না, যতটা থাকে সমুদ্র। হয়তো সমুদ্র ফ্যান্টাসাইজড করে বেশি। নজরুল খানিক ব্যতিক্রম। দুর্গম, দুস্তর, বন্ধুর পাহাড় পর্বতের বেশরকম আবির্ভাব আছে কবিতায়। তা অবশ্য ইরান-তুরানের অজানা অচেনা পাহাড়। জন ডেনভার নাকি পাহাড় ফ্যানাটিক ছিলেন। গানে। অন্য ভাষার গান শুনতে গেলে আমার মর্মোদঘাটন করতে করতে গানটাই ঠিক শোনা হয়ে ওঠে না। আর আমার অঞ্জন দত্ত। পাহাড়ের দ্যুত। চেনা পাহাড়ের। পাহাড়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্ব্যাস্যাডর, পাহাড় প্রোমোটর। বান্দরবন-রাঙামাটি শুনলে আমার মনে অঞ্জন আসে, সাজেক শুনলে অঞ্জন আসে। কতগুলো গানে দার্জিলিং! ক্যালিংপঙ। 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' আমার প্রিয়তম গানগুলোর একটা। দুর্দান্ত অক্সিমোরোন গানটার। 'রাত্তির নেমে এলে তিনশো বছরের সিমেন্টের জঙ্গলে /ফিরে চলে যাই সেই পাহাড়ি বস্তির কাঞ্চনের কোলে'।
অঞ্জন আক্ষেপ, আফসোস, হতাশা, বিরহকে গল্পের নির্যাসে মনোটোনাস সুরে ঢেলে দিয়েছেন৷ প্রতিটা চরিত্র হয়ে উঠেছে আপনজন। পাশের বাড়ির কেউ। বা নিজেই। এই যে আজ ১২ই মে। প্রেমিকা হারানো প্রেমিকের প্রলাপও ফিরে এসেছে অঞ্জনের হাত ধরে- 'আজ বারোই মে তাই সকাল থেকে /জন্মদিনের তোড়া তোড়া ফুল'। বা- 'তোমার সাজানো শরীরের ভেতরে /মালা, তুমি কার?'
গানওয়ালা, ও গানওয়ালা, গান থামিও না।
দশ-পনেরোটা সিনেমা বানিয়েছেন। তার বেশিরভাগই দেখে ফেলেছি। ব্যোমকেশ ফ্রাঞ্জাইজির গুলো বাদ দিলে তার চলচ্চিত্রে বড় ধরণের কোন সংযোজন চোখে পড়েনি আমার। চার-পাঁচ মিনিটের এক-একটা গানে যে বিশাল ক্যানভাসে গল্প, গল্পের পেছনের গল্প বলে গেছেন তার সিকিভাগও আড়াই-তিন ঘন্টার সিনেমাগুলোতে আনতে পারেননি। কমবেশি আর দশটা সিনেমার মতই সেগুলো। অভিনেতা হিসেবে লোকটা, আমার ধারণা, আরো সাধারণ। অথবা তার অসাধারণত্ব সমকালীন বাংলা সিনেমায় স্যুট করেনি। গানগুলো শোনার পর কখনো অভিনয় না করলে ভেবে নিতাম- গানে যে অবিশ্বাস্য ক্রিয়েটিভ লোকটা তাতে অভিনয় করলে নিশ্চয়ই সৌমিত্র লেভেলের কেউ হতেন। তা না হলেও সব্যসাচী-ঋত্বিক লেভেলের। নিদেনপক্ষে পরিচালক-অভিনেতা আদলের ঋতুপর্ণ ঘোষ-কৌশিক গাঙ্গুলির মত কেউ। হয়ে ওঠা হয়নি। সিনেমাতে একটা আলাদা ধারা, যেটা আমার কাছে খানিক 'কনফিউজিং' ঘরানার, তৈরি করতে যেয়ে হয়তো কিছুই হয়ে ওঠা হয়নি। 'মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার', 'চিত্রাঙ্গদা', 'নির্বাক' টাইপের বেশ কিছু ভালো সিনেমায় ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করেছেন। চলে। নামজাদা কিছু পরিচালকের সাথেও। কিন্তু একজন অভিনেতাকে চেনাতে যতটা ব্যাপ্তির দরকার পড়ে, ততটা স্পেস সিনেমাগুলোতে পাননি। সেসব পূরণ করতে কী-না জানিনা, নিজের পরিচালিত যেসব সিনেমায় নিজেই মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেগুলোতে নিজের চরিত্র এতই প্রাধাণ্য দেওয়া, অস্বীকার করার কিছু নেই, আমার বেশরকম বিরক্তি তৈরি হয়েছে! অথচ লোকটা মনেপ্রাণে অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন। একটা ছাপ রাখতে চেয়েছিলেন সিনেমায়। নিজেই বলেছেন, 'জীবনে যা হতে চেয়েছি, তা হতে পারিনি। সত্যি এ জীবনে আমি ভালো অভিনেতা হতে চেয়েছি। কিন্তু তা হতে পারিনি।’
সিনেমায় 'ব্যর্থ' হয়েই গানে আসা। শেষ বয়সে এসে নিজের কথা-নিজের সুরের একঘেয়েমি কাটাতে বড় ধরণের বিরতি নিয়ে উনষাটে এসে বা তার পর অন্যদের সুরে যেসব গান করলেন- তার বেশিরভাগ তার স্ট্যান্ডার্ডে স্রেফ বস্তাপঁচা বলা যায়। কিন্তু যে অঞ্জন দত্তকে কখনো উপেক্ষা করা যায় না, ভিতর থেকে তার জন্যে অবিশ্বাস্য রকম একটা টান তৈরি হয়, কিঞ্চিৎ আপনজন অনুভূত হয়, আর ঘোর লাগা কাটে না- সেটা গত কয়েক বছর বাদে তার বাকি সময়ের গানগুলোর জন্যে। সমুদ্র থেকে নুড়ি কুড়ানোর মত কুড়িয়ে আনা কয়েকগুচ্ছ নস্টালজিয়া। ছেলেবেলা, বোর্ডিং স্কুল, স্ট্রাগল, বড় হওয়া, প্রেম, গিটার মিলেমিশে একাকার। এখানে সেখানে বলা চক্ষুলজ্জাহীন, লুকোছাপাহীন, রগরগে, অকপট কথাগুলো।
অভিনেতা, পরিচালক অঞ্জনকে নিয়ে বলার কারণ তৈরিই করেছে তার গানের সাথে তীব্র সংযোগ। কতশত বাংলা ক্ল্যাসিক সিনেমাই দেখা হয়ে ওঠেনি, অথচ গানের কারণে অঞ্জনের প্রায় সবই দেখে ফেলেছি। কোনো অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন, কোনো কনসার্টে বা টিভি শোতে গিয়েছেন জানতে পারলে ইউটিউবে খুঁজতে শুরু করেছি। বুঝিনি সবসময় জিন্স, কালো চশমা পরা ফ্রেন্স কাটের কাঠখোট্টা দর্শনের লোকটা আমার এতখানি আপনজন বনে গেছেন। একবার ফোন হ্যাং হয়ে যাচ্ছিলো কয়েকদিন পরপর। ফোন খালি করতে পিসিতে ব্যাক আপ রেখে গ্যালারি শুদ্ধ ফেলে দিয়েছিলাম। তাও অঞ্জনের গানগুলো ফেলতে পারিনি। ওগুলোতে আমার ক্যাসেটে ফিতে আটকে ছিঁড়ে যাবার পর কান্না চলে আসা ছেলেবেলা। আর বড় হতে থাকা। বাপি রবীন্দ্রনাথ শুনতো, হেমন্তের গলায়। মা গাইতো। কিন্তু আমাকে ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ টানেনি। রবীন্দ্রনাথ এখনও আমার আপনজন হতে পারেননি।
অঞ্জন আমার কাছে বেলা বোস, জয়িতা, রঞ্জনা, রমা, জেরিমি, মেরি অ্যান, স্যামসন, মিসেস মুখার্জি, নীলা, রুবিনা, রাজা রায়, হরিপদ, দেবলীনা, আলীবাবা, মিস্টার হল। অথবা কাঞ্চনজঙ্ঘা, পুরানো গিটার, বৃষ্টি, চ্যাপ্টা গোলাপ, রং পেন্সিল। অথবা, অদ্ভুত ভালো লোকটা। তুমি আসবে বলে। তুমি না থাকলে। তেমন মেটাফোর নেই। জটিল কাব্য নেই। তাল লয়ে জটিলতা নেই। সরল ব্যঞ্জনায় পাশের একজন হয়ে আমাদের আশপাশ থেকে চরিত্র তৈরি করা। প্রেম, বিরহ আর জীবনের গল্প বলা। ইনফ্যাচুয়েশন। বড় হতে হতে মনোজগত বদলাতে থাকে। মেঘদল ভালো লাগতে থাকে, রবীন্দ্রনাথের লাইনের মানে পরিষ্কার হতে থাকে কিন্তু কিশোর বয়স থেকে ইল্যুশন তৈরি করা অঞ্জন অবচেতন কোনো অজুহাতেই বিচ্যুত হন না; বরং আরো লেপটে থাকেন।
অন্য যে কারো গানের দু'একটা লিরিক লেখা যায়। অঞ্জনের ক্ষেত্রে সেটা বেশ কঠিন। পুরো গানই আস্ত একটা ক্যানভাস। বিশাল তার পরিসর। চলচ্চিত্র থেকে বড় হলে এখন টিভি সিরিজ বানানো হয়। অঞ্জনের গান আকারে-আয়তনে তার থেকেও বড়সড় লাগে। রঞ্জনায় ধর্মকে উপেক্ষা করে প্রেম। সারা পৃথিবীর ইন্টাররিলিজিয়াস প্রেমকে তুড়ি মেরে বলে ফেলা- 'ধর্ম আমার আমি নিজে বেছে নেইনি পদবীতে ছিলো না যে হাত'। বেলা বোসের বেলায় বেকারত্বের অভিশাপ। 'আর কিছু দিন তারপর বেলা মুক্তি /কসবার ঐ নীল দেয়ালের ঘর /সাদাকালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে /তোমার আমার লাল-নীল সংসার'। চ্যাপ্টা গোলাপের দাম্পত্যের সঙ্গা না বোঝা স্কুল জীবনের বাধনহীন প্রেম। ক্যালসিয়ামের নিয়ম ভাঙার গান- 'দুপুর বলছে কান্না পেলে /ছাদে উঠে গিয়ে /সবাই যা বলছে ভুলে যা'। তুমি না থাকলেতে- 'মেঘ করে যেত বৃষ্টি হতো না'। তুমি আসবে বলেতে- 'আমার বয়স বাড়ে আমি বাড়ি না'। ডাক্তার লেন, ১০৪ এর কোনোমতে টিকে থাকা সংসারের জয়িতা। দু'টো মানুষের টেবিল ল্যাম্পের আধো অন্ধকারে মুখ ফুটে কিছুই না বলা। 'লাল রঙের কাক, নীল রঙের কোকিল' এর রঙ পেন্সিল। সাদামাটা ছোটখাটো হরিপদ। 'ছোট্ট বেলার প্রেম, আমার কালো মেম' মেরি এ্যান। রাজা রায়ের একটা ব্রেক, একটা চান্স। বিস্তর ফারাকের, চোখের ভুলের দেবলীনা। বৃষ্টির 'চারটি দেয়াল মানেই নয়তো ঘর'। মান্না দে'র কফি হাউজের মত করে সস্তা দাস কেবিন। যাচ্ছে চলের- 'যাচ্ছে না এড়ানো শেষ শুয়ে পড়াটা, যাচ্ছে না থামানো শেষ কাঁধে চড়াটা'। জামার মাপ জানা, মনের খবর না রাখা মিসেস মুখার্জি, মিসেস সেন। 'ওরে মানুষ যখন আছে তখন হাতও জুটে যায়'। মা'কে চিঠি লিখে নিজের সংসার করতে ঘর ছাড়া রমা। পনেরোতে আটকে যাওয়া বয়সে সাবিনাকে তোমাকে চাই বলার ভয়। হুট করে ভালোলেগে ভালোবেসে কাউকে তাড়াহুড়া করে লেখা গান আর জীবনে প্রথমবার ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়া পুরোনো গিটার। মনের মাথার ক্ষিধেটা মিটিয়ে গান গেয়ে কথায় সুরে কাছে আসার চেষ্টা। আর মাঝে মাঝে লোডশেডিংয়ের রাতে বেজে ওঠা জেরেমির বেহালা।
বাংলা গানে কবিতায় পাহাড় ততটা খুঁজে পাই না, যতটা থাকে সমুদ্র। হয়তো সমুদ্র ফ্যান্টাসাইজড করে বেশি। নজরুল খানিক ব্যতিক্রম। দুর্গম, দুস্তর, বন্ধুর পাহাড় পর্বতের বেশরকম আবির্ভাব আছে কবিতায়। তা অবশ্য ইরান-তুরানের অজানা অচেনা পাহাড়। জন ডেনভার নাকি পাহাড় ফ্যানাটিক ছিলেন। গানে। অন্য ভাষার গান শুনতে গেলে আমার মর্মোদঘাটন করতে করতে গানটাই ঠিক শোনা হয়ে ওঠে না। আর আমার অঞ্জন দত্ত। পাহাড়ের দ্যুত। চেনা পাহাড়ের। পাহাড়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্ব্যাস্যাডর, পাহাড় প্রোমোটর। বান্দরবন-রাঙামাটি শুনলে আমার মনে অঞ্জন আসে, সাজেক শুনলে অঞ্জন আসে। কতগুলো গানে দার্জিলিং! ক্যালিংপঙ। 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' আমার প্রিয়তম গানগুলোর একটা। দুর্দান্ত অক্সিমোরোন গানটার। 'রাত্তির নেমে এলে তিনশো বছরের সিমেন্টের জঙ্গলে /ফিরে চলে যাই সেই পাহাড়ি বস্তির কাঞ্চনের কোলে'।
অঞ্জন আক্ষেপ, আফসোস, হতাশা, বিরহকে গল্পের নির্যাসে মনোটোনাস সুরে ঢেলে দিয়েছেন৷ প্রতিটা চরিত্র হয়ে উঠেছে আপনজন। পাশের বাড়ির কেউ। বা নিজেই। এই যে আজ ১২ই মে। প্রেমিকা হারানো প্রেমিকের প্রলাপও ফিরে এসেছে অঞ্জনের হাত ধরে- 'আজ বারোই মে তাই সকাল থেকে /জন্মদিনের তোড়া তোড়া ফুল'। বা- 'তোমার সাজানো শরীরের ভেতরে /মালা, তুমি কার?'
গানওয়ালা, ও গানওয়ালা, গান থামিও না।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০২০ সকাল ৮:১৮