somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশে উনিশতমঃ ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন

২৬ শে জুন, ২০২০ রাত ৯:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফাইনালে গোল করে এগিয়ে যাবার পরেও মরেনোর পাগলামিতে একটুর জন্যে ইউরোপা হাতছাড়া হয়েছিলো। ২০১৬। ক্লপ তখন মাত্রই দায়িত্ব নিয়েছে। নিয়ে ইন্টারভিউয়ে বলেছে, 'If we sit here in four years I think we'll have won one title. I'm pretty sure'. এক বছর সময় নিলো দল গোছাতে। লিগ কাপের ফাইনাল হারলো ম্যান সিটির কাছে পেনাল্টিতে। তার পরের বছরই চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল। কিয়েভ, ইউক্রেন। ম্যাচের শুরুতেই সালাহর হাত ভেঙে গেলো। সেটা ইচ্ছাকৃত না দুর্ঘটনা- সেই বিতর্কের সময় এটা না। হাত ভাঙা তাও নিয়তি ধরে নিয়েছিলাম, ক্যারিউস ভাঙলো মন! আমি মোটামুটি নিশ্চিত, চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে এত বাজে গোলকিপিংয়ের ইতিহাস আর নেই। সম্ভবত ভবিষ্যতে হওয়ার ন্যুনতম সম্ভাবনাটাও নেই! সেদিন ডর্টমুন্ড-লিভারপুল হয়ে ক্লপ হেরে গেলো টানা ছয়টা ফাইনাল! রাতে কিয়েভের ফাইনাল হেরে সকালেই ভাইরাল হলো ক্লপ সমর্থকদের নিয়ে 'We saw the European Cup, Madrid had all the fucking luck, we’ll just keep on being cool, and bring it back to Liverpool!' গান গাচ্ছে! এই লোকটা অবর্ণণীয় অবিশ্বাস্য!

যা প্রমিজ করলেন তাইই করে দেখালেন। আবার ফাইনাল। এবার মাদ্রিদে। যে রিয়ালের কাছে হেরেছিলো, তাদের শহরে, তাদের মাটিতে গিয়ে জিতে আনলো ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্ব! ইয়ুর্গেন 'রবার্ট ব্রুস' ক্লপ। কোনো জাদুকর এত নিখুঁত জাদু দেখাতে পেরেছেন? হ্যারি হউদিনি? ডেভিড কোপারফিল্ড? অ্যাপোলো রবিন্স?

গত বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছি। ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন। নতুন বছর শুরুর দিন দশেক আগে হয়েছি বিশ্ব ক্লাব চ্যাম্পিয়ন। তারপরেও ক্ষুধা মিটছিলো না। ৩০ ঘন্টার পাকস্থলীর ক্ষুধাই সহ্য করা যায় না আর এ তো ৩০ বছরের মানসিক ক্ষুধা! যেন জন্ম জন্মান্তরের ক্ষুধা!

প্রিমিয়ার লিগে যেখানে এক দেড় যুগ ধরে ৮০-৮৫ পয়েন্টে শিরোপার মিমাংসা হয়ে গেছে, সেখানে ৯৭ পয়েন্ট পেয়েও গত বছর পেপ গার্দিওলার দুর্দান্ত ম্যানচেস্টার সিটির কাছে দ্বিতীয় হতে হলো! এত কাছে তবু এত দূরে! সবকিছুই একটুর জন্যে হয়েও হচ্ছিলো না! গত ত্রিশ বছরে চারবার দ্বিতীয় হয়েছি। সর্বশেষটা ২০১৪ তে। যে মানুষটা যুগের পর যুগ খুঁটির মত দুই পায়ে লিভারপুলকে বহন করেছে সেই জেরার্ড ওইদিনই স্লিপ করেছিলো চেলসির সাথে! ডেম্বা বে বল টেনে নিয়ে আমাদের শিরোপায় শেষ পেরেক ঠুকে দিলো। পেইনলেস ডেথ। মনে হয়েছিলো- এই একটা আক্ষেপ নিয়েই কোনো এক হাসনাহেনা-বেলি ঝরা রাতে মরে যাবো!

ক্লপ গত মৌসুম শেষে বললেন, 'We'll go again'.

ত্রিশ বছর পর লিগ জিতেছি। ১১০২৩ দিন, ২২ ঘন্টা, ৯ মিনিট, ৩২ সেকেন্ড পর! কাদের পরাজয়ে? সেই ম্যানচেস্টার সিটি! যাদের কাছে ৯৭ পয়েন্ট পেয়েও লিগ হারানোর পর ক্লপ বলেছিলেন, আবার হবে! ৯৭ পয়েন্ট পেয়েও না জেতার হতাশা ঘুচিয়েছে ৭ ম্যাচ আর ২৩ পয়েন্ট হাতে রেখে শিরোপা জিতে! লিভারপুলের পরের ম্যাচটাই ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে। ৩রা জুলাই, রাত ১ঃ১৫ তে। খেলা শুরুর আগে লিভারপুল যখন মাঠে নামবে, প্রথানুযায়ী পেপ গার্দিওলার প্লেয়ারদের সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে চ্যাম্পিয়নদেরকে 'গার্ড অফ অনার' দিতে হবে। এর চেয়ে বড় ফেইরি টেল, বড় ফিকশন লিখেছে কে? কবে?

আমি জাদুটোনা বিশ্বাস করতাম না। একজন মানুষ আমাকে সেটা বিশ্বাস করিয়ে ছাড়লো। ইয়ুর্গেন নর্বার্ট ক্লপ। ইউ সিম্পলি ক্যান্ট ডিফাইন দিস ম্যান। ম্যাসমেরাইজিং ক্যারেক্টার। লিভারপুলে আসে যখন, মরিনহো চেলসির কোচ৷ মরিনহো নিজেকে 'স্পেশাল ওয়ান' বললে ক্লপ নিজেকে কী বলবে এটা এক জার্নালিস্ট জানতে চাইলে বলেছিলেন, 'Does anyone in this room think that I can do wonders? I’m a totally normal guy. I came from the Black Forest. I’m the Normal One'. সেই কথার জালে মুগ্ধ করা শুরু। সংবাদ সম্মেলনগুলো একেকটা ফ্লোলেস মুভি। বার্সেলোনার মত দলের সাথে সেমিফাইনালে ৪-০ গোলে জেতার অবিশ্বাস্য সমীকরণে দাঁড়িয়ে ড্রেসিংরুমে প্লেয়ারদের বললেন, 'This is impossible, but, because it’s you, there is a chance'. জেতার পর দেয়ান লভ্রেন ড্রেসিংরুমে ক্লপের বলা বাকি কথাটাও পাবলিক করেন। রূপকথা তৈরির আগে ক্লপ বলেছিলেন,- 'Boys, believe. One or two goals, even if we don't score in the first 15, 20 minutes, believe in the 65th, 66th, 67th minute that we can score. And then with Anfield behind us, trust me guys, we can do it. We did it once against Dortmund, we can do it tonight. Just show fucking balls tonight.' এটা স্রেফ একটা দু'টো কথা। প্রতিবার যখন ক্লপ সামনে আসে, মন্ত্রমুগ্ধের মত কথা শোনা ছাড়া অন্য কিছু মনে আসে না। গার্দিওলা-ফার্গুসন-সাচ্চি-দেল বস্কদের মত হয়তো তুখোড় ট্যাকটিশিয়ান ক্লপ না কিন্তু কথা দিয়ে বিশ্বজয় করা গেলে এই 'নেভার গিভ আপ' লোকটা কী করতো কে জানে!

গতবারের আগে ২০০৫ এও ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয়েছি রাফা বেনিটেজের মাধ্যমে। যেভাবে হয়েছি, সেটা ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে 'সর্বকালের সেরা ইউরোপিয়ান ফাইনাল' হিসেবে। গতবছরও হলাম। যতগুলো ইউরাপিয়ান ট্রফি আছে, ইংল্যান্ডের আর কোনো ক্লাবের নেই। কিন্তু এক ইংলিশ লিগই হয়েও হচ্ছিলো না। নিন্দুকের মুখে ঝামা ঘষে দিতে এর চেয়ে বড় উপলক্ষ্য আর কী হতে পারতো? 'Next season will be yours' বলারা নিশ্চয়ই জানেন, গত এক বছরে ৪ টা ট্রফি জিতেছে লিভারপুল। বর্তমান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন, ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন, উয়েফা সুপার কাপ উইনার এবং ইংলিশ লিগ চ্যাম্পিয়ন দলের নাম লিভারপুল এফসি। নিন্দুকদের যেটা শুনতে এর চেয়েও খারাপ লাগবে, ইয়ুর্গেন ক্লপ লিভারপুলে নিদেনপক্ষে ২০২৪ পর্যন্ত থাকবে! অন্য মেজর শিরোপায় তো এগিয়েই, যে ইপিএলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড একটা মাত্র শিরোপাতে এগিয়ে আছে এখনও, আমার, আমাদের বিশ্বাস ক্লপ চুক্তির সময়সীমার মাঝেই সবকিছুতে ইংল্যান্ডের সেরা করে যাবে লিভারপুলকে। হি ইজ দ্যাট ক্যারিশম্যাটিক।

লিভারপুল অনেক বেশি ইমোশনের জায়গা। যারা আগে থেকে সমর্থক আছেন, তারা অন্য ক্লাবের মত ট্রফি দেখে সমর্থক হননি। যখন সাফল্য না দেখেই একটা ক্লাবকে আপনি ধারণ করবেন, তখন সেটা আসলে সত্যিকারের ভালোবাসা থেকে হতে হয়। অন্য যেকোনো ক্লাব থেকে এক্ষেত্রে পাল্লাটা ভারী লিভারপুলের। লিভারপুলের সমর্থকরা এই একটা জায়গায় অনন্য।

ট্রফি নিয়ে কথা তুলতে চাইনি। কিন্তু আপনাকে মাঝেমধ্যে কিছু ফিরিয়ে দিতে হবে। সেটার জন্যে আজকের চেয়ে ভালো দিন কমই এসেছে। বঙ্গবন্ধু বলে গেছিলেন, 'When you play with a gentleman, you play like a gentleman. But when you play with bastards, make sure you play like a bigger bastard. Otherwise, you will lose'.

জর্ডান হেন্ডারসন শিরোপা জয়ের পর বলেছে, 'To be honest I'm lost for words. You never really think of this moment. When this moment comes I can't really describe it'. গতকাল মাঝরাত থেকে আসলে বুঝে উঠতে পারিনি, আজকের দিনটা মনে রাখতে কী লিখবো, বা কী লিখে রাখা উচিত। অনেক শিরোপা জেতার এটা শুরু। কিন্তু এটার মত অর্থপূর্ণ আর কিছুর সাক্ষী হওয়া সম্ভবত আর হবেনা।

এ আনন্দের সীমা পরিসীমা হয় না!
ধন্যবাদ, লিভারপুল ফুটবল ক্লাব। ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২০ রাত ৯:৩৪
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×