somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নৈশাব্দিক ভালোবাসা

০৩ রা জুন, ২০১১ ভোর ৬:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাক ঢাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গে। বিছানার গা লাগা খোলা জানালা দিয়ে দেখা যায় বিশাল আকাশ। সূর্যের আগমনী বর্ণচ্ছটায় স্নিগ্ধতায় ভরাট আকাশের বুক। অসীমের মাঝে যার নিরন্তর আনন্দ। এমন আকাশের মুখ দর্শনেই ঘুমকে বিদায় জানায় বহ্নি। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা ক্লান্তি আর অলসতাকে ততটা পর করতে না পারলেও আপনের মায়াডোরে বেশী সময় ধরে রাখতে পারে না বহ্নি। এমন কি পাশে শুয়ে থাকা একমাত্র নাড়ীর ধন আপনের কপালে আদরের উষ্ণতা এঁকে দেবার সময় প্রলম্বিত করতে পারে না। ঘড়ির কাঁটা ধরে তাকে ছুটতে হয়। ব্যস্ততার সাগর আর মহাসাগর পাড়ি দিতে হয় ছত্রিশ বছর জীবনের অভিজ্ঞতার পাল তুলে। জীবনের সুখ আর দুঃখও যেন ঘড়ির কাঁটার কাছে ধরা খাওয়া। বিছানা ছাড়ে বহ্নি। মনটা ভাল নেই। নির্ঘুমে কাটে রাতের পর রাত। ঘরের আর সব প্রাণীর সেই সংবাদ জানা নেই। জানা নেই বহ্নির কষ্টের বহর দিনলিপির কতটা পথ পর্যন্ত বিস্তৃত। আনমনে নিসঙ্গতার ক্যানভাসে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায় বহ্নি।

সকলের নাস্তার আয়োজনের ফাঁকে নিজের জন্য সামান্য কিছুর আয়োজনে ব্যস্ত হয় বহ্নি । মোবাইল বেজে ওঠে। প্রতিটি মুহূর্তের অপেক্ষার ধ্বনি। মাঝে মাঝে অবাক হয় ভালবাসার এই সদ্য সে্রাতে নিজেকে স্নাত হতে দেখে। কাঙ্ক্ষিত সম্বোধন হূদয় গিয়ে আছড়ে পড়ে।

‘বন্ধু! কেমন আছো?’

‘ভাল। তুমি?’

ওপাশ থেকে দীর্ঘ শ্বাস গড়িয়ে আসে বহ্নির মনের দুয়ারে। ‘তোমায় আজ দেখতে পাবো না বন্ধু?‘ বহ্নি বলে,‘আজ আমার ব্যস্ততা বেশী!’ ওপাশ থেকে ভেসে আসে নির্জন জোনাকিকালের সুবাস আর তার তীব্রতা। বন্ধুর আকুতি,‘তোমায় দেখলে সুখের সান্নিধ্য পাই বন্ধু!’ পাশে এসে দাঁড়ায় প্রতীক। প্রতীক বহ্নির স্বামী। ভালবাসে বহ্নিকে। কিন্তু প্রকাশে তার নীরবতা। প্রকাশে তার ভিন্নতা। এই নীরবতা আর ভিন্নতা বহ্নিকে অন্যমনস্ক করে দেয়। একাকী আর অভিমানী করে তোলে। ব্যস্ততা প্রতীককেও আবৃত করে রেখেছে। প্রতীক ব্যস্ত হলেও বহ্নির ব্যস্ততাকে গুরুত্ব দিতে মাঝে মাঝে ভুল করে। ভুল হয়ে যায়। গৃহবধূর মত আচরণ প্রত্যাশা করে বসে। এটা তার পুরুষদীপ্ত আচরণ কিংবা হতে পারে বহ্নিকে প্রাপ্তির অধিকার। বন্ধুর সাথে কথা বলা অব্যাহত বহ্নির। প্রতীক খেয়াল করে। কথা না বলে নিজের গন্তব্যে পা বাড়ায়।

বহ্নি দেখা হবার সম্ভাবনার কথা শোনায় বন্ধুকে। তারপর বেরিয়ে পড়ে জীবিকার ব্যস্ততম পথে। ইস্কাটন থেকে গুলশান। পৌঁছাতে এক জীবনের পাওয়া আর না পাওয়াকে মন্থন করা যায়। করা যায় অনুভব সকল ভালবাসা। কিংবা কষ্ট আর তার প্রেক্ষিত। কিংবা নিজের ব্যর্থতার প্রতি পাতায় শুদ্ধতার মুদ্রণটা যাচাই করে নেয়া যায় আরও একবার। প্রচলিত ট্রাফিক ব্যবস্থা আর যান বাহনের আধিক্য মানুষকে সেই সুযোগ দিয়েছে। বহ্নি সুযোগের পুরোটাই গ্রহণ করে। ভাবনা চিন্তার এত একাকী সময় আর নেই। জীবনের শত পথ। শত বাঁক। এক জীবনে চলার এই শত বিড়ম্বনায় মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে যায় বহ্নি।

সিগন্যালে ক্যাব দাঁড়ায়। আশপাশ গাড়ী থেকে উত্সুক দৃষ্টি বহ্নির চেহারা প্রদক্ষিণ করে। বয়সের সীমা এখানে বাঁধা নেই। যুব থেকে বৃদ্ধ সকলের দৃষ্টি বহ্নির অবয়বের তীরে আছড়ে পড়ে। এই উত্সুকতা কৈশোরের প্রান্ত থেকেই শুরু। লাবণ্য আর সরল সৌন্দর্যের অফুরান প্রশংসা বহ্নির প্রাপ্তির ঘর পূর্ণ রেখেছে বরাবরই। কখনও কখনও অস্বস্তিতে পড়ে। মোবাইল বাজে। বন্ধুর ফোন। ‘অফিস পৌঁছাওনি?’

‘রাস্তায় অনেক জ্যাম।’

‘কোন জায়গায়? ক্যাব না সিএনজি?’

‘নাবিস্কোর সামনে। ক্যাব’

‘ওকে।’ লাইন কেটে দেয় বন্ধু। কিছুক্ষণ পর ক্যাবের সামনে বন্ধুকে দেখে চমকে ওঠে বহ্নি।

‘তাড়াতাড়ি করো! সিগন্যাল ছেড়ে দেবে!’ বহ্নি অবাক হয়। অবাকের সব কটা জানালা খুলে যায়। ‘কোথা থেকে এলে!’

‘তোমার সাথেই ছিলাম।’

‘মানে?!’

বহ্নির চোখের উপর নিজের চোখ স্থাপন করে বন্ধু। পলকহীন গভীর দৃষ্টি। যেন বহ্নির অন্দর মহলের অধ্যায়গুলো পড়ে ফেলে। ‘তুমি না বলো তুমি আমার ছায়া?’ বন্ধুর প্রশ্নে বহ্নির ঠোঁটের কোণে এক ফালি হাসি উঁকি মারে। ‘পাগল!’ মায়াবী হাসি। বন্ধু চেয়ে দেখে। যেন সাগরের বুকে জোছনার চাঁদ নেমে এসেছে। এক অন্যরকম সৌন্দর্য প্লাবিত হয় সাগরের বুকে। সাগরের তীরে। বন্ধুর দৃষ্টি নড়েচড়ে না। অপলক আর অবিরাম ভঙ্গি।

বহ্নি প্রশ্ন করে, ‘কি দেখো?!’

‘আমার বন্ধুকে! আমার বন্ধু অনেক ভাল একজন মানুষ! অনেক, অগুনতি আর অসীম সুন্দর! বিরল আর বিশাল সুন্দর!’ এক নিঃশ্বাসে কথা বলে চোখ বন্ধ করে বন্ধু। বহ্নির বুক চিড়ে এক লম্বা শ্বাস বের হয়ে আসে। নিজ হূদয়ের গভীর থেকে বের হওয়া শ্বাস অথচ কত অপরিচিত। জীবনের এমন এক অধ্যায়, যেখানে প্রতিদিন যোগ বিয়োগের নৈশব্দিক খেলাধুলা—সেখানে ভালবাসার এমন প্রাণবন্ত ছোঁয়া বিমোহিত করে বটে। এখানে হিসেব কষা নেই। নেই অংক মেলানোর অস্থিরতা।

‘তোমাকে না পেলে এ জীবন হয়ত বন্ধুহীন হয়ে থাকতো!’ বহ্নির কণ্ঠ থেকে বের হয় এক নির্জলা সত্য।

‘আর তুমি না ডাক দিলে আমার বন্ধুহীন ঘুম হয়ত ভাঙ্গত না!’ বন্ধু বলে। তারপর অনাবিল হাসিতে স্নাত হওয়া। রাস্তার জ্যাম আর ওদের অসহনীয়তার মাত্রা বাড়ায় না। বরং ওদের অজান্তেই ওদের জ্যামপ্রিয়তা বাড়ে। বহ্নি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।

‘কি ভাবছো?!’ বন্ধুর প্রশ্নে বহ্নি চমকে ওঠে। প্রতীক বহ্নির বন্ধু ছিল।। বিয়ের পর স্বামী কখনও বন্ধু হয় না। হতে পারে না। স্বামী আর স্ত্রী একই ছাদের নিচে থাকলেও এ সম্পর্কটাই সবচেয়ে কাছে থেকেও দূরের। অনেক দায়িত্ব, চাওয়া পাওয়া যেখানে সেখানে ‘বন্ধুত্ব’ হয় না। প্রতিটি সম্পর্কের মাঝে ‘নিজস্বতা’ বলে একটি সত্য আছে। বিয়ে মানুষের ‘নিঃসঙ্গতা’ দূর করলেও ‘নিজস্বতা’কে হত্যা করে। মানুষের অল্প বয়সী জীবনে অনুভূতির এই পরিবর্তন কিংবা বিবর্তন-এর কোনো মানে খুঁজে পায় না বহ্নি। ‘তুমি আমার কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করো?’ বহ্নির প্রশ্ন। ‘তোমার নির্মেঘ বন্ধত্ব! তোমার সুখে হাসি আর দুঃখে তোমার পাশে থেকে কষ্ট শুষে নেয়া - সেই সুযোগ!’ বন্ধু আকণ্ঠ আবেগে কথা বলে। ‘কিন্তু আমরা তো দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু!’ উদাস হয়ে যায় বহ্নি।

মোচড় দিয়ে ওঠে বন্ধুর নিলয় আর অলিন্দ। অনেক না পাওয়ার গল্পগুচ্ছ তার। জীবনের অনেকটা পথ একা পাড়ি দেবার ধূসর ভ্রমণকাহিনী আজও প্রতিধ্বনিত হয়। ভাবনার পথ থেকে সব কষ্টের জঞ্জালকে পরম তৃষ্ণায় দূর করতে চায় বন্ধু। বহ্নির হাত নিয়ে খেলা করে । কণ্ঠে তার ভরাট আবেগ, ‘আমার একটা জগত্ আছে। তোমারও একটা জগত্ আছে। আমাদের এই দুই জগতের মাঝে তোমার আর আমার নিজস্ব একটা জগত্ আছে! যে জগতে আমরা দু’জন বসবাস করি! আমাদের পার্থিব কোন আবাস নেই সত্য; কিন্তু আমরা অনুভূতির আকাশে ডানা মেলে কেবলই উড়ে বেড়াই!’ বন্ধুর কথায় আকাশের সব নীল নেমে আসে বহ্নির অশ্রু সাগরে। আবেগহীন সময়ে যার দিন অতিবাহিত হয় আবেগের তাড়না তাকে আপ্লুত করে বৈকি।

অফিসে ঢুকতেই বসের ডাক। বসের চেহারায় বিরক্তির ছাপ। ফেস পাউডারের লাল আভা সেই ছাপে চাপা পড়েছে। ভ্রূ দু’টোকে যতটা সম্ভব কাছে টেনে তাকায় বহ্নির দিকে, ‘এত দেরি!’

পনের মিনিট লেট। জীবন থেকে যেন পনের মিনিট পিছিয়ে যাওয়া। কি কৈফিয়ত দেবে বহ্নি। ভেবে পায় না। বসের নিকট নিরুত্তর থাকা ভাল। উত্তর পছন্দ না হলে বস তার রেশ টেনে নেবে অনেক দূর। অনেক অপ্রিয় কথার জন্ম নেবে। ভাললাগে না বহ্নির। হাতের মুঠোয় ধরা সাইলেন্ট করা মোবাইলে ম্যাসেজ আসার মৃদু কম্পন। প্রতীকের ম্যাসেজ । বস আদেশের সুরে জানাল সন্ধ্যা ছয়টায় মিটিং। অফিস আওয়ারের পর মিটিং করা বস সমাজের একটা সংস্কৃতি। পারিবারিক পিছুটান নেই। এরা সারাদিন ব্যক্তিগত কাজ শেষে অপরাহ্নে অফিসিয়াল যাত্রা শুরু করে। চাকরিটা জীবিকার প্রয়োজনে। নচেত্ এমন চাকরির তোয়াক্কা বহ্নি করতো না। উন্নাসিকতার কাছে অহেতুক বিসর্জন বহ্নি পছন্দ করে না। অফিসের অনেকের সাথেই বসের সখ্যতা। বহ্নির নেই। বহ্নি পারে না। কাজের বাইরে বাড়তি সম্পর্কের আনুসাঙ্গিকতা কিংবা আয়োজন বহ্নির নেই। ছিল না কোনদিনও। কাজ দিয়েই সে তার যোগ্যতা প্রদর্শনে আগ্রহী।

রুমে এসে প্রতীকের ম্যাসেজ ওপেন করে। সন্ধ্যায় সময় চায়। মেহমান আসবে। বহ্নি অফিসের কাছে ধরা খাওয়া। স্বচ্ছ ও সুন্দরভাবে বিষয়টি প্রতীককে অবহিত করে। প্রতীক বোঝে না। মন খারাপ হয় বহ্নির। হূদয় ভূমের একটা নির্ধারিত জায়গায় প্রতীকের জন্য বহ্নির ভালবাসা আর অপেক্ষারা জমাট বেঁধে আছে। বহ্নি অনুভব করে। বিশাল দায়িত্ব তার। ফুরসত্ নেই নিজেকে নিয়ে ভাবার। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুর ম্যাসেজ আসে। প্রতি ঘন্টায় খোঁজ নেয়া। ভালবাসার ব্যাকুলতায় বহ্নি আচ্ছন্ন হয়।

সল্ট গ্রীল রেস্টুরেন্ট। কাজের ফাঁক থেকে এ যেন এক রত্তি সময় বের করে নেয়া। বহ্নি আর বন্ধু মুখোমুখি বসে। দু’টি জীবনের সুখ আর দুঃখের ছোট বড় অনেক স্মৃতিচারণা এখানে হয়। হয় ভাললাগা আর ভালবাসার কথোপকথন। কফির ধোঁয়ার সাথে জীবনের অবাঞ্ছিত কষ্টগুলো ওরা উড়িয়ে দেয়। ওদের হাসিতে সুন্দর একটি আগামীর সম্ভাবনা উঁকি দেয়। বহ্নির কণ্ঠ বাষ্পরুূদ্ধ, ‘প্রতীকের অসুস্থতায় আমি শুধু আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতাম! মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সৃষ্টিকর্তার সাক্ষাত্ খুঁজতাম! বড় একা ছিলাম! কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না!’ কাজল আঁকা চোখে নদীর স্রোত বেগবান হয়ে ওঠে। চশমা খুলে আঙ্গুলের আড়ালে সেই স্রোতকে বশে আনতে যেয়ে ব্যর্থ হয় বহ্নি। প্রচণ্ড রকম সাহসী আর দৃঢ় চেতনার এক নারীর দু’চোখ এভাবে স্রোতে ভাসতে দেখেনি বন্ধু। বন্ধুর কণ্ঠ থেকে বের হয়,‘তুমি প্রতীককে বড় বেশি ভালবাস!’ বন্ধুর কথায় বহ্নির চোখ উপচে পড়ে অশ্রু। বন্ধুর ইচ্ছে হয় বহ্নির লোনা জলটুকু হূদয় দিয়ে শুষে নিতে। আকণ্ঠ কষ্ট নিয়ে বহ্নি বলে,‘ হ্যাঁ ! আমি ভালবাসি! আমি প্রতীককে বড়ো ভালবাসি! আপনের জন্য আমি বড় স্বার্থপর বন্ধু! আপন পিতৃহীন হবে আমি ভাবতে পারি না! আমি আমার সন্তানের জন্য সব পারি!’ বন্ধুর ইচ্ছে হয় জীবনের অবশিষ্ট ভালবাসা দিয়ে বহ্নির কষ্ট দূর করে। উপায় কি? সামাজিক রীতির এক কঠিন শেকলে বন্ধুর হাত-পা বাঁধা। এ বাঁধন আলগা হলে কাছে নয় বরং দূরে সরে যেতে হবে বন্ধুকে। অদ্ভুত মানুষের জীবন। জীবন প্রণালীতে আবেগ অনুভূতির এত বৈচিত্র্যময় স্তর, অথচ নিয়মতান্ত্রিকতায় সব আবেগ অনুভূতির স্তরের বহিঃপ্রকাশ এক জীবনে ঘটানো যায় না। এক জীবনে ঘটতে নেই। বিধাতার এত উদারতার মাঝে এই অনুদারতা বিধাতার সর্বশক্তিময়তাকেই প্রমাণ করে। আর প্রমাণ করে বিধাতা কর্তৃক প্রদত্ত মানুষের সীমিত পরিসরকে। বহ্নি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে।

‘তোমার কথা বলো বন্ধু!’

বন্ধু বলে,‘আমি মেনে না নেওয়ার অথচ মানিয়ে চলার এক মানুষ! ভাললাগা আর ভালবাসা পেয়েছি হয়ত অনেক। কিন্তু ভালবাসতে পেরেছি কম। হয়ত যা পেরেছি সেগুলো অকৃত্রিম ছিল না। জীবনের অনেকটা পথ আমি একাকী পাড়ি দিয়েছি। আজও দিচ্ছি। তোমায় পেয়ে আমার ভালবাসা ডানা মেলেছে!’

বহ্নির মুখে বন্ধু খাবার তুলে দেয়। বহ্নিও দেয়। আশেপাশের মানুষ খেয়াল করে। ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই। ওরা তন্ময় আর বিভোর ওদের প্রতি। ওদের চেহারায় প্রশান্তির অভিব্যক্তি। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে ওরা ওদের পেয়েছে। খানিকটা দেখায় আর কথায় ওরা শান্তির পূর্ণতা খুঁজে পায়। বন্ধুর মোবাইল বেজে ওঠে। নিচু স্বরে কথা বলে বন্ধু। যেন বহ্নি শুনতে না পায়। বন্ধুর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কথা শেষ করে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে বন্ধু। বহ্নি বুঝতে পারে বন্ধুর পরিবর্তন।

‘কি হয়েছে?!’

বন্ধু অট্টহাসি দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। হাসি ভেঙ্গে ভেঙ্গে গড়িয়ে যায়। বহ্নির কপালে এলোমেলো চুল হাত দিয়ে সরায় বন্ধু। বহ্নির চোখে চোখ রেখে বন্ধু প্রশ্ন করে,‘আমায় সব সময় ভালবাসবে তো? আমায় মনে পড়বে তোমার?’

সূর্য যখন চোখ মেলে তখন বিছানা ছাড়ে বহ্নি। সূর্য যখন পৃথিবীর বুকে পুরো কিরণ মেলে দেয় তখন অফিসে যায় সে। আর সূর্য যখন আকাশের গভীরে হারিয়ে আঁধার বাড়িয়ে দেয় তখন ঘরে ফেরে সে। আপনের জন্য অনেক কষ্ট হয় বহ্নির। অনেক কষ্ট। বাকরুদ্ধ করে দেয়। ছেলেটাকে সারাদিন দেখতে না পারার কষ্ট তাকে তিলে তিলে শেষ করে। জীবিকার কাছে জীবন বরাদ্দ দিয়ে বহ্নি নিরুপায়। ঘরে ফিরেই আপনকে বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ থাকা। তারপর শুরু হয় সংসারের অলিগলি থেকে শুরু করে আনাচে কানাচে দৌড়ঝাপ। নিরন্তর ছোটাছুটি। তার মাঝে কখনও কখনও ল্যাপটপে বসে অফিসের কাজ সেরে নেয়া।

ঘরে ঢুকেই চোখে পড়ে খাটের উপর শাড়ীর প্যাকেট। সোফায় বসা প্রতীক। আপন ঘুমিয়ে আছে। খাটে শোয়া আপনের কপালে আদর এঁকে বেশ অবাক হয়ে তাকায় প্রতীকের দিকে। প্রতীকের ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস। যেন কিছু একটা জয় করে এসেছে অথবা জয় করবে। শাড়ীর ভাঁজ খুলে প্রতীক বহ্নির কাঁধে মেলে ধরে । প্রতীকের কণ্ঠ থেকে বের হয়—

‘অপূর্ব!’

‘কি?’

‘শাড়ি! তোমাকে মানিয়েছে বেশ!’ বহ্নির বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বের হয়। সৌজন্যতার ডানা মেলে বহ্নি।

‘খুব সুন্দর!’

‘চল আজ আমি, তুমি আর আপন বাইরে খাই!’

বহ্নি নিজেও বিশ্বাস করে সন্তান, মা বাবা আর ভাইবোন ছাড়া জগতের আর সব সম্পর্ক হচ্ছে চর্চার সম্পর্ক। চর্চা যত জোরালো হয় সম্পর্ক তত সহজ, সরল আর গভীর হয়। বিশ্বাস থাকায় চর্চায় নিজেকে সঁপে দিতে সমস্যা হয় না বহ্নির। অনেক অভিজ্ঞতার মাঝে এ অভিজ্ঞতাও সংকলিত হয়। যখন বহ্নির হূদয় ব্যাকুল হয়েছে এমন অভিজ্ঞতার জন্য তখন প্রতীক ছিল অন্যমনস্ক। আজ প্রতীক ব্যাকুল কিনা বলা মুশকিল তবে তত্পর। তার এই তত্পরতায় বহ্নি আজ কতটা প্রতিক্রিয়াশীল তা বলা কঠিন। বহ্নির নিজস্ব একটা গাণিতিক হিসেব আছে। নিজেকে কেন্দ্রে ফেলে যে বৃত্তের মাঝে তার বসবাস চাইলেও যে কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। বহ্নি দুর্ভেদ্য যতটা তার চাইতে বেশি দুর্লভ। তাকে নিয়ে গর্ব করা যায়।

ঘরে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চেনার চেষ্টা করে বহ্নি। কোন পরিবর্তন নেই। অবাক হয়। তাহলে কিসের এই ব্যাকুলতা? নিজেকে এত জানার পরও কেন অজানা মনে হয়? মোবাইল বেজে ওঠে। বন্ধুর ফোন।

‘হ্যালো! বন্ধু!’

বহ্নির গলা ভেজা। বন্ধুর কণ্ঠে ব্যস্ততা, ‘কাল তোমার সাথে জরুরী কথা আছে। সল্ট গ্রীলে এসো!

‘কি হবে বন্ধু! আমাদের দেখা হলে আমরা ইমোশনাল হই ঠিক আছে! কিন্তু তুমিও একা! আমিও একা! এটা বাস্তব কথা!’ বহ্নির কথায় থমকে পড়ে বন্ধু। এত বড় সত্য কথা বন্ধু তাকে শোনানোর কারণ জানে না। শুধু জানে তার হাতে সময় নেই। একাকিত্ব নিয়ে বন্ধুর ধারণা পরিষ্কার। বন্ধু আরও জানে কোন মানুষের পাশের জায়গা বেশিদিন খালি থাকে না। পূরণ হয়ে যায়। চোখ ভিজে যায় বন্ধুর। অনেকদিন কাঁদেনি। আজ কাঁদে। বহ্নি দেখতে পায় না। কি ভেবে বহ্নি বলে,‘ঠিক আছে আসবো।’

সল্ট গ্রীলে বহ্নি বসে। নির্ধারিত জায়গা দখল নিয়ে আছে। সল্ট গ্রীলের ওয়েটার খেয়াল করে আজ বহ্নি একা। অবাক হয়। কারণ ওরা কখনও একা আসেনি। একবার কাছে এসে কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে। ঘড়ির কাঁটা ছয়টায় ছুঁয়ে গেছে। বন্ধুর অপেক্ষায় বহ্নি। মোবাইলে নম্বর চাপে। ফোন রিসিভ করে না। আশ্চর্য আর বিস্ময় বহ্নিকে আলিঙ্গন করে। ম্যাসেজও পাঠায়। কিন্তু প্রতিউত্তর নেই। লিফট বরাবর চোখ রাখে বহ্নি। চোখ টানটান হয়ে যায়। বাইরে মেঘ গর্জনের শব্দ ভেসে আসে। প্রবল বর্ষণের আভাস। ঝড় হতে পারে। অপেক্ষার মাত্রা বাড়াবে কিনা ভাবছে বহ্নি। ওয়েটার ওর সামনে এসে একটি খাম বাড়িয়ে দেয়। বহ্নি অবাক হয়। বন্ধুর চিঠি। কিন্তু বন্ধু কই। আশেপাশে তাকায় বহ্নি। কিন্তু না। কোথাও নেই।

চিঠি মেলে ধরে বহ্নি। ‘বন্ধু, আমি যাচ্ছি। মনটা থাকলো তোমার কাছে। তোমার নাকের পাশে যে ছোট্ট তিল কৃষ্ণ নক্ষত্র তাতে আমার মনটা পিদিম জ্বেলে রাখবে। তুমি আমার উপস্থিতি অনুভব করতে চাইলে সে-ই কৃষ্ণ নক্ষত্রকে স্পর্শ করবে! তোমাকে আমি ভীষণ ভালবেসেছি! তোমার কাছ থেকে ধীরে ধীরে ‘অবর্তমান’ হবার দুঃসাহস আমার নেই! শক্তিও নেই! যেতেই যখন হবে তখন আকস্মিক চলে যাওয়াই ভাল! কষ্ট তাতে ধৃষ্টতা কম পায়! যদি কোনদিন এই ভূ-জগতে আসবার আবারও সুযোগ হয় আমি তোমার চোখের কাজল হয়ে আসবো! তোমার কষ্টের লোনা জল পান করবার মোহে! সুযোগ দেবে তো বন্ধু?’

বহ্নির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। লিকোমিয়া কেড়ে নিয়েছে বন্ধুকে।

বন্ধুর জন্য ভিজে ওঠে মন। মন বন্ধুর এতটা দখলদারিত্বে ছিল আগে বুঝতে পারেনি। কঠিন নিঃসঙ্গতায় রাস্তায় একাকী হেঁটে চলে বহ্নি। গন্তব্যহীন হাঁটা। আকাশ মাথার উপর। অথচ যেন মেঘে ঢাকা অরণ্য!
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×