somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রোহিঙ্গা মুসলিমদের মূল সমস্যাটি কোথায়? কিবলা আয়াজ

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(একটি প্রবন্ধের অনুবাদ। রোহিঙ্গা-সঙ্কট বিষয়ে এটি বেশ যুক্তিযুক্ত মনে হল বিধায় অনুবাদ করা হল। নিচে প্রবন্ধের লিঙ্ক দেওয়া হল।)


আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দীর্ঘদিন থেকেই মিয়ানমারে বসবাসরত ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনতার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসছে। কখনো তা বেশ গুরুত্বসহকারে, কখনো দায়সারাভাবে। দুর্ভাগ্যজনক হল, অপরাপর সকল বিষয়ের মতো, একেও বেশ ভাসা ভাসা এবং আবেগী পন্থায় উপস্থাপন করা হয়। বিষয়ের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা নেই।

সন্দেহ নেই, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম জনতা এক কঠিন সময় পার করছে। দেশটির স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই আন্তরিকভাবে এর সমাধানের চেষ্টা করে নি। আবার এই সমস্যার সবচে জটিল দিকটি হল, শুরুতে যার ভিত্তি ছিল জাতিগত সংঘাত, পরে তা ধর্মীয় রূপ লাভ করে! এখন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব লাভের চেয়েও তা সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিম ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের পারস্পরিক সংঘাত হিসাবে প্রকাশ পায়। শুধু এই কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা মানবাধিকার লড়াইয়ের সূচি থেকে বের হয়ে ধর্মীয় সংঘাত হিসাবে মূল্যায়িত হয়। আর এটাই সংঘাত সমাধানের দৃশ্যপটকে পাল্টে দিয়েছে।

রোহিঙ্গা মুসলিমদের বসবাস মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে, যা বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন। রোহিঙ্গা ছাড়াও এখানে রাখাইন সম্প্রদায়ের বসবাস, যারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখের মতো, রোহিঙ্গাদের তুলনায় যা সংখ্যাগুরু। দুঃখজনক হল, রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মাঝে সুসম্পর্কের বেশ অভাব। দুটি জাতিগোষ্ঠীর এ বৈরি সম্পর্ক পরিস্থিতিকে যারপর নাই ঘোলাটে করে তুলছে। দুটি জাতিই দারিদ্র্যের জাতাকলে পিষ্ট। ক্ষেত-খামার ও মাছ শিকারই তাদের জীবিকার উপায়। জীবন-ধারনের অভিন্ন উপায়ও তাদের সমস্যাটাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

রোহিঙ্গা এবং সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ঘৃণা-সংঘাতের আরো কারণ হল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান আন্দোলন যখন যখন তুঙ্গে, রোহিঙ্গাদের চেষ্টা ছিল রাখাইন অঞ্চলকে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা। সে চেষ্টা কোথাও কোথাও সহিংসতার রূপ নিয়ে ছিল।

বৌদ্ধ মতাদর্শে বৈরাগ্যের প্রতি জোর দেওয়া হয়। আর তাই মিয়ানমারের নগরে-বন্দরে হাজার হাজার নারী-পুরুষের দেখা মেলে, যারা সংসারের বন্ধন ত্যাগ করে পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিকতায় সমর্পিত। এরা একটি ঝুড়ি হাতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে দৈনন্দিন খাবার সংগ্রহ করে থাকে। দেখলে মনে হবে, নির্দিষ্ট গেরুয়া বর্ণের পোশাক পরা মু-িতকেশ নারী-পুরুষ রাস্তায় লাইন ধরে আছে। এটিই মিয়ানমারের সাধারণ দৃশ্য। সংসার-বিরাগী সদস্যের সংখ্যা, এক পরিসংখ্যান মতে, প্রায় দশ লাখ। বৌদ্ধ ধর্মের এই বৈরাগী প্রবণতার দরুণ অনুসারীদের ক্রম-হ্রাসমানতা একটি অনিবার্য বিষয়। এর বিপরীতে মুসলিম সমাজে অধিক সন্তান জন্মদানকে পূণ্যজ্ঞান গণ্য করা হয়। একাধিক স্ত্রী রাখার ব্যাপারে ধর্মীয় অনুমোদনের কারণে সহজেই তাদের বংশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের একটি সম্পর্ক বিদ্যামন। মুসলিম-বৌদ্ধ সম্পর্কের অবনমনে তাদের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায় সাধারণত নিজ ঘরে বা দোকানে ৭৮৬ সংখ্যাটি লিখে রাখে। ( যা মুসলিম বিশ্বাস মতে, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম- এর সাংকেতিক রূপ!) কিন্তু অজানা কারণে তা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ভীষণ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছে। সংখ্যা তিনটিকে এক সঙ্গে যোগ করলে যোগফল দাঁড়ায় ২১। বৌদ্ধ পুরোহিতদের সন্দেহ, এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের সাংকেতিক চিহ্ন, যার মূল কথা হল একুশ শতকের মাঝেই মুসলিমরা মিয়ানমারে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসাবে আত্মপ্রকাশ লাভ করবে। তাই ৭৮৬ সংখ্যাটি মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের কাছে দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিপরীতে বৌদ্ধ পুরোহিতগণ ৯৬৯ সংখ্যাটির প্রচলন ঘটিয়েছেন। তাদের মতে, এ হল গৌতম বুদ্ধে শিক্ষার মূলনীতি-নির্দেশক সংখ্যা এবং ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ!

রোহিঙ্গা মুসলিমদের বর্তমান সমস্যা হল, তাদেরকে ভূমিপুত্র হিসাবে গণ্য করা হয় না। সমস্যাটি আরো গভীর হয়, যখন আইন-প্রণয়নের মাধ্যমে তাদেরকে নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাই সরকার তাদেরকে NRC (National Registration Card) দিতে অস্বীকার করে। এর পরিবর্তে তাদেরকে TRC (Temporary Registration Card) নিতে বাধ্য করে। NRC থেকে বঞ্চনার অর্থ হল, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় পূর্ণ নাগরিক হিসাবে অগ্রহণযোগ্য। তা ছাড়া এর ফলস্বরূপ জায়গা-জমি ও ভোটাধিকার থেকেও বঞ্চিত। সরকার তাদেরকে উপদেশ দেয়, রোহিঙ্গা হিসাবে নয়; চট্টগ্রামের বাঙালি হিসাবে পরিচয় দিতে!

সন্দেহ নেই, রাাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের কারণে তারা আপন অস্তিত্ব রক্ষার এক কঠিন সংগ্রামে নিপতিত। বর্তমান মুসলিম-বৌদ্ধ সংঘাতের কারণে চরমপন্থী বৌদ্ধ পুরোহিত আশিন ওয়েরা থু’র অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ওয়েরা থু’কে টাইম ম্যাগেজিনের জুলাই-২০১৩ সংখ্যায় মিয়ানমারের সন্ত্রাসী (The face of Buddhist terror) নামে অভিহিত করা হয়। প্রচ্ছদে তার ছবিও ছাপা হয়। ওয়েরা থু’র কেন্দ্র মিয়ানমারের বৃহৎ নগর মান্দালে-তে অবস্থিত, যেখানে তিনি একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। সেখানে প্রায় তিন হাজারের মতো শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত। তার সেই প্রতিষ্ঠান স্থানীয় পরিভাষায় যে ডিগ্রি প্রদান করে থাকে, তা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মাস্টার্সের সমতুল্য। অক্টোবর-২০১৩ সালে সেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অফিসে আমাদের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি দলের সাথে পুরোহিত ওয়েরা থু’র বিস্তারিত কথাবার্তা হয়। এই প্রতিনিধি দলে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্সটিটিউট ফর গ্লোবাল এ্যানগেজমেন্ট-এর প্রধান ড. ক্রিস সাইবেল, পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অপ পিস স্টাডিজ-এর ডিরেক্টর আমের রানা, শাইখ জায়েদ ইসলামিক সেন্টার-এর প্রফেসর রশিদ আহমদও ছিলেন। ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবর্গও এতে ছিলেন।

ওয়েরা থু’র অফিসের আশে-পাশে দেয়ালে নানা রকমের পোস্টার সাঁটানো, যাতে স্থানীয় ভাষায় মুসলিম-বিরোধী নানা রকম উত্তেজনাকর কথাবার্তা লেখা। প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার মুণ্ডিতকেশ তরুণ শিক্ষার্থী গৈরিক পোশাকে পড়াশোনায় ব্যস্ত। তা দেখে, মিয়ানমারের সাধারণ জনতার জন্য দুঃখ হয়। যদি পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষের এহেন পরিবেশে এ-সব তরুণদের মানসিক প্রতিপালন হয়, তাহলে এই সুন্দর প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কী হবে, জানা নেই। পুরোহিত ওয়েরা থু’র অভিযোগ, মুসলিম সম্প্রদায়ের শুয়াইবুদ্দিন নামক এক আলেম ১৯৩৪ সালে একটি গ্রন্থে লিখেছেন, একুশ শতকে মুসলিম সম্প্রদায় মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে। তিনি বলেন, মুসলিম জনসংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। আমাদের আশঙ্কা, তারা এক সময় মিয়ানমার দখল করে নেবে। রাখাইনের তিনটি শহর বুথিডং, মিডাও এবং পেতিডারং-এ রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৯৪%। আমাদের ভয়, তারা সেটা দখল করে নিয়ে সেখানে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করবে।

আমাদের প্রতিনিধি দল তাকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, কারো প্রত্যাশা মানেই তো এই না যে, তা বাস্তবে ঘটে যাবে। মিয়ানমার বৌদ্ধ সংখ্যাগুরুর দেশ। আপনার আস্থা থাকা উচিত যে, কল্পনার ভিত্তিতে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমরা তাকে বলেছি, মুসলিমরা ধর্মীয় বিষয়-আশয়ের ব্যাপারে হিজরি চান্দ্রবর্ষ ব্যবহার করে থাকে। তাই এটা অসম্ভব যে, খ্রিস্টীয় একুশ শতকে তারা মিয়ানমার দখলের গোপন ষড়যন্ত্র করছে! তাদের বাস্তব কর্মপরিধিও এর বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। কারণ, আজ পর্যন্ত কোনো শহরে মুসলিমদের জনসংখ্যা বাড়ে নি। ৭৮৬ সংখ্যাটি মুসলিমরা শুরুর দিকে ব্যবহার করেছে, খাবার-দাবারে হালাল-হারাম পার্থক্য করার জন্য। পুরোহিত ওয়েরা থু’র সাথে বিস্তারিত আলোচনার পর মনে হল, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ধারাবাহিক সংলাপ চালালে প্রতিক্রিয়াশীলতার তেজ কমতে পারে। কিন্তু এর জন্য ধর্মীয় ও প্রচলিত সমাজ-সভ্যতা সম্পর্কে গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের দরকার।

অক্টোবর ২০১৩ সালে মিয়ানমার সফরে আমাদের জানা হল যে, ড. সালেহ নামক এক রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আরাকান ইসলামি রাষ্ট্র-এর স্বঘোষিত নেতা। তাছাড়া বৌদ্ধ মতাদর্শের এক পণ্ডিত, যিনি অক্সফোর্ড ডিগ্রিধারী, বলেন, তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানের বামিয়ানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তির সঙ্গে যে অপমানজনক আচরণ করা হয়েছে, তাতে বৌদ্ধ-অনুসারীদের মনে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। মিয়ানমারের পরিপ্রেক্ষিতে একে অস্বীকার করার জো নেই। এই সমস্ত কারণে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ইসলামফোবিয়া (ইসলাম ও মুসলিম-আতঙ্ক) তৈরি হয়। সাথে সাথে সংঘাতের সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে। আপতত এর সমাধানের কোনো উপায় নেই।


প্রস্তাবনা ও নির্দেশনা

মিয়ানমারে অবস্থিত রোহিঙ্গা মুসলিমদের সঙ্কট-নিরসন অদূর ভবিষ্যতে চোখে পড়ছে না। লক্ষ্য করার বিষয় হল, তাদের মাঝে শিক্ষার বড় অভাব। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন উদার নেতৃত্ব বিকাশের কোনোও সুযোগ নেই। তাই আবেগী বক্তব্য ও শ্লোগানের মাধ্যমে এদেরকে সহজেই উত্তেজিত করা যায়। ফলস্বরূপ তাদের বিরোধী রাখাইন জনগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের সমন্বিত চাপে তাদের দুর্ভোগ দ্বিগুণ হতে থাকে। রোহিঙ্গাদের উচিত ছিল, আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচলিত লবিংয়ের আশ্রয় নেওয়া এবং নিজেদের প্রতি সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করা। অথচ বর্তমানের অবস্থা হল, মিয়ানমারের অ-রোহিঙ্গা মুসলিম জনতাও তাদের ব্যাপারে উচ্চকিত নয়। মান্দালে-তে মুসলিম ধর্মাবলম্বী একটি গ্রুপ বিদ্যমান, যাদের নাম পান্থে। তাদের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো। শিক্ষা ও বাণিজ্যে তারা বেশ এগিয়ে। তারা চিনা বংশোদ্ভূত মুসলিম। তাদের রয়েছে মিয়ানমারের পূর্ণ নাগরিকত্ব। মসজিদ সংলগ্নই তাদের কনফারেন্স হল। তাদের প্রতিনিধির সঙ্গে আমাদের বিস্তারিত মতবিনিমিয় হয়। তাদের অভিমত হল, নাগরিকত্ব লাভের জন্য রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বর্তমান কর্ম-পদ্ধতি পরিত্যাগ করতে হবে।

মিয়ানমারের বর্তমান শাসকদের বিকল্প হিসাবে সাধারণ জনতা অং সান সুচির দিকে তাকিয়ে আছে। তার গ্রহণযোগ্যতাও অনেক। কিন্তু তিনিও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বাক্যব্যয় করতে ইচ্ছুক নন। কারণটি স্পষ্ট। এমনটি করে তিনি সাধারণ জনতার সমর্থনকে হ্রাস করতে চান না। তিব্বতের সর্বোচ্চ বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা দালাইলামা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুর্দশা লাঘবে সহায়তা করার ওপর জোর দিয়েছেন।

মিয়ানমারের পুরোহিত ওয়েরা থু’র অনুসারী ও ভক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপারটি অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, মিয়ানমারের সাধারণ জনতা ঝামেলাহীন, নরম প্রকৃতির ও অসীম ধৈর্যের অধিকারী। সেখানে এমন হাজার হাজার বৌদ্ধ পুরোহিত বিদ্যমান, যারা ওয়েরা থু’র সঙ্গে একমত নন। তারা মিয়ানমারকে অধিক জনসংখ্যা ও সকল ধর্মের সঙ্গমস্থল হিসাবে দেখতে আগ্রহী। তাদের নেতৃত্ব ড. এ্যাশিন সিতা গু মিয়া গু'র হাতে। ড. এ্যাশিনের অনুসারীর সংখ্যাও লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তার আদর্শের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। রোহিঙ্গাদের উচিত, ড. এ্যাশিনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা এবং তার সহযোগিতা আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রাখা।

মিয়ানমারের প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনে ইউ এ য়ে লেভিন (UA Ye Lwin) নামে একজন অ-রোহিঙ্গা মুসলিমের সন্ধান পাওয়া যায়, যিনি বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি আন্তঃধর্মী সংলাপের এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। তার চেষ্টার প্রতি সমর্থন জানানো দরকার। ইয়াঙ্গুনের বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও সরকারি নীতি-নির্ধারকগণ তাকে বেশ সমীহ করেন।

মিয়ানমারে '88-generation group' নামে একটি শক্তিশালী কমিউনিটি রয়েছে। এতে সেই সব রাজনৈতিক কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা, যারা ১৯৮৮ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে সীমাহীন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। এই কমিউনিটির যৌবন ব্যয়িত হয়েছে মিয়ানমারে আইনি শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। দেশের নিরাপদ জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য আজও তারা নিবেদিতপ্রাণ। রোহিঙ্গাদের উচিত, এই কমিউনিটির অন্তর্ভুক্ত হওয়া, তাদের কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করে নিজেদের অবস্থান তৈরি করা।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংখ্যাগুরু বার্মানদের শাসনের প্রতি বীতরাগ একাধিক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এদের মাঝে মং, কোকেন, শান, চিন, কায়েন এবং কাচিনের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এই সব জাতিগোষ্ঠীর অভিযোগ হল, সংখ্যাগুরু বার্মান জাতি অপরাপর জাতির কৃষ্টি-ইতিহাস ও রাজনীতিকে এড়িয়ে যেতে চায়। ইতিহাসের গ্রন্থে শুধু বার্মান নেতাদের আলোচনা। অন্যান্য জাতির নেতাদের কোনো উপস্থিতি নেই। সেই সব বঞ্চিত জাতিদের অন্তর্ভুক্ত হল খ্রিস্টান ও মুসলিম সম্প্রদায়। রোহিঙ্গাদের উচিত, সেই সব বঞ্চিত জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি করা। নিজেদের জীবন-পদ্ধতি ও রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল বৃত্তকে বিস্তৃত করা।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর একচেটিয়া প্রাধান্য। সামরিক মহল এখনো, ভেতরে এবং বাইরে, দমন-পীড়নের ব্যাপারে অত্যন্ত বেপরোয়া এবং কাউকেই তোয়াক্কা করে না। শুধু চায়না-ই একমাত্র রাষ্ট্র, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পলিসিতে যার যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। কূটনৈতিক পরিসরে এবিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। কাশগরে এবং গোয়াদরে চায়নার নজরদারির ব্যাপারটি সবারই জানা। চিন, বার্মা, বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রতিও তাদের নজর রয়েছে। এই নজরদারি পূর্ণতা পেলে এই পুরো অঞ্চল অভিন্ন বাণিজ্যিক সূত্রে গাঁথা হয়ে যাবে। এই সব মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে আঞ্চলিক সুস্থিরতার বিকল্প নেই। চিনের নীরব কূটনীতিতে একে এড়িয়ে গেলে চলবে না। রোহিঙ্গা নেতৃত্বকে এই পরিস্থিতির গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার আজীবন অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তারা হাজার বছর ধরে মিয়ানমারের অধিবাসী। আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তাদেরকে নির্ভুল ও প্রভাবক কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। উত্তেজনাকর কর্মসূচির পরিণামে যে প্রতিক্রিয়া ও নিপীড়ন ফিরে আসে, তাতে বৈধ দাবিগুলোও চাপা পড়ে যায়। আবার হাজারের অধিক রোহিঙ্গা চোরাচালানির মতো নিষিদ্ধ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, এদের কেউ কেউ নিতান্ত বাধ্য, নিরুপায় বাঙালি। হাজার হাজার রোহিঙ্গা ও বাঙালি নিষ্ঠুর দরিয়ার করাল গ্রাসে তলিয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের মনে রাখা উচিত, বে-আইনি শরণার্থীদের কেউ আশ্রয় দিতে চায় না। সোশ্যাল মিডিয়ায় রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের যে বিবরণ এসেছে, যাচাইয়ের পর জানা গেল, তা অসত্য বা অতিরঞ্জন-মিশ্রিত। ইয়াঙ্গুনের মুসলিম দূতাবাসগুলোও এগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নি।

রোহিঙ্গারা অবশ্যই অধিকার পাবে। কিন্তু এর জন্য নির্ভুল উপায় অবলম্বন করতে হবে। কারণ, ভুল পথে হেঁটে হাজার বছর অতিক্রম করলেও গন্তব্যের দেখা মেলে না।

(ড. কিবলা আয়াজ, সাবেক ভিসি, পেশোয়ার ইউনিভার্সিটি, পাকিস্তান।)

برما میں مسلمانوں کا اصل مسئلہ کیا ہے

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×