পর্ব-১
প্রথম অধ্যায়- "লাল আপেল"
গাছের লাল আপেলটির দিকেই সবাই ঢিল ছুঁড়ে। -তুর্কি প্রবাদ
বসন্ত শুরু, ইস্তাম্বুলের বাতাসে কালো এক শঙ্খচিল উড়ছে। সুলেমানী মসজিদের মিনারগুলোর চারপাশে ডানার আঁচড়ে তৈরি করছে কতগুলো অদৃশ্য বৃত্ত।
শঙ্খচিলের চোখ পনেরো মিলিয়ন লোকের এ শহরের উপর। তীক্ষ্ন চাহনির মধ্য দিয়ে আমরা পিছিয়ে যাই সহস্র দিন। পিছিয়ে যাই চলুন কয়েক শতাব্দী।
১৪৫৩ সালের মার্চ মাসে এই পাখিটিরই কোন এক পূর্বপুরুষ হয়ত কোন এক ঠান্ডা দিনে কনস্ট্যান্টিনোপলের আকাশে এভাবেই উড়ছিল, তখন শহরটি হয়ত এতটা বিশৃঙ্খল ছিল না, কিন্তু চিরচেনা ছিল এমনই। জায়গাটি মনে রাখার মত। এক অসম ত্রিভুজের গঠন, ক্ষ্যাপাটে কোন গন্ডারের শিংয়ের মতো পূর্ব দিকে সামান্য উঁচু হয়ে সমুদ্রের দুপাশ রক্ষা করে চলেছে। উত্তরে গোল্ডেন হর্ন ঘিরে আছে গভীর-জলরাশি। দক্ষিণ দিকে মর্মর সাগরের নীল জল, দস্যু দার্দানেলিসের (সাগর) বাধা পেরিয়ে পশ্চিমে প্রেমিক ভূমধ্যসাগরের দিকে ছুটে চলেছে। এ যেন অদৃশ্য কোনও এক দুর্গ, দুইপাশে সমুদ্র ত্রিভুজটিকে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত। সমুদ্রের স্রোতের প্রবেশও এখানে বারণ, গন্ডারের শিংয়ের উপরে আছড়ে পড়ে ভেঙেচুরে যায়: এ শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রাকৃতিকভাবেই অভেদ্য, তার সাথে যোগ হয়েছে মানুষের গড়ে তোলা প্রতিরক্ষা ব্যূহ।
শহরের প্রাচীরগুলো সবচেয়ে অসাধারণ। দেয়ালগুলোর জটিল গঠনশৈলী, তিনস্তর বিশিষ্ট, ঘনিষ্ঠ দূরত্বে বসানো রয়েছে টাওয়ার। হর্ন থেকে মর্মর সাগর পর্যন্ত প্রসারিত খাদ। খাদ পেরিয়ে বাইরের শত্রুর আক্রমণ এখানে একপ্রকার অসম্ভব। -এই হলো সম্রাট থিওডোসিয়াসের হাজার বছরের পুরানো স্থল প্রাচীর, মধ্যযুগীয় বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর অটোমান তুর্কিদের কাছে এটি ছিল "তাদের গলার কাঁটা"!
যে মানসিক সমস্যা তাদের উচ্চাভিলাষকে দমিয়ে রাখত। সারা বিশ্বে বিজয়ের পতাকা উড়ানোর স্বপ্নকে শিকলে বেঁধে রেখেছিল যুগ যুগ ধরে । অপরদিকে পাশ্চাত্য খ্রিস্টানদের কাছে এটি ছিল ইসলামকে দমন করার বিরুদ্ধে পাঁয়তারার প্রাণকেন্দ্র । তারা মনে করত খোদ স্রষ্টা কনস্ট্যান্টিপোলকে ও এ শহরের জনগণকে মুসলিমদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রেখেছে। এ নিয়ে তাদের আত্মতুষ্টির শেষ ছিল না।
আবার, ১৪৫৩ এর বসন্তের দিকে ফিরে যাই। গোল্ডেন হর্নের একদম পাশের একটি ছোট্ট রাজ্য গালাতা। এ রাজ্যের দুর্গ ঘেরা শহরটির নাম জেনোস। জেনোস থেকে আপনি বুঝতে পারবেন ইউরোপের শেষটা কোথায় । বসফরাস, দুটি মহাদেশের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নিচু পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নদীর মত বয়ে গেছে। তারপর একসময় কৃষ্ণ সাগরে মিশেছে। অন্যদিকে রয়েছে এশিয়া মাইনর, আনাতোলিয়া - গ্রীক ভাষায় আক্ষরিক অর্থে পূর্বদিক। ৬০ মাইল দূরের মাউন্ট অলিম্পাসের তুষারাবৃত শিখরগুলি সূর্যের আলোতে ঝলমল করে।
ইউরোপের দিকে ফিরে তাকান যদি, দেখতে পাবেন, ১৪০ মাইল পশ্চিমে অটোমানদের শহর এডির্নের দিকে এ অঞ্চলটি প্রসারিত হয়ে আছে। আরেকটু ভালো করে চোখ মেললেই দেখা যাবে শহরের ট্র্যাকগুলিতে মার্চ করে আসছে বিশাল এক সেনাবাহিনী; মাথায় সাদা টুপি এবং লাল পাগড়ি। তাদের কারো হাতে তীর-ধনুক, কারো হাতে বর্শা, কারো হাতে বন্দুক। তাদের রোদের আলোতে তাদের চমকে উঠা ঢাল চোখ ঝলসে দেয়। তাদের ঘোড়াসওয়াররা যেন উঠে আসে মাটি ফুঁড়ে। রূপালী লোহার বর্মে প্রতিফলিত হয় যে সূর্যের আলো, তাও ম্লান হয়ে পড়ে।পেছেন খচ্চর, ঘোড়া আর উটের সারি। তাতে বোঝাই করা যুদ্ধের সমস্ত সরঞ্জাম আর নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাব। সৈন্যদের সাথে আছে সহযোগী কর্মীরা - তাদের কেউ খননকারী, কেউ রাঁধুনী, কেউ পাহারাদার, কেউ ইমাম, কেউ মিস্ত্রী। যুদ্ধের লুট শিকারিও বাদ যায়নি দল থেকে। শত শত সৈন্য আর তাদের বাহক প্রাণীগুলো নরম জমির উপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে বারবার থেমে যাচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে জিরিয়ে নিচ্ছে।...মধ্যযুগীয় পৃথিবীর পরাক্রমশালী অটোমানরা এগিয়ে আসছে।
একসময় চোখের সীমানায় ধরা দেয় সেনাদলের প্রতিটি কদম। দারদানেলিসের ঝড়ো বাতাসের উল্টো দিক হতে অলস গতিতে আসছে এক বিশাল জাহাজ বহর। দূর হতে মনে হয় মধ্যযুগীয় চিত্রশিল্পীর কোন আঁকা ছবি। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এ জাহাজ কৃষ্ণ সাগর হতে ছুটে আসা। রণসাজে সজ্জিত জাহাজে আছে কাঠ, খাবার আর কামানের গোলা। অটোমানদের খোলা তলোয়ারের ইশারায় জাহাজ তীরে থামে। আনাতোলিয়া ছেড়ে আসা রাখাল, শায়খ, নাবিক আর বেদুঈন, দলে দলে মালভূমির গা ঘেঁষে বসফরাসের তীরে নামে। এত সাজ সাজ রব, এই যুদ্ধের দামামা আর প্রতিটি চোখে একটাই লক্ষ্য : বাইজানটিয়ামের প্রাচীন সাম্রাজ্যের রাজধানী- কনস্টান্টিনোপল।
মধ্যযুগের দুটি প্রধান ধর্মের মানুষের এ লড়াইয়ের পেছনে একটাই কারণ- তীব্র ধর্মবিশ্বাস । মহাপুরুষদের করে যাওয়া ভবিষ্যদ্বাণী আর সৌভাগ্যের সন্ধান।
কনস্টান্টিনোপলে থাকা প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভ এবং মূর্তিগুলিকে ভাবা হত যাদুবিদ্যার উৎস। লোকেরা সেখানে রোমান টেম্পলগুলিতে বর্ণিত গল্প হতে খুঁজত ভবিষ্যত, যদিও সে গল্প এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আবহাওয়ার লক্ষণ দেখে সামনের দিনগুলোর অর্থ বের করত এখানকার মানুষ।
১৪৫৩ এর বসন্ত প্রাণহীন ছিল। চারদিক স্যাঁতস্যাঁতে আর ঠান্ডা বাতাস। মার্চ মাসেই বসফরাসের উপর কুয়াশা যেন এক দেয়াল গড়ে তুলেছিল। সাথে তো আছে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প আর প্রবল তুষারপাত। শহরের লোকদের মাঝে ভর করেছিল এক অদৃশ্য ভয়। নিশচয়ই খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে, হতে পারে পৃথিবীর ধ্বংস হওয়ার পালা এসেছে।
অপরদিকে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হওয়া অটোমানদেরও ছিল প্রবল ধর্মবিশ্বাস। তাদের আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল কনস্ট্যান্টিনোপল। তুর্কিদের কাছে এ শহরের একটা সুন্দর নাম ছিল - "লাল আপেল"। একে ভাবা হত বিশ্ব শক্তির প্রতীক। পাশাপাশি তাদের মধ্যে ইসলামী এক ভবিষ্যদ্বাণীও ছিল সকল প্রেরণার উৎস। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় ৮০০ বছর পূর্বে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তাই যে এ শহর জয় করবে তার সামনে ছিল কিংবদন্তি হওয়ার হাতছানি। আর তুর্কিদের মুখে মুখে ঘুরত সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কথা ।
অটোমানদের কল্পনায়, লাল আপেলের অবস্থান শহরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে। সেন্ট সোফিয়ার প্রধান গির্জার বাইরে ১০০ ফুট উঁচু সম্রাট জাস্টিনিয়ার ব্রোঞ্জনির্মিত এক বিশাল অশ্বারোহী মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। একে বলা হত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শক্তির প্রতীক এবং প্রাচ্যের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান প্রতিরক্ষা দেয়ালের দম্ভচিহ্ন। ষষ্ঠ শতাব্দীর লেখক প্রোকোপিয়াসের মতে, এটি ছিল সত্যিই অবাক হওয়ার মত।
ঘোড়াটির মুখ ছিল পূর্ব দিকে, যার একটি তাৎপর্য আছে। আর ঘোড়ার উপরে ছিল সম্রাটের বিশাল এক মূর্তি, গায়ে জড়ানো ছিল গ্রীকবীর একিলীসের মত পোশাক। বুকের বক্ষস্ত্রাণ বীরযোদ্ধাদের মত; মাথাটির চকচকে হেলমেটটি যেন একটু নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে । মূর্তির চোখ দুটি উদীয়মান সূর্যের দিকে , যে কারো মনে হবে সম্রাটের চোখ পারস্য সাম্রাজ্যের দিকে (বর্তমান ইরান)। তাঁর বাম হাতে ধরা একটি পৃথিবী। সমস্ত পৃথিবী ও সমুদ্র তাঁর অধীনে, যদিও তার কাছে তরোয়াল বা বর্শা বা অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। কেবল পৃথিবীর উপরে একটা ক্রুশ গাঁথা ছিল। ক্রুশের (খ্রিস্টানিটি) বাণীর মধ্য দিয়ে রাজত্ব দখল যেন তাঁর লক্ষ্য।
জাস্টিনিয়ানের হাতে ধরা ক্রুশ গাঁথা পৃথিবীটাই অটোমানদের "লাল আপেল"। এই লাল আপেল দখলের জন্যই এত আত্মত্যাগ, এত রক্তাক্ত ইতিহাস।
অবরোধের ভয় বাইজেন্টাইনদের মাথায় গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছিল। সেই মিথ্যা জুজুর ভয় তাদের গ্রন্থাগার, তাদের মার্বেল পাথরের রুম এবং তাদের মোজাইক করা চার্চগুলিতে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ে। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো এটা যে কুসংস্কার তারা ভালো করেই জানত।
১৪৫৩ এর বসন্ত পর্যন্ত মোট ১১২৩ বছরে শহরটি প্রায় তেইশ বার ঘেরাও করা হয়েছিল। এই শহরের পতন মাত্র একবার হয়েছিল - তবে তা আরব বা বুলগারদের কাছে নয়। চতুর্থ ক্রুসেডের সময়- খ্রিস্টান নাইটদের কাছে। চতুর্থ ক্রুসেড খ্রিস্টান ইতিহাসের এক উদ্ভট পর্বের নাম। তার গল্প অন্যকোনদিনের জন্য তুলে রাখি। এ নগরীর প্রাচীর কখনও ভাঙেনি, তবে পঞ্চম শতাব্দীর এক ভূমিকম্পে কিছুটা মাটিতে বসে গিয়েছিল। অন্যথায় দেয়ালগুলো আরো মজবুত থাকত। হয়ত শক্ত দেয়াল সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের (ফাতিহ সুলতান) সেনাবাহিনীকে আরো কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারত।
কেন এই যুদ্ধ হয়েছিল এবং এরপরে কি ঘটেছিল তা এই বইয়ের বিষয়। এ যুদ্ধ মানুষের সাহস এবং নিষ্ঠুরতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, ভাগ্য, কাপুরুষতা, কুসংস্কারের এক রহস্যময় গল্প। এর মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের পালাবদল আসে, পাশাপাশি অনেকগুলি বিষয়কেও স্পর্শ করে: সেগুলো হলো- বন্দুকের বিকাশ, অবরোধ যুদ্ধের কলা, নৌ কৌশল, ধর্মীয় বিশ্বাস, পৌরাণিক কাহিনী এবং মধ্যযুগীয় মানুষের কুসংস্কার।
তবে মোটের উপর এটি এমন এক স্থানের গল্প - যেখানে সমুদ্র স্রোত, পাহাড়, উপদ্বীপ এবং আবহাওয়ার অদ্ভুত খেলা চলে - যেখানে নতুন দ্বীপ উত্থিত হয় আবার তলিয়ে যায়। এখানে শুধুমাত্র একটি প্রনালীর জন্য দুটি মহাদেশ ভূমি এত সংকীর্ণভাবে ভাগ হয়ে যায় যে "যারা প্রায় একজন আরেকজনের গা ছোঁয়ে ছিল"। এ এক শক্তিশালী নগরীর গল্প যার পাথুরে উপকূল আর ভূতত্ত্বের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এখানে আক্রমন করা তুলেছে অসম্ভব। এ একসময় এক সম্ভাবনাময় ভূমি ছিল - বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং খাদ্যশস্য সবকিছুর জন্য - এজন্য কনস্টান্টিনোপল হয়েছিল সাম্রাজ্যীয় নিয়তির মূল চাবিকাঠি। আঁচল পাততে আসতে হত বহু সেনাবাহিনীকে, কনস্ট্যান্টিনোপলের দুয়ারে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৫৯