somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৪৫৩- ফাতিহ সুলতানের কনস্ট্যান্টিনোপল জয় ও ইসলাম বনাম ক্রিশ্চিয়ানিটি

০২ রা অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১০:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পর্ব-৭

ওসমান গাজী স্বপ্নে দেখলেন, "দুটি সমুদ্র এবং দুটি মহাদেশের সংযোগস্থলে অবস্থিত এক শহর, যেন দুটি নীলকান্তমণি এবং দুটি পান্নায়ের মধ্যে বসানো একটি হীরা এ মূল্যবান পাথরে বানানো এ আংটিটি পুরো বিশ্বকে যেন আঁকড়ে ধরে আছে।" ওসমান তুর্কি গাজীদের অসমাপ্ত দায়িত্ব নিজের ঘোড়ার উপর চড়ালেন, তাঁর জাতি তাঁর যেকোন নির্দেশ শুনতে প্রস্তুত ছিল। ভাগ্য এবং সমান পরিমাপের দ্রুত উপস্থিত -বুদ্ধি ওসমানের রাজ্যকে একটি ক্ষুদ্র এলাকা থেকে স্বপ্নের বিশ্ব শক্তিতে রূপান্তরিত করে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আনাতোলিয়ায় ওসমানের রাজ্যটি সরাসরি বাইজেন্টাইন প্রতিরক্ষা দেয়ালের মুখোমুখি হয়েছিল। "অবিশ্বাসী খ্রিস্টানদের" জমিটির গাজীদের তীব্র আকাঙ্খার বস্তুতে পরিণত হয়। আর ওসমানীয় বাহিনীতে থাকা সব লোকদেরকে আরো দু: সাহসিক করে তুলে। তাদের ভেতরের রাজ্য দখলের ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দেয়। আর ওসমান হয়ে ওঠে তাঁর জনগণের অবিসংবাদিত নেতা।

একই সময়ে অটোমানরা প্রতিবেশী বাইজেন্টাইন রাষ্ট্রগুলোর কাঠামো ও স্থাপত্যশৈলী গভীরভাবে অনুকরণ করার সুযোগ পায়। উপজাতিটি সত্যিকার অর্থেই "ঘোড়ার উপর", থেকেই বাইজেন্টাইনদের প্রযুক্তি, পরিকল্পনা ও কৌশলগুলি অসাধারণভাবে আয়ত্ত্ব করে। ১৩০২ সালে ওসমান বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে প্রথম জয় লাভ করে। এতে তাঁর প্রতিপত্তি বেড়ে যায় ও তাঁর দল ভারী হতে থাকে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে বাইজেন্টাইনের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিরক্ষা ততদিনে অনেকটাই ভেঙে গেছে। এসময় বুরসা শহরকে আলাদা করতে ওসমান আক্রমণ করেন। কিন্তু অবরোধের প্রযুক্তির অভাবের কারণে, প্রায় সাত বছরের অবরোধ শেষে ১৩২৬ সালে ওসমানের পুত্র ওরহান শহরটি দখল করেন। এবং ওসমানীয় উপজাতি তাদের ছোট রাজ্যের জন্য একটি রাজধানী অর্জন করে। ১৩২৯ সালে ওরহান তৃতীয় সম্রাট আন্ড্রোনিকোস পেলেকানোসকে পরাজিত করেন এবং বাইজেন্টাইন তার অবশিষ্ট আনাতোলিয়ান শহরগুলিকে হারাতে শুরু করে। একটার পর একটা শহরের তাসের ঘরের মত পতন হতে থাকে - ১৩৩১ সালে নিকিয়া, ১৩৩৭ সালে নিকোমেডিয়া এবং পরের বছর স্কুটারি। মুসলিম যোদ্ধারা আস্তে আস্তে তাদের ঘোড়াগুলিকে তাদের নিজেদের এলাকায়, সমুদ্রের উপকূল ধরে ছুটাতে শুরু করে। আর তাদের চোখ চলে যায় ইউরোপের বসফরাস পেরিয়ে ওপারে। কনস্ট্যান্টিনোপল কবে তাঁদের হবে: কবে সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে দেয়ালগুলোতে , সেন্ট সোফিয়ার বিশাল গম্বুজের উপর, এবং প্রাসাদগুলির উপর নিজেদের পতাকা উড়বে তার অপেক্ষায় দিন গুণতে থাকে। একেকটা শহর দখল হওয়ার সাথে সাথে গ্রীক নামগুলি বদলে গিয়ে তুর্কি স্বরবর্ণ সেখানে জায়গা নেয়। স্মির্ণা হয়ে যায় ইজমির; নিকিয়া - হয়ে যায় - ইজনিক; ব্রুসার ব্যঞ্জনবর্ণগুলি পাল্টে হয় বুরসা।

কনস্টান্টিনোপলকে, যদিও ওসমানীয়রা আরবি নাম "কোস্টান্টিনিয়িয়ে" নামে ডাকত কিন্তু তা কিভাবে তুর্কি ভাষায় ইস্তাম্বুলে রূপান্তরিত হয়েছিল তা আজও অস্পষ্ট। শব্দটি কনস্ট্যান্টিনোপলের একটি সাধারণ বিকৃতি হতে পারে বা অন্যরকমভাবে সৃষ্টি হতে পারে। গ্রীকরা কনস্টান্টিনোপলকে "পোলিস" বা শহর হিসাবে ডাকত। ধারণা করা হয় কোন একজন গ্রীক বলেছিলেন যে তিনি "ইস তিন পলিন” - বা "শহরে যাচ্ছেন" - যা শুনে তুর্কীরা ভেবেছিল "ইস্তানবুল"। আরো অনেক অনেক ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। সেগুলোতে আর না যাই।

অটোমানদের ঘোড়ার গতি সাত শতাব্দী আগের আরবদের থেকে বেশি ছিল। ১৩৩১ সালে মহান আরব পরিব্রাজক ইবনে বতুতা যখন ওরহানের রাজত্বে এসেছিলেন, তখন তিনি তাঁর (ওরহানের) জীবনীশক্তি ও ক্ষিপ্রতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন: “বলা যায়, যে তিনি কোনও এক শহরে পুরো মাস কখনও অবস্থান করত না। তিনি প্রায় সময়ই খ্রিস্টানদের সাথে লড়াই করতেন এবং তাদের কোন না কোন অঞ্চল জয় করতেন। ” প্রথমদিকে অটোমানরা নিজেদের গাজি হিসাবে দাবি করত; ইসলামের সবুজ পতাকাই তাদের পতাকা ছিল।শীঘ্রই তারা সুলতান উপাধি ধারণ করে। ১৩৩৭ সালে ওরহান বুরসায় একটি শিলালিপি স্থাপন করেন, "সুলতান, গাজিদের সুলতানের পুত্র, গাজীর পুত্র গাজী, দিগ্বিজয়ী, বিশ্বের মহানায়ক।"

এটি প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিজয়ের এক নতুন যুগ শুরু হয়। রাজনৈতিক ইসলাম তার পুরোনো রূপ ফিরে পেতে থাকে। সুফীসাধক আহেমেতি, ১৪০০ সালের কাছাকাছি লিখেছিলেন, "গাজী হ'ল আল্লাহর তরবারী, তিনি মুমিনদের রক্ষাকারী এবং আশ্রয়স্থল। যদি তিনি আল্লাহর পথে শহীদ হন, তবে বিশ্বাস করবে না তিনি মারা গেছেন - তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান এবং তাঁর জীবন অনন্তকালের । "

ক্রমাগত বিজয় আনাতোলিয়ার ধুলোমাখা রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জীর্ণ পোশাকের যাযাবর ও সুফী দরবেশদের মধ্যে এক বুনো প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে। সৃষ্টি করে এক উন্মাদনা। বাতাসে ভাসতে থাকে ভবিষ্যদ্বাণী আর বীরত্বপূর্ণ গান । তারা কনস্ট্যান্টিনোপল জয় এবং লাল আপেলের লোককাহিনী নিয়ে হাদীসটি বারবার মনে করিয়ে দিত। ১৩৫০ এর দশকে সম্রাট জন ক্যান্টাকুজেনোস, ওরহানের বাহিনীকে বাইজেন্টাইন রাজ্যের অন্তর্বর্তী গৃহযুদ্ধ থামাতে, সাহায্য করার জন্য ডাকল। ৭১৭ সালের পরে এই প্রথমবারের মতো মুসলিমরা দার্দানালিস পেরিয়ে ইউরোপে পা রাখল। ১৩৫৪ সালে গালিপলির দেয়াল ধ্বসে গেল ভূমিকম্পে আর সাথে সাথে সুফীরা, এটিকে মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর নিদর্শন বলে ঘোষণা করল এবং দলে দলে মুসলিম সেনাবাহিনী শহরে বিনা বাধায় প্রবেশ করল। এভাবেই ইউরোপে মুসলিম যোদ্ধা আর সুফী দরবেশদের আগমন শুরু।

১৩৫৯ সাল। ৬৫০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত কনস্ট্যান্টিপোলের দেয়ালের বাইরে মুসলিমদের পতাকা দেখা গেল। হাজার বছরের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সব আবার লোকের মুখে মুখে শোনা যেতে লাগল।

"গাজিরা সবার পরে কেন কনস্ট্যান্টিনপোলে এসেছে?" দরবেশ আহমেতিকে সবাই জিজ্ঞাসা করলো।

“কারণ সবসময় সেরা মানুষটি শেষে আসে। সব নবীর পরে যেমন নবী মুহাম্মদ (স) এসেছিলেন, যেমন কোরআন তওরাত, যাবুর এবং ইঞ্জিলের পরে বেহেশত থেকে নেমে এসেছিল, তেমনি গাজীরাও শেষের দিকে হাজির হয়েছে। " হাসিমুখে আহমেতি জবাব দিলেন। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১০:০৯
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×