somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৪৫৩- ফাতিহ সুলতানের কনস্ট্যান্টিনোপল জয় ও ইসলাম বনাম ক্রিশ্চিয়ানিটি

০৫ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পর্ব-৮
কনস্ট্যান্টিনোপল দখল ছিল সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা স্বপ্ন। ইতিহাসবেত্তাদের মতে, অটোমানদের ঘোড়ার গতি অলৌকিক কিছু ছিল না । ভূগোল, রীতিনীতি, কৌশল এবং ভাগ্য সবদিক থেকে অটোমানরা বাইজেন্টাইন রাজ্যের থেকে ভাল অবস্থানে ছিল। অটোমানদের প্রথম দিককার সুলতানরা, তাদের সৈন্যদের সাথে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তাদের মধ্যে বুঝাপড়া ভালো ছিল। তারা বাসও করতেন পাশাপাশি। তাদের চারপাশের রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি এবং সম্ভাবনার প্রতি সবসময় মনোযোগ থাকত। বাইজান্টাইনরা যেখানে হাজার বছরের অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্যকে সাধারণ মানুষ হতে আড়াল করে রাখত, সেখানে অটোমানরা বুদ্ধিমান, নমনীয় এবং উন্মুক্ত ছিল। ইসলামের বিধানে বিজিত অঞ্চলের মানুষদের উপর দয়া করার আদেশ ছিল এবং অটোমানরা তাদের প্রজাদের হালকা হাতে শাসন করত যা ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের কাছে প্রায়শই পছন্দনীয় মনে হত। জনগণের সিংহভাগই ছিল খ্রিস্টান অথচ তাদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার কোন প্রচেষ্টা করা হচ্ছে না - বাস্তবে এটিকে ইউরোপীয়ানরা অযৌক্তিক ভাবত।

শরিয়া আইন অনুযায়ী মুসলমানদের ইউরোপীয়দের মতো ভারী কর আদায় করা সম্ভব ছিল না। বলকানের কৃষকরা সামন্ততান্ত্রিক দাসত্বের জোয়াল থেকে মুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিল। একই সময়ে অটোমানরা ইসলামের নিয়মানুযায়ী সবার জন্য সমান সুবিধা প্রদান করেছিল। অন্যান্য তুর্কি সাম্রাজ্যের বিপরীতে, প্রাথমিক অটোমান সুলতানরা কখনও রাজ্যের উত্তরাধিকারীদের রাজ্য বিভক্ত করে দেননি। আবার তারা কোনও উত্তরসূরিকে মনোনীতও করেনি। সমস্ত পুত্র শাসন করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তবে কেবল একজনই সিংহাসন নিতে পারেন - এমন একটি পদ্ধতি যার মূলনীতি ছিল-যোগ্যরাই বেঁচে থাকবে। পাশ্চাত্যদের জন্য সবচেয়ে চমকপ্রদ, অটোমানরা বিয়ের মাধ্যমে উত্তরসূরির ঠিকের কোনও মনোযোগ দেয় নি। বাইজান্টাইন সম্রাটরা অন্যন্য ইউরোপের শাসকগোষ্ঠীর মতো রাজবংশীয় বিবাহ এবং বৈধ উত্তরাধিকারকে রক্তসূত্রে সুরক্ষিত করার জন্য সচেষ্ট থাকতেন। সেদিকে অটোমানদের এসব নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। একজন সুলতানের পিতা স্বাভাবিকভাবেই পূর্বের সুলতান হতেন, তবে তাঁর মা হেরেমের উপপত্নী বা ক্রীতদাসীদের একজন হলেও হতে পারেন, কখনও জন্মগতভাবে মুসলিমও নন। তাই জিনগতভাবে অটোমানদের মধ্যে অনেক জাতির বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটেছে।

অটোমানদের সমস্ত উদ্ভাবনের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল তাদের নিয়মিত সেনাবাহিনী ।গাজী যোদ্ধাদের প্রথমদিকের সেনাবাহিনী অটোমান সুলতানদের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার ক্ষেত্রে খুব একটা উপযুক্ত ছিল না। সুরক্ষিত শহরগুলিকে ঘেরাও করার জন্য ধৈর্য, ​​পদ্ধতি এবং বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন ছিল। চৌদ্দ শতাব্দীর শেষের দিকে সুলতান মুরাত প্রথম একটি নতুন সামরিক বাহিনী গঠন করেন। বলকান রাজ্য থেকে যুদ্ধ পরাজিত বন্দীদের এনে গঠন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে খ্রিস্টান শিশুদের আনা হত, এদেরকে ইসলামে দীক্ষা দেয়া হত। তুর্কি ভাষা, রীতিতে এরা বড় হয়ে উঠত। এদেরকে পরিবার থেকে একদম আলাদা করে ফেলা হত। এরা কেবল সুলতানের প্রতি দায়বদ্ধ ছিল। তারা ছিল সুলতানের ব্যক্তিগত বাহিনী: "দ্বার রক্ষাকারী” " এরা মূলত ছিল পদাতিক ইউনিট, যাকে ইয়েনি চেরি বা জেনসেরি বলা হত। অশ্বারোহী বাহিনী ও জেনিসেরিদের নিয়ে রোমানদের সময় থেকে তখন পর্যন্ত ইউরোপে প্রথম পেশাদার বেতনভুক্ত সেনাবাহিনী গঠন করে অটোমানরা । অটোমান রাষ্ট্রের বিস্তৃতিতে এদের ভূমিকা ছিল অসীম। এটি ছিল অটোমানদের নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ কৌশল। কেননা, তুর্কিরা নিজেরাই একসময় ইসলামিক বিশ্বের সীমান্তে সামরিক দাস হিসাবে ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু খ্রিস্টানদের কাছে প্রক্রিয়াটি দূর থেকে দেখা কষ্টের ছিল। তাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। এসব সৈন্যরা কোন না কোন খ্রিস্টান ঘরে জন্ম নিয়েছিল কিন্তু তাদেরকেই আবার খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউরোপীয়দের কাছে ব্যাপারটা অমানবিক ছিল।"সেভেজ তুর্কস" বা "অসভ্য তুর্কীর দল" নামে যে মিথ ইউরোপে চালু হয়েছিল, তার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল জেনেসেরিরা।

"তুর্কি" শব্দটি পাশ্চাত্যের তৈরি। এ শব্দ ইউরোপীয়দের অভিধান থেকে নেয়া। অটোমানরা খুব সম্ভবত ব্যবহার এ শব্দ ব্যবহার করেনি। তাদের কাছে এ শব্দ অপমানকর ছিল।

পরিবর্তে, তারা এমন নাম বেছে নিয়েছিল যা কোন জাতিগত বা অঞ্চলগত নয়। যা তাদের ঐতিহ্য, ধর্ম ও বহুজাতিক সেনাবাহিনীর প্রতিফলন ঘটায়।

প্রাথমিকভাবে নামকরণটি ধর্মীয় ছিল, উসমানীয় সুলতানরা তাদেরকে "ইসলামের রক্ষক" হিসাবে বর্ণনা করত, তাদের সাম্রাজ্য ছিল ইসলামের ভূমি আর তাদের জনগণ হলো মুসলমান বা অটোমান। অটোমানদের সাম্রাজ্যের পুরো ব্যবস্থাই ছিল আজব। একাধারে তুর্কি জাতীয়বাদ, সুন্নি ইসলাম, পারস্যের আইন ব্যবস্থা, বাইজেন্টাইন প্রশাসন, কর আদায় পদ্ধতি, আবার আরবি ও ফারসি বর্ণমালার সাথে তুর্কি ভাষা মিশিয়ে, তারা নিজস্ব একটি পরিচয় তৈরি করে।

বিভক্তি, গৃহযুদ্ধ, জনসংখ্যা হ্রাস এবং দারিদ্র্যের কারণে কনস্ট্যান্টিনোপল ধ্বংসের মুখে পৌঁছে গিয়েছিল।১২৮৪ সালে, সম্রাট অ্যান্ড্রোনিকোস সাম্রাজ্যের নৌবাহিনীকে বিলুপ্ত করার এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কর্মহীন,বেকার নাবিকরা অটোমানদের দলে যোগ দেয়া শুরু করে। তৈরি হয় অটোমানদের এক শক্তিশালী নৌ বহর।

১৩৪১ থেকে ১৩৭১ এই বছরগুলিতে আমরা গৃহযুদ্ধের ভয়ানক রূপ দেখতে পাই। সাথে উসমানীয়দের এবং শক্তিশালী সার্বিয়ান রাষ্ট্রের চোখ রাঙানি তো ছিলই। এর মধ্যে দেখা দেয় প্লেগ। ইতিহাস যাকে "ব্ল্যাক ডেথ" নামে চিনে। কনস্টান্টিনোপলই ছিল ইউরোপের প্রথম শহর যা ব্ল্যাক ডেথের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। কাফার কৃষ্ণসাগর বন্দর হতে ইঁদুরগুলি জাহাজে লাফিয়ে উঠেছিল। তারপর ছড়িয়ে যায় সবখানে। জনসংখ্যা কমতে কমতে ১,০০,০০০ এর নিচে নেমে যায়। অন্যদিকে কনস্টান্টিনোপলকে একের পর এক ভূমিকম্প বিধ্বস্ত করে - শেষ পর্যন্ত সেন্ট সোফিয়ার গম্বুজটি ১৩৪৬ সালে ধসে পড়ে । "খাঁটি সোনার" শহরটি ক্রমশঃ নিঃস্ব ও নিরাশার শহর হয়ে ওঠে, পাশাপাশি এখানকার বাসিন্দারা ধর্মীয়ভাবেও হতাশ হয়ে পড়ে। যারা তখন শহরে গিয়েছিলেন তারা জায়গাটির "ভুতুড়ে চেহারা"র বর্ণনা দিয়েছেন। ইবনে বতুতা বলেছেন তিনি কোন শহর দেখেননি, সেখানে ছিল তেরটি গ্রামে বিভক্ত একটি এলাকা।

স্প্যানিশ পরিব্রাজক পেড্রো তুফোর লিখে গেছেন, " সম্রাটের প্রাসাদ দেখেই বুঝা যায় এ শহরের সম্রাট ও জনগণ কতটা খারাপ অবস্থায় আছে... শহরে খুবই কম লোকের বাস ... বাসিন্দারা খুব ভাল পোশাক পরে না, তাদের দেখেই বোঝা যায় আর্থিক অবস্থা খারাপ," সাথে সাধারণ খ্রিস্টান মানসিকতা থেকে এও বলেছিলেন, "তাদের এরকম হওয়া ঠিকই আছে, এটাই তাদের প্রাপ্য। কারণ এ শহরের অধিবাসীরা পাপাচারী, পাপ তাদের গ্রাস করেছে।" শহরের অবস্থা আসলে এমন হয়েছিল, যেন কোন বুড়ো হয়ে যাওয়া লোক তার যুবক সময়ের পোশাক পড়ে আছে। সম্রাটরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের নিজের বাড়ীতেই শাসনকাজ চালাত।

কথিত আছে, ১৩৪৭ সালে সম্রাট জন ষষ্ঠ ক্যান্টাকুজেনোসের রাজ্যাভিষেকের সময় যে মুকুট পরানো হয় তা কাঁচের তৈরি ছিল। অতিথিদের খাবার দেয়া হয়েছিল মাটির প্লেটে। গৃহযুদ্ধের মূল্য দিতে গিয়ে সোনার বাসনগুলো বিক্রি করতে হয়েছিল। সাম্রাজ্যের রত্নগুলি সব, ভেনিসীয়রা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো নিয়ে রাখা হয়েছিল নিজেদের সেন্ট মার্কের গীর্জার কোষাগারে।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ২:২৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটা গাছ কাঠ হলো, কার কী তাতে আসে গেলো!

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:০৬



ছবিঃ একটি ফেসবুক পেইজ থেকে

একটা গাছ আমাকে যতটা আগলে রাখতে চাই, ভালো রাখতে চাই, আমি ততটা সেই গাছের জন্য কিছুই করতে পারিনা...
তাকে কেউ হত্যা করতে চাইলে বাঁধাও দিতে পারিনা...
অথচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×