সাইকেল চেপে রহিমুদ্দিন মহাসড়ক দিয়ে টেনে যাচ্ছে রফিক। কয়েকরাত ও ঘুমাতে পারেনি। চোখ লেগে আসছে। পথগুলো ওর খুব চেনা। মানুষ গুলোও চেনা থাকতো কিন্তু এই রাতে বলা চলে কাউকে দেখা যাচ্ছে না রাস্তায়। ৪ দিন আগে গ্রাম থেকে একটা খবর পাঠিয়েছিলেন মা, খুব নাকি দরকার ওকে। কিন্তু অফিসে চেষ্টা করেও ছুটি পায়নি। ওর গ্রাম বেশি দূরে না, কিন্তু ওর অফিস যখন ছুটি হয় তখন গ্রামে বাস বা গাড়ি কোনটাই পাওয়া যায়না। কিন্তু আজ মার জন্য মন কেমন যেন করছে। ওদের গ্রামের রাস্তাটা খুব উঁচু নিচু, মহা সড়কের সংস্করণ না হওয়ায় এখনো জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট গর্ত হয়ে আছে তাই সাইকেল চালাতেও খুব সমস্যা হচ্ছে ওর। চোখ লেগে থাকা বন্ধ করার জন্য রাস্তার পাশে সাইকেল থামিয়ে পকেট থেকে ক্যাপস্টেন সিগারেট বের করে মুখে নিয়ে আগুণ জ্বালাল। ও জানে ওদের এই রাস্তাটা ভালো না। মাঝে মাঝেই নাকি অতিপ্রাকৃতিক কাণ্ড ঘটে। কিন্তু ওর মাথায় আজ সেগুলো নিয়ে ভাবার কোন সময় নেই ওর প্রধান চিন্তা ওর মাকে নিয়ে, কখন মা কে দেখবে।
*
সুখ টান দিতে দিতে চারপাশ একটু নজর ঘুরালো। দুই পাশে ধানক্ষেত এবং তারপরে ভিটে জমি গুলো চাঁদের আলোতে দেখাচ্ছে জঙ্গলের মত। শেষ ৩ মাস আগে এই রাস্তা দিয়েই শহরে পারি জমিয়েছিল। গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারে ওর সংসারে ওর মা বাদে আর কেউ নেই। বাবা মারা যাওয়ার পড়ে জমিজমা যা ছিল তা ওর বাবার ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়েই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। কিন্তু তাও পুরোটা পরিশোধ করতে পারেনি। আর সব কিছু থেকে রেহাই পাওয়া যায় কিন্তু গ্রামের সমিতির থেকে লোণ নিয়ে ওই টাকা পরিশোধ করা বাদে রেহাই পাওয়া অসম্ভব। কিছুদিন ও গ্রামে থেকেই অন্যজনের জমিতে চাষবাস করেছে, কিন্তু অন্যজনের জমি চাষ করে আর কতই বা টাকা পাওয়া যায়। সেখান থেকে সমিতির ঋণের টাকা শোধ করা এবং মায়ের ওষুধের টাকা যোগাতে গিয়েই ওর হিমশিম খেতে হতো। আর খাওয়া দাওয়ার টাকা তো আলাদাই। দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু পেটে খাবার ছাড়া বেঁচে থাকা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব না। ওর সিগারেট খাওয়া শেষ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো দূর থেকে মেঘেরা চাঁদ কে ধাওয়া করার জন্য এগিয়ে আসছে আস্তে আস্তে। “ভাগ্য ভালো একটা সিগারেট লইয়া আইছিলাম। এখন ঘুম ঘুম ভাব টা একটু কাটছে। যাই আবার রওনা দেই অনেক দূর যাওয়া লাগবো" মনে মনে এটা বলে সাইকেলে চেপে বসল। রাত অনেক হয়েছে। একটু পর পর আকাশে মৃদু মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। হয়তো দূরে কোথাও বাজ পড়েছে। শহরের স্ট্যান্ডে যেসব বাছ গুলো রাখা হয় তাদের কয়েকটা শহরের দিকে ফিরে যাচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা থাকার কারণে দুয়েকটা প্রায় ওর কাছ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে দ্রুত। হয়তো বা ওকে খেয়াল করে না। কিছুক্ষণ আগে একটা ট্রাক তো আর একটু হলে ওর উপর দিয়েই উঠিয়ে দিত । ধাক্কা খেয়ে পরে যাচ্ছিলো পাশের ধান খেতে, কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বাঁচিয়েছেন ওকে মনে হচ্ছে। ও কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার রওনা দিল ওর বাড়ির জন্য। ও যত দ্রুত সম্ভব সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হতে পারে। বৃষ্টি বললে ভুল হবে যেই পরিমাণ বাতাস তা থেকে ঝড় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনেক্ষন যাওয়ার পরে ও রাস্তার পাশে একজন পাঞ্জাবি পায়জামা পরা বুড়ো লোক কে দেখতে পারলো। লোকটা ওকে হাত নেড়ে থামার জন্য ইশারা করছে। ও সাইকেলটা লোকটার সামনে নিয়ে থামালো, লোকটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
"বাবা কই যান?" লোকটি বললো।
"গোপিপুর, আপনে এই রাইততে এইহানে কি করেন"
"আমিও বাবা গোপিপুর যামু। আমারে একটু সাইকেলের পিছনে কইরা নামায় দিবেন? বৃষ্টি শুরু হইতে পারে। আর এই যায়গা আমার ভালো ঠেক্তাছেনা।"
"গোপিপুরে আপনার কি? আপনারে তো মনে হয়না অইহানে দেখছি কুনু সময়"
"বাবা আমার নাতিন থাকে অইখানে। একটু লইয়া চলেন না?"
রফিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনাকে পিছনে উঠতে বললো। লোকটা ওর পিছনে উঠার পরে আবার সাইকেল চালানো শুরু করলো। অনেক্ষন যাওয়ার পড়ে রফিকের পেছনে বসা বুড়ো লোকটা ওকে জিজ্ঞেস করলো,
"বাবা গোপিপুরে কি আপনের বাড়ি?"
"জি"
"কে কে থাকেন?"
"আমি আর আমার মা। আপনি কাদের বাড়ি যাইবেন? আপনার নাতিনের নাম কি?"
"ওরা নতুন গেছে গোপিপুরে। আপনারে দেইখা মনে হইতাছে শহরের চাকরি করেন। আপনি মনে হয় চিনবেন না”।
রফিক শুধু "ও" বোলে কথা থামিয়ে দিল। কারণ ওর এখন ইচ্ছা বৃষ্টি নামার আগে ওর মার কাছে পৌঁছানো।
"বাবা। আপনি আপনার মা রে অনেক ভালোবাসেন তাইনা?”
"হ"
"তো কিছু নিছেন মায়ের লাইগা শহর থেইকা?"
"না টাকা নিয়া আইছি। কালকে গোপিপুরে হাটবার হাটেরথন কিনুম। আর চাচা আপনি একটু চুপ করলে আমি ঠিক ভাবে সাইকেল চালাইতে পারি।"
এরপর লোকটি আর কোন কথা না বলে চুপচাপ সাইকেলের পিছনে বসে রইল। পাশ দিয়ে দুয়েকটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। গাড়ির হেড লাইটের দিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আর সেই বৃষ্টি কে ভেদ করেই রফিক ছুটে যাচ্ছে তার গন্তব্যর দিকে।
*
পুরো গ্রাম অন্ধকার হয়ে আছে। এখনো হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় তেমন কাদা পড়েনি তাই হয়তো রফিকের সাইকেল চালাতে তেমন সমস্যা হয়নি। ওর সাইকেল নিয়ে ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য মাটি কেটে বাড়ির ভিটা থেকে নিচু করে রাস্তা বানানো হয়েছে, সেই রাস্তার পাশেই একটা গাছের সাথে সাইকেল ভিড়িয়ে রাখলো। লোকটি কে জিজ্ঞেস করলো "চাচা কই যাবেন? এইডা আমাগো বাড়ি। আপনি চাইলে আমি মার সাথে দেখা কইরা আপনেরে আপনার নাতিনের বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আইতে পারি।" লোকটা রফিকের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, "ঠিকাছে বাবা আমি এমনেও বুড়া মানুষ। তুমি দিয়া আইলে ভালই হইবো নাইলে এই রাইতে আমার যাওয়া কষ্ট হইয়া যাইবো।"
রফিক এবং ওর সাথের বুড়ো লোকটা রফিকদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ও একটু আগেই ভিটাতে পা রেখেই মা মা বোলে দুইবার ডাক দেওয়ার পড়েই দেখে ওর মা ওদের ভিটার পাশের নারিকেল গাছের পাশে দাড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই ওর দিকে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল "বাবা তুই আইছোস আমি তোর লাইগা সেই কবের থেইকা অপেক্ষা করতাছি। কতদিন হইলো আমি আমার বাজান ডারে দেখিনা।" এটা বলেই কান্না শুরু করে দিল। রফিক নিজেও ওর চোখের পানি আটকাতে পারল না। ওর মাকে জড়িয়ে ধরে রাখল। ওর মা ওর কপালে চুমু খেয়ে ওর পাশে থাকা বুড়ো লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো "ইনি কেডা রে বাবা? ইনারে তো চিনলাম না?" রফিক লোকটার দিকে একটু তাকালো ওর কেন যেন মনে হলো অন্ধকারেই লোকটা হাসছে। কিন্তু ও এটা চোখের ভুল মনে করে ওর মাকে বলল "এইখানে উনার নাতিন বাড়ি। রাস্তায় আহার সময় দেখা হইছে। আমারে কইছে সাহায্য করতে। কারণ গাড়ি পাইতাছিলনা তাই নিয়ে আইলাম লগে কইরা। ভাবলাম তোমার লগে দেখা কইরা উনারে উনার নাতিন বাড়ি রাইখা আমু" রফিকের মা রফিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল "আমার বাজান টা কত ভালা, কারো কষ্ট দেখতে পারেনা। আর আমি আমার বাজান টার লাইগা কিছুই করতে পারলাম না। তর বাপ টা যদি বাইচ্চা থাকতোরে।" রফিকের মার কথা শেষ হতে হতেই ওর পাশে দাঁড়ানো লোকটা ওকে বলল "বাবা। আমারে একটু পানি খাওয়াইতে পারবা?" রফিক লোকটাকে একটু দাঁড়াতে বলে ঘরের দিকে গেল, গ্লাস নিয়ে আসতে। ঘরের গেট খোলা ছিল। ঘরের সামনে গিয়ে দেখলো উঠানে ওদের পাশের বাসার ফরিদের বাপ বসে আছে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে বোঝা গেল লোকটা ঘুমিয়ে আছে। তাই ফরিদের বাপ কে ডাক না দিয়ে ঘরে ঢুকলো গ্লাস নেওয়ার জন্য। ওদের দরজা খোলাই ছিল। ঢুকে দেখে বিছানাতেও কে যেন শুয়ে আছে। ওর মনে হলো ফরিদ এবং ফরিদের মা। আসলে ফরিদ ওর দুরের সম্পর্কের ভাই লাগে। আর রফিকের মা একা থাকে বলে মাঝে মাঝে ফরিদ রাও এখানে এসে রাতে থাকে, রফিকের মার সাথে গল্প করে। ফরিদের, রফিকের মায়ের গল্পগুলো খুব ভালো লাগে। হয়তো তাই এখানে আসছে। তাই সেগুলো চিন্তা না করে ঘরের এক কোনায় জ্বালানো হ্যারিকেনের পাশে রাখা গ্লাসটা নিতে গেলো। কিন্তু তখনই ঘটনাটা ঘটে গেলো। রফিকের মনে হলো ওর মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল হঠাৎ, কারণ রফিক গ্লাস টা ধরতে পারছেনা। ও আবার চেষ্টা করলো, কিন্তু একই অবস্থা। এবার ধরতে পারলোনা। ও হ্যারিকেন উঠানোর চেষ্টা করলো তাও একই অবস্থা। ও ধরতে পারছেনা। ওর মনে হলো ও স্বপ্ন দেখছে। ও ফরিদের মা কে ডাকল, কিন্তু কোন জবাব পেলনা। রফিকের মাকে ধরে ঝাঁকি দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুই হলোনা। ও তাকেও ধরতে পারছেনা। চিৎকার করে ছুটতে লাগলো বাহিরের দিকে ওর মার কাছে। কিন্তু যেভাবে ছুটছিলো। ওর ঘরের মাটির দেয়ালের সাথি বাড়ি লাগার কথা। কিন্তু কিছুই হলোনা, ও অনায়াসেই ভেদ করে গেলো দেয়ালটা। ও ওর মার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল। "মা আমার সাথে এগুলা কি হইতাছে। আমি কিছু ধরতে পারতাছিনা। ফরিদের মা, ঘরের দেয়াল, গ্লাস হ্যারিকেন কিছুইনা।" ওর মা কোন কথা বলছেনা। শুধুই শাড়ির আচল মুখে দিয়ে কান্না করছে। একটু পড়ে রফিকের একটু আগের পথ সঙ্গী বুড়ো লোকটা রফিকের হাত ধরে টেনে বললো "বাবা আপনি আমার সাথে আহেন" রফিক ওর মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দিকবিদিক কিছু না বুঝে লোকটার সাথে হাটা শুরু করলো। মনে হচ্ছে ওকে অদৃশ্য কিছু টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাতাসের সাথে।
*
লোকটি চারটি নারিকেল গাছ পাশ কাটিয়ে ওকে নিয়ে ওদের বাড়ির ভিটার চকের দিকের অংশের কিনারে এনে দাঁড় করিয়ে বলল “দেখেন এইখানে”। রফিক হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় বুঝতে পারলো ও একটি নতুন দেওয়া কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। "এটা আপনের মায়ের কবর। উনি দুইদিন আগেই মইরা গেছে। তারপর উনারে এইখানেই মাটি দেওয়া হইছে।" রফিক হতবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো "কি আজব কথা কইতাছেন? কিছু খাইছেন নাকি? তাইলে ওইখানে কে দাড়ায় আছে?" বুড় লোকটি মৃদু হেসে উত্তর দিল "বাবা এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় নাই।" রফিকের মনে হলো ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে " আপনি কি কন এডি? উনি মইরা গেলে আপনি আর আমি উনারে কেমনে দেখি?" লোকটা ওর মাথায় একটা হাত দিয়ে বলল "বাবা আপনি শান্ত হন। উত্তেজিত হইয়েন না। আপনার মার কাছে যান। আপনাগো দুজনের কাছেই সময় কম। আমার হাতে সময় আরো কম। আমার দায়িত্ব ছিলো আপনাগো মায় ব্যাটারে দেখা করানো, আমার কাজ শেষ। আমার এখন যাইতে হইবো। সৃষ্টিকর্তা আপনার মঙ্গল করুক।" কথাটা বলে বুড়ো লোকটা ভিটা থেকে নেমে নিচু রাস্তা দিয়ে চকের দিকে হেটে একসময় অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ফরিদ চুপচাপ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে ওর মার কাছে ফেরত চলে গেল। ওর মা এখনো কেঁদে যাচ্ছেন।
*
পরের দিন সকালে
রহিমুদ্দিন মহাসড়কের মাঝ পথে একটা ছেলের লাশকে ঘেরাও করে আছে কিছু লোকজন। ছেলেটির পাশে একটি সাইকেল বিধ্বস্ত অবস্থায় রাখা। ছেলেটির ঠিকানা জানার জন্য একজন ছেলেটির পকেটে খোঁজ করে একটি গার্মেন্টস এর হাজিরা খাতা পায়। সেখান থেকে জানা যায় ছেলেটির নাম ছিল রফিক। এবং তার গ্রামের বাড়ি হচ্ছে গোপিপুর। লোকজনের ধারনা হয়তো রাতে যাত্রাপথে ট্রাক বা বাসের নিচে চাপা পড়ে ছেলেটি। ভিড়করা পাঁচ জনের মধ্যে একজন বোলে উঠলো "এই রাস্তায় দেহি এখন দুইদিন পরপরই এক্সিডেন্ট হইতাছে। এই রাস্তায় মনে হয় জিন ভুতের উত্তাপ বাইরা গেছে।"
*
একটি জিনের গল্প || তাসফিক হোসাইন রেইযা ||
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৩:০৫