অর্থনীতি, শিল্পকলা আর সামরিক প্রযুক্তির জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশগুলোর অন্যতম ফ্রান্স। সেই ফ্রান্সের কাছে অর্থনৈতিক আর কারিগরি সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সবসময় ঋণী, তা বলার অপেক্ষা নেই। কিন্তু বাংলাদেশ যতটা না ফ্রান্সের কাছে ঋণী, তার চেয়ে বেশি ঋণী এক ফরাসির কাছে। নাম তার আন্দ্রে মালরো। বাংলাদেশের আকাশে পতপত করে উড়ানো আজকের লাল-সবুজ পতাকা, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়াজুড়ে বাংলাদেশের প্রতিটি ইঞ্চি ভূমি ঋণী হয়ে আছে তার কাছে গত ৪১ বছর ধরে। বাংলাদেশ যদি আরও ৪১০ বছর বেঁচে থাকে অথবা বেঁচে থাকে আরও ৪১০০বছর অথবা তারও বেশি, বাংলাদেশ চিরকাল এ মহৎ মানুষটির কাছে ঋণীই হয়ে থাকবে।কিন্তু কেন? কারণ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই মালরো একাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ফ্রান্সে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তার বক্তৃতা-বিবৃতি আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক প্রেরণা হয়ে উজ্জীবিত করেছিল সে সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের। ফ্রান্স সরকারের উদ্দেশে তার করা আকুতি : 'আমাকে একটি যুদ্ধবিমান দাও, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের শেষ লড়াইটা করতে চাই"।
আজও শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক প্রেরণা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।বাংলাদেশ যখন একেবারে শৈশবে, স্বাধীনতা লাভের পাঁচ বছরের মাথায় মারা যান আদ্রে মালরো। ফলে বাংলাদেশ তার ঋণ শোধ করার সুযোগও পায়নি। তারপরও বাংলাদেশের হয়ে খানিকটা ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছেন বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক মাহমুদ শাহ কোরেশী। কারণ ফ্রান্সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সময় মালরোর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। মালরোকে নিয়ে তিনি বইও লিখেছেন। আর সে বইয়ে তিনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে মালরোর অবদানের কথা। একমাত্র মাহমুদ শাহ কোরেশীর অক্লান্ত চেষ্টায়ই ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে ফ্রান্স থেকে নিয়ে এসে দিয়েছিল সংবর্ধনা। চট্টগ্রামেও অলিয়ঁস ফ্রঁসেসের উদ্যোগে সংবর্ধিত হয়েছিলেন মালরো। এরপর অবশ্য বর্তমান সরকারের আমলে নানা স্বীকৃতি আর শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মালরোর অবদানকে সম্মানিত করা হয়েছে।
শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা নয়, যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন, সারাবিশ্বে যত মুক্তি-সংগ্রাম হয়েছে, সবসময় মুক্তি, স্বাধীনতা আর ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেছেন আদ্রে মালরো।
এশিয়ার অন্য দুটি দেশ কম্বোডিয়ার যুদ্ধে তিনি ফরাসিদের বিপক্ষে এবং চীনের গৃহযুদ্ধে তিনি কুও মিন্তাংয়ের পক্ষে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩৬-১৯৩৯ সালে স্পেনের রাজার অনুগত হয়ে যোগ দেন স্পেনের গৃহযুদ্ধেও। সেখানে তিনি একটি স্কোয়াড্রনের বিমানচালক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও জার্মানির বিরুদ্ধে তিনি ফ্রান্সের প্রতিরোধ যোদ্ধা হিসেবে অংশ নেন। এ সময় তিনি জার্মানিদের হাতে বন্দী হন এবং পালিয়ে যান। ১৯৪৫ সালে এ মহান যোদ্ধাকে চার্লস দ্য গল তার তথ্যসচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। তারপর ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সের সংস্কৃতিমন্ত্রী ছিলেন। চার্লস দ্য গলের মন্ত্রিসভায় থাকার সময়ও ফ্রান্স আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ আলজেরিয়ার মুক্তিসেনাদের পক্ষাবলম্বন করেন, যা দ্য গলকে এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। সারাজীবন মুক্তি আর সাম্যের পক্ষে থাকা মালরো যে শুধু যোদ্ধাই ছিলেন, তাই নয়। বরং নিজের যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন উপন্যাসও। কম্বোডিয়া আর চীনের গৃহযুদ্ধে তার অংশগ্রহণের পটভূমি নিয়ে লিখেছেন তিনটি উপন্যাস : লে কোঁকের (১৯২৮), লা ভোঁয়া রইয়াল (১৯৩০) এবং লা কোঁদিসিওঁ উমেন (১৯৩৩)। এর মধ্যে শেষ উপন্যাসটি ফ্রান্সের মর্যাদাপূর্ণ প্রি গোঁকুর পুরস্কার লাভ করে এবং এ উপন্যাসই তাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। এ ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের পটভূমিতে লেখেন আরেক স্মরণীয় উপন্যাস : ল্য তঁ দু মেপ্রি (১৯৩৫)। মালরো পড়াশোনা করেছিলেন নন্দনতত্ত্বের ওপর। নন্দনতত্ত্বের ওপর তিনি প্রচুর লিখেছেন। তার সাইকোলজি দ্য লার (১৯৪৯) নন্দনতত্ত্বের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এ ছাড়া লা মেটামরফোজ দে দিও (তিন খণ্ড : ১৯৫৭, ১৯৭৪, ১৯৭৬) এবং ল্য ট্রায়াঙ্গল নোয়ার (১৯৭০) গ্রন্থগুলোও শিল্পকলার ওপর লেখা। এর ভেতর ১৯৬৭ সালে তার আত্দজীবনী এন্টিমেমোয়ারের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হলে বিশ্বে প্রশংসিত হন মালরো। ১৯০১ সালের ৩ নভেম্বর প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের মহান বন্ধু অাঁদ্রে মালরো আর মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৬ সালের ২৩ নভেম্বর। তার মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতার সংগ্রামরত মানুষগুলো হারিয়েছে এক মহান যোদ্ধাকে আর বাংলাদেশ হারিয়েছে তার এক অকৃত্রিম বন্ধুকে। তার কাছে বাংলাদেশের যে ঋণ, তা কখনো শোধ করার নয়। আজকের এ লেখাটিও বাংলাদেশ থেকে সে ঋণশোধের কোনো চেষ্টা নয় এবং ঋণ স্বীকারের চেষ্টাও নয়। বরং এটুকুই কেবল বলার আছে_ আমাদের ৪১তম মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা আদ্রে মালরো, বন্ধু তোমাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিবাদন আর শ্রদ্ধা।
(সংগ্রহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৪৩