somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন -2

৩০ শে এপ্রিল, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবুজ মরুভূমি

কক্সবাজার জেলার চকোরিয়া, বান্দারবান জেলার লামা, আলীকদমসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভরামৌসুমে এখন আর ধান বা শস্যের গন্ধে মৌ মৌ করে না। অথচ একটা সময় ছিল এখানকার চিনে বাদাম, তরমুজ, ধান ও অন্যান্য শস্যাদি স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিকিকিনি হত আর মানুষের খাদ্যের চাহিদা মিটত। কিন্তু বর্তমানে সেই স্থান দখল করে নিয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী আগ্রাসী তামাক বন। তামাকের উৎকট ঝাঁঝাঁলো গন্ধে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে এখানকার পরিবেশ। বিস্তীর্ণ অঞ্চল আপাত দৃষ্টিতে সবুজের চাদরে মোড়ানো অসীম উদ্যান মনে হলেও এসব নেহায়েত সবুজ মরুভূমি ছাড়া কিছুই নয়। গত ১৫-২০ বছরে এসব অঞ্চলে তামাক চাষের প্রবণতা এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌছেছে যে, এসব সবুজ মরুদ্যান সংলগ্ন পরিবেশ, মাটি, পাহাড়, নদী, বায়ু, প্রাণীকুল, তাদের নিজস্ব বৈচিত্র হারিয়ে ফেলছে। অতিরিক্ত আয়ের লোভে পড়ে স্থানীয় লোকজন না জেনে না বুঝে এসব তামাক চাষে লিপ্ত হয়েছে এবং নানান রোগ-ব্যধিতে ভুগছে শিশু-জোয়ান-বৃদ্ধরা। এসব এলাকা সরেজমিন ঘুরে যে চিত্র পাওয়া যায় তা অত্যন্ত ভয়াবহ।

লোভে পড়ে মানুষ হারাচ্ছে একুল-ওকুলঃ এক একর ধানী জমিতে ধান চাষ করে একজন কৃষক এক মৌসুমে আয় করত ১৫-২০ হাজার টাকা। পরিশ্রম তেমন একটা করতে হতো না, সময় মত শুধু সেচের পানি হলেই হতো। কিন্তু বড় বড় ব্র্যান্ড তামাক কোম্পানীগুলো ইতোমধ্যে কৃষকদের হাতে জাদুর চেরাগের মত তুলে দিয়েছে তামাক চাষের ফর্মূলা। একই জমিতে এক মৌসুমে যে কৃষক ১৫-২০ হাজার টাকা পেত সেখানে সে এখন পাচ্ছে দ্বিগুণ অর্থ। সেচের ঝামেলা নেই, তবে খাটুনিটা পূর্বের চাইতে দ্বিগুণ বেড়েছে। দ্বিগুণ খাটুনি তারা গায়ে সয়ে নেয় দ্বিগুণ আয়ের লোভে। কিন্তু তামাক চাষ করতে গিয়ে চাষী ও চাষীর পরিবারের লোকজন ভুগছে নানান রোগে। তামাক গাছ বা বনগুলোকে সুপুষ্ট করতে ও সার বা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করতে হয় তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ফলে তাদের চর্মরোগ, হাপানীসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিচ্ছে। অতিরিক্ত খাটুনি, বিভিন্ন রোগের কারণে স্বাস্থ্যহানী ঘটছে স্থানীয় তামাক চাষীদের।

মাটির উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে; পার্শ্ববর্তী নদীতে পড়ছে প্রভাবঃ যে জমিতে তামাক চাষ হয়েছে সে জমিতে অন্য কোন শস্যের চাষ হচ্ছেনা। চাষীরা এখন নিরুপায় হয়ে তামাক চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। চকোরিয়ার কাকারা, মানিকপুর, মাঝের ফাঁড়ি, লোটনী, বান্দারবানের লামা, আলীকদম বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘিরে থাকা মাতামুহুরী নদী তার স্বাভাবিকতা হাড়াতে বসেছে। যে মাটিতে রাসায়নিক সার বা দ্রব্য ব্যবহার করে তামাক চাষ করা হচ্ছে সেই মাটি বা চর সংলগ্ন মাতামুহুরী নদীতে গিয়ে পড়ছে এর ক্ষতিকর প্রভাব। এই ছোট্ট নদীটিতে আর আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। সোনফলা বিস্তীর্ণ পলল ভূমিতে প্রাকৃতিক লাঙ্গল খ্যাত কোচোঁরও দেখা পাওয়া যায় না। ঝরঝরে মাটি, দমবন্ধ ঝাঁঝাঁলো গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠা বিস্তীর্ণ তামাক ভূমিতে একটি পাখিও ওড়েনা কেবল এক ধরনের গোবড়ে পোকা ছাড়া।

নিধন হচ্ছে বনভূমি; বাড়ছে কার্বনের পরিমানঃ তামাক তোলার পর তা তামাকের মাঠেই নির্ধারিত স্থানে বিশালাকার চুল্লি বানিয়ে পাতাগুলোর উপর তা দিতে হয়। অর্থাৎ পাতা পুড়তে হয় একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়। এসব চুল্লিুতে জ্বালানী হিসেবে পোড়ানোর জন্য নিধন করা হচ্ছে স্থানীয় পাহাড়ের সবুজ জঙ্গল, বনানী। ফলে বৃক্ষশূন্য হয়ে উঠেছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বনের পাখী সহ বিভিন্ন প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে এসব এলাকায়। পাতা ছাড়ানোর পর তামাক গাছের আঁটিগুলোকে রান্নার কাজে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করছে স্থানীয়রা। ফলে এসব জ্বলন্ত আঁটি থেকে নির্গত ধোয়া মারাতœক স্বাস্থ্যহানী ঘটাচ্ছে স্থানীয় লোকজনের।

অধিক মুনাফা; কম টাকার শিশু শ্রমিক: স্থানীয় লোকজন তামাক পাতাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘চুঁড়া পাতা’, ‘গোল্ড লীফ পাতা’, ‘তামাক পাতা’ ইত্যাদি নামে। তামাক চাষীরা তামাক ক্ষেতের কাজে লাগায় সাধারনত শিশু শ্রমিকদের। একজন পূর্ণবষস্ক মজুরকে যেখানে দিনে ২০০ বা ৩০০ টাকা দিতে হয় সেখানে শিশু শ্রমিকের হাতে ৭০ বা ৮০ টাকার দিয়ে সারাদিন খাটিয়ে নিতে পারে। তামাকের পাতা ছাড়ানো, কান্ড ছাড়ানো, পাতার ভাঁজ বাধা, স্থানান্তর ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত অধিকাংশ শ্রমিকের বয়স ১৮ এর নিচে। এসব শিশু শ্রমিকের বাবা-মাও অতিরিক্ত আয়ের লোভে পড়ে স্বেচ্ছায় ঘরের ছেলে মেয়েদের পাঠাচ্ছে তামাক ক্ষেতে। এতে করে স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে শত শত শিশু।

তামাক চাষের জন্য অগ্রীম ঋণের ব্যবস্থা: কোন চাষীর হাতে যদি দেখা যায় কাজ নেই, টাকা নেই, সেক্ষেত্রেও কোন সমস্যা নেই। তামাক কোম্পানী ও বিভিন্ন এন.জি.ও. বসে থাকে তাদের হাতে টাকা দেয়ার জন্য। এজন্য কোন জামানতেরও প্রয়োজন পড়ে না। কোন ভূমি মালিকের কাছ থেকে একখন্ড জমি লাগিয়ত নিলেই হয়। কারণ তামাক চাষে বিনিয়োগ নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত, অধিক ও দ্রুত লাভজনক। তাই ঋণের লোভ বা ফাঁদে ফেলে তামাক চাষ অবাধ ও নির্বিঘœ করতে অনেক রাঘব বোয়াল, সংগঠন, কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

স্থানীয় পরিবেশবাদী ও পরিবেশবিদদের কথা: কক্সবাজার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপিকা শারমিনা রেশমীনের সাথে এ ব্যপারে কথা হয়ে। তিনি প্রচন্ড উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কক্সবাজার বান্দারবানসহ বিস্তীর্ণ সবুজ প্রাকৃতিক লীলাভূমি নিয়ে। তিনি বলেছেন, দরিদ্র মানুষকে লোভের ফাঁদে ফেলে তামাক চাষের মতো পরিনবেশ বিধ্বংসী চাষ বা ক্ষেত করে স্থানীয় পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র তো আছেই এছাড়া রয়েছে স্থানীয় জনগনের অসচেতনতা। বাংলাদেশ তথা দক্ষিাণাঞ্চলকে মরুভূমি বানানোর পাঁয়তারা চলছে বলে তিনি দাবী করেছেন। স্থানীয় পরিবেশবিদ হাফিজ উদ্দিন বলেছেন তামাক গাছ সুস্থ পরিবেশের জন্য কোন ভাবেই উপুযুক্ত নয়। তামাক ক্ষেতের বিস্তীর্ণ এলাকার মাটি, নদী, নদীর পানি, গাছ,, প্রাণী, মানুষের উপর মারাতœক ও ক্ষতিকর প্রভাব পড়বেই যা আমরা ঐসব এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি। এখনই তামাক চাষ বন্ধের উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে আমাদের সবুজ পাহাড়, বন্যপ্রাণী ও পাখীর ডাক, নদীর মাছ সব হারিয়ে ফেলব।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

"রাজকুমার" সিনেমার রিভিউ

লিখেছেন নয়ন বড়ুয়া, ১৮ ই জুন, ২০২৪ সকাল ৯:১৩



#স্পয়লার_এলার্ট

গতকাল শাকিব খানের "রাজকুমার" মুভিটা দেখেছিলাম।
অন্ধবিশ্বাস কিংবা ধারণা মানুষকে কতটা ভয়ংকর করতে পারে, একটা সুখের সংসার কী সহজে না শেষ হয়ে যায়, এই অন্ধবিশ্বাস আর জবানের কারণে তারই একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঈদ মুবারাক (সাথে এক হালি কৌতুক)

লিখেছেন বিষাদ সময়, ১৮ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৩:১৬





সবাইকে ঈদ মুবারাক (It is better late than never)


১) " ভোগে কোন সুখ নাইরে মনা, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ" -কথাটা শুনার সাথে সাথে সেই ব্যক্তির প্রতি ভক্তিতে চোখ পানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরবানীর ঈদ।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৫:০২


ফাতেমা গরিব ঘরের শিশু। বাপ রিক্সা চালায়। সারা বছর গরুর গোস্ত খাওয়ার সপ্ন দেখলেও সেই সপ্ন আর পূরন হয় না। শিশু ফাতেমার বাপের যা ইনকাম তা দিয়ে টানতে টানতে দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেন উৎসব সবার হয়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৫:১০

ধরুন সামনে ইদ৷ পুরা রমজান মাস জুড়ে প্রচুর বেচাকেনা চলছে৷ পুরা দেশে লক্ষ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে৷ আমাদের মতো দেশে এ ধরণের উৎসবে ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো হয়৷ সবার পকেটে টাকা চলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×