somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক অন্যরকম লাউয়াছড়া ভ্রমণ..

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ভ্রমণপাগল মানুষ মাত্রই একটা বিষয় জানেন বলে আমার ধারণা, আর সেটা হোল- যে কোন সুন্দর জায়গার সৌন্দর্য সব থেকে ভালো ফুটে ওঠে মূলতঃ ভোরের দিকটাতে, শেষ বিকেলে কিংবা গভীর রাতে। মধ্য দুপুর ভ্রমণের জন্য সব থেকে বাজে সময়; 'চৈতা' রোদে আপনি যদি নিজের চোখটাই ঠিকমত খুলে তাকাতে না পারেন- তা হলে সামনে তাজমহল থাকলেই কি আর গাবতলী গরুর হাট থাকলেই বা কি! এ বিষয়ে চাণক্যের একটা শ্লোকও আছে-
রাত্রিচারণং কুর্য্যাত্
অর্থ : রাতে বেশিক্ষণ বিচরণ করা উচিত নয়।
আমার মতে শ্লোকটা হওয়া উচিত ছিলো- "দ্বিপ্রহর-চারণং কুর্য্যাত্"।

এছাড়া দুপুরে ঘুরাঘুরি করবার আরেকটা বড় সমস্যাও আছে! এ সময়টাতেই বাঙ্গালির ভাতের ক্ষুধা লাগে। কোন কারণে যদি সে ক্ষুধা নিবারণ না করেই উদ্ভ্রান্তের মতন ঘুরাঘুরি করে যেতে হয়- তাহলে স্বভাবতই পর্যটকদের সে ভ্রমণটুকু উপভোগ করতে পারার কথা না। ক্ষুধা পেটে কবি সুকান্তের কাছে পূর্ণিমার চাদের মতন একটা জিনিসকেও ঝলসানো রুটি বলে মনে হয়েছিলো, সেখানে আমরা তো কোথাকার কে! দেখা গেলো- ক্ষুধায় কাতর হয়ে কেউ লাউয়াছড়া বনে পৌছুবার পর সেটাকে তার পালং শাকের এক অতিকায় গুদাম বলে মনে হতে লাগলো!

আমি প্রথমবার যখন লাউয়াছড়া গিয়েছিলাম- তখন এ ধরণেরই একটা বিরক্তিকর ব্যাপার ঘটে। শ্রীমঙ্গল শহর কেন্দ্র থেকে আমরা যখন লাউয়াছড়ার উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করলাম- সময় তখন দুপুর একটার কাছাকাছি। বুঝুন অবস্থা! পুরোপুরি রোদে তেতে থাকা ভ্যাপসা, বস্তাপচা এক সময়...

এমন বেড়াছেড়া একটা প্ল্যান করবার জন্য আমাদের পুরো ট্যুর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা সকলের বারোটা বেজে যাবার কথা ছিলো, কিন্তু সে মানুষগুলোকে বাচিয়ে দিলো প্রকৃতি স্বয়ং! আকাশ জুড়ে জলরঙ্গা মেঘেরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবার কারণে রোদের তীব্রতাও খুব একটা বুঝতে পারা যাচ্ছিলো না! আলো-ছায়ার সে লুকোচুরির মধ্য দিয়েই আমরা ধীরে ধীরে লাউয়াছড়া বনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। যারা ইতোমধ্যেই লাউয়াছড়া ঘুরে এসেছেন, তারা জানেন- যাবার পথে বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে বিভিন্ন এস্টেটের চা বাগান চোখে পড়ে। ঠিক হোল- লাউয়াছড়া বন দেখে এসে বিকেলের দিকটা আমরা সেই চা বাগান ঘুরে ঘুরে কাটাবো।

এই সুযোগে বলে রাখি- পর্যটকদের কাছে শ্রীমঙ্গলের আরেক আকর্ষণ নিঃসন্দেহে- তার সাত লেয়ারের চা। লাউয়াছড়া বনে যাবার পথেও এরকম এক/ একাধিক টিপটপ চায়ের দোকান আমার নজরে এসেছিলো। তাছাড়া শ্রীমঙ্গল শহরেও যতদূর স্মরণে আসছে- এমন বেশ কয়েকটি নামীদামী দোকান ছিলো যেখানে এই রংধনু টাইপ চা পাওয়া যায়। আমি এমনিতেই চা পাগল মানুষ, তার উপর যদি চায়ের দেশে পৌছে এমন অদ্ভূত চায়ের সন্ধান পাই- তাহলে কি হবে সেটা বলাই বাহুল্য। হয়েছিলোও তাই! এর পরেও আমি যতবার করে শ্রীমঙ্গল ঘুরতে গিয়েছি- পানির থেকে বেশি আমার খাওয়া হয়েছে চা। তাও আবার যে সে চা নয়, শ্রীমঙ্গলের অসাধারণ সাত/দশ লেয়ারের চা!

যাই হোক- আমরা লাউয়াছড়া বনে পৌছে যাবার পর আবার চারদিক ঝলমল করে রোদ উঠলো। সাথে সাথে আমাদের সবার মধ্যে পশুভাবও প্রবল হয়ে ওঠে। বনে ঢোকবার জন্য আমরা ব্যাকুল হয়ে পড়ি। কখন জঙ্গলে ঢুকবো আর গাছের ছায়ার নিচে গিয়ে দাড়াবো- সেটাই তখন আমাদের একমাত্র চিন্তা। অবশেষে বনের ছায়ায় প্রবেশ করে আমরা সবাই মোটামুটি হাফ ছেড়ে বাচলাম।

আমি এর আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিম বনাঞ্চলের কিছুটা ঘুরে এসেছি, সে হিসেবে লাউয়াছড়া আমার কাছে আহামরি কিছু মনে হবার কোন কারণই ছিলো না। কিন্তু কেন জানি না- লাউছড়ার এ রিজার্ভ ফরেস্টটাকে শুরু থেকেই আমার কাছে অন্যরকম ভালো লাগতে থাকে। বনের ভেতরে এক জায়গা পার হতে গিয়ে দেখলাম রাস্তার এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত সুক্ষ্ম এক ধরণের মাকড়শার জাল। মাঝখানে যে ছোট মাকড়শাটি ঝুলে আছে- সেটাকে আধুনিক নগর সভ্যতার মাঝখানে ইট-পাথরের কোন দালানের দেয়ালে বসে থাকতে দেখলে হয়তো খুব কুতসিত বলে মনে হোত- কিন্তু এখন, এ বনঝোপের মাঝে সেটি যেনো গর্ব নিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। আমার স্পষ্ট মনে হোল- সে এখানে এ অবস্থায় না থাকলে- পুরো লাউয়াছড়া বনের ঐশ্বর্যটাই হয়তো কমে যেতো। রুমের কোণায় যে মাকড়ের জাল একটা ফ্ল্যাটবাড়ির চেহারাকে হতচ্ছাড়া, বিষণ্ণ বানিয়ে তোলে- সে একই জালের অপূর্ব নকশা এ গহীন অরণ্যে কি আশ্চর্য সৌন্দর্যেই না সোনালী রোদটাকে আটকে ফেলছে! খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে সে জালের সুতোয় সুতোয় দেখতে পাওয়া যায় রংধনুর ঝিকিমিকি!

এতোক্ষণ যা যা বললাম- সেটা 'অর্ডিনারী'। 'একস্ট্রা অর্ডিনারী' ঘটনাটা ঘটলো আমরা যখন ট্রেকিং শেষ করে বনের গহীন থেকে বেরিয়ে আসবার পথ ধরেছি- তখন। প্রথমে বনপথের উপর থেকে টুকরো টুকরো রোদ উধাও হয়ে পুরো অরণ্য এক অপার্থিব ছায়ায় ঢেকে গেলো। সাথে হাল্কা শরীর জুড়ানো বাতাস গাছের পাতা স্পর্শ করে অজানায় বয়ে নিয়ে যেতে থাকে অরণ্যের গন্ধ। একসময় হঠাতই চারপাশের ঝিঝির ডাক, গাছের পাতার খসখস আর রহস্যময় বনমাতার নানা প্রান্ত থেকে ভেসে আসা চেনা-অচেনা সব শব্দকে ছাপিয়ে বৃষ্টির টুপটাপ শুরু হয়। শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত বৃষ্টি! মুহূর্তেই পুরো বন যেনো কেমন অস্থির হয়ে উঠলো; যেনো- সমগ্র বনাঞ্চল প্রিয় বৃষ্টিকে ব্যাকুল হয়ে নিজের মাঝে আগলে নিতে চাইছে। আমার স্পষ্ট মনে হোল- গভীর ভালোবাসায় লাউয়াছড়ার গহীন অরণ্যের বৃষ্টির কাছে নিজেকে উজাড় করে বিলিয়ে দেবার সে অপূর্ব দৃশ্য দেখবার জন্যই দুঃখ, কান্না আর হাহাকারের এই পৃথিবীতে জনম জনম ধরে বারবার ফিরে আসা যায়।

চারপাশ ঝাপসা করে দেয়া সে বৃষ্টি যখন শুরু হোল- আমরা সবাই সে সময়টাতে বনের মাঝামাঝি অংশে ছিলাম, আমাদের কারো কাছেই ছাতা বা এ জাতীয় কিছু ছিলো না, কিন্তু তারপরো আমাদের কাউকেই ভিজে চুপচুপে হতে হয় নি। লাউয়াছড়ার গভীর বন আমাদের কারো গায়ে বৃষ্টির একটি ফোটাও পড়তে দেয় নি। পরম মমতায় আমাদের সকলের মাথার ওপর বিছিয়ে রেখেছিলো তার সবুজ, স্বপ্নময় শাড়ির আচল...

যাদের সাথে আমি সে লাউয়াছড়া ভ্রমনটি করেছিলাম, তাদের প্রায় সবাই এখন দূরে দূরে; বেশিরভাগই পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে; চাইলেই এখন আর আমরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মত যখন তখন বেড়িয়ে পড়তে পারি না। মজার ব্যাপার হোল- শ্রীমঙ্গল কিন্তু এখনো ঠিক আগের মতই আছে। সেখানে আজও ঘন নীল আকাশে মেঘেরা তুলোর তৈরি ভেলা ভাসায়; সোনালী রোদে ঝলমল করে ওঠে শান্ত শরত হাওয়া।

সেখানে, আজো এক বন তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে আমাদের, আপনাদের মতন অতিথিদের বরণ করে নেবার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। আর অপেক্ষা করে থাকে বৃষ্টির। ঝুম বৃষ্টিতে সেখানে নিজেদের ডালগুলোকে আকাশের দিকে বিছিয়ে দিয়ে মনের আনন্দে ভিজতে দেখা যায় প্রকৃতির সবুজ সন্তানদের। বনের গহীনে বৃষ্টির ফোটা গাছের পাতায় পাতায় পড়ে সৃষ্টি করে এক অপার্থিব, অদ্ভূত সুর।

সে সঙ্গীতের স্মৃতি বাতাসে মিলিয়ে যাবার পরও ধ্যানে, স্বপ্নে মগ্ন হয়ে থাকে এক মায়াময়, আশ্চর্য অরণ্য!



(শেষের ছবিটা নেট থেকে নেয়া)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৫৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×