somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রূপসী বাংলা

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি যে কবিতার খুব বড়সড় কোন ভক্ত, এমনটা নয়। তাই ছোটবেলা থেকে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার পাঠ্যবইয়ের বাইরে খুব বেশি কবিতা পড়া হয়ে ওঠে নি। বলা বাহুল্য- পাঠ্যবইয়ের গুলোও পড়তাম শুধু পরীক্ষায় পাশ করার জন্য, কবিতার প্রতি মমত্ব কিংবা কোন দুর্বলতা থেকে নয়।

সত্যি কথা বলতে কি- আমার জীবনে এমন একটা সময়ও গিয়েছে- যখন কবিতা, কবি- এই টাইপ ব্যাপারগুলো থেকে আমি মেপে মেপে হাত শতেক দূরে থাকার চেষ্টা করেছি। বয়ঃসন্ধিকালের জটিল সময়টাতে আমার বালক সত্বাটি যখন প্রানপণে একজন পুরুষ হয়ে ওঠার জন্য চেষ্টা করছে- তখন কবিতা টাইপের পুতুপুতু সবকিছুকেই আমার মেয়েলি ব্যাপার-স্যাপার বলে মনে হোত। যেখানে পৌরুষ নেই, কঠোরতা নেই- সে জিনিসকে ঘৃণাভরে বর্জন করতে পারাটা তখন আমার কাছে ছিলো বিরাট বীরত্বের কোন বিষয়।

আমার এই ভুলটা ভেঙ্গে দিয়েছিলো আমার বন্ধু রফিক; সে নিজেও তখন বয়ঃসন্ধিকাল পার করছে, তবে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে ঐ বয়সেই তার পড়াশোনা ছিলো ব্যাপক। তাই একদিন কথায় কথায় আমার এই মনোভাব জানতে পেরে সে আমাকে কাজী নজরুলের 'গরম' কবিতাগুলোকে ধরিয়ে দিলো। 'লাথি মার ভাঙরে তালা,/যতসব বন্দীশালা,/আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা।'- টাইপ। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় আমাকে বললো- "তোর মতন অশিক্ষিত, বোকাচোদাদের চিন্তাভাবনা এমনি হবে- এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই!" (বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেরা গালাগালি একটু বেশিই করে, এই রূঢ়তাকেও খুব সম্ভবতঃ তারা পুরুষত্বের অন্যতম চিহ্ন বলে ধরে নেয়)

ঐ কবিতাগুলো পড়ে আমি এতো অবাক হলাম যে- বলার নয়। (আমি কূপমন্ডুক টাইপের ছিলাম দেখে পড়াশোনা জানা মানুষেরা আমাকে খুব সহজেই অবাক এবং প্রভাবিত করতে পারতো)। যাই হোক- কবিতার সাথে আমার সখ্য যদি বা কিছু হয়ে থাকে- তবে সেটা রফিকের কল্যাণে, সেই তখন থেকেই!

কবিদের মধ্যে সম্ভবতঃ আমার সব থেকে ভালো ধারণা ছিলো জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে। কেননা উনার প্রচুর কবিতা আমার পড়া হয়েছে- ঝরা পালক থেকে শুরু করে সাতটি তারার তিমির পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা আমার খুব ভালো মত চেনা। সব থেকে বড় কথা হোল- আমি যেহেতু কোন সমালোচক হিসেবে কোন কবির কবিতা পাঠ করতে যেতাম না- তাই আমার দায়িত্বও ছিলো অল্প, এবং কিছুটা স্বার্থপর পাঠকের মতন- পড় আর মন ভরে সাহিত্যের রূপ-রস আস্বাদন কর!

আমি জীবনানন্দের বহু, বহু কবিতা গড়গড় মুখস্থ বলে যেতে পারলেও 'রূপসী বাংলার' কবিতাগুলোকে এতোদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। শুধু এই একটা ক্ষেত্রেই নয়- প্রকৃতি আর তার অপার সৌন্দর্যের যে কোন সাহিত্য আমি সারাটাজীবন ধরে এড়িয়ে চলেছি (বিভূতিভূষণের লেখাগুলো আমার অপছন্দ শুধুমাত্র এই একটা কারণে, আর সেটা হোল- প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি তার অগাধ প্রেম)। আমার বন্ধুরা একটু বড় হবার পর যখন সবাই মিলে ঘুরতে যেতো- সেন্ট মার্টিন, রাঙ্গামাটি কিংবা সিলেট, ফিরে এসে যখন গল্প করতো নীল সমুদ্র, সবুজ পাহাড় কিংবা নিবিড়, নিমগ্ন কোন চা-বাগানের- আমি তখন আমার সাদা ছড়িটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যেতাম। আমি তীব্রভাবে অনুভব করতাম- তাদের সে উচ্ছ্বাস আমার ভেতর ভেতর বিস্ফোরক ক্রোধের জন্ম দিচ্ছে। খুব অভিমান হোত সৃষ্টিকর্তার ওপর- আমাকে তিনি দেখবার ক্ষমতা দেন নি, কিন্তু আবার প্রকৃতিকেও সাজিয়ে রেখেছেন কি বিপুল ঐশ্বর্যে....

তবে আজ আর আমার সে অভিমানটুকু নেই, কারণ- প্রকৃতির না দেখা সে রূপের কিছুটা হলেও আমি অনুভব করতে পেরেছি। ঘটনাটা অবশ্য বলার মত কিছু না। আমি নিজেও মানুষ হিসেবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ না যে- আমার কথা আপনারা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনবেন! তারপরো ভালো লাগার কিছু কথা জানিয়ে যেতে বড় ইচ্ছা করে। হোক না সেটা অগুরুত্বপূর্ণ কোন মানুষের স্মৃতি, অনুভূতিগুলো তো খাটি। সেখানে তো আর কোন খাদ নেই!

হাসপাতালে এডমিট হবার পর গত পরশু আমাকে দেখতে রফিক এসেছিলো। তখন হঠাৎ কি মনে হোল- রফিককে বললাম যেনো আমাকে রূপসী বাংলার কবিতাগুলো একটু আবৃত্তি করে শোনায়! আমি জানতাম- রূপসী বাংলার প্রতিটি কবিতা রফিকের মুখস্থ। আমার কথা শুনে প্রথমে একটু অবাক হলেও শেষমেষ অবশ্য সে আর 'না' করতে পা্রলো না (মৃত্যুপথযাত্রী, প্রিয় বন্ধুর অনুরোধ বলে কথা!) সুতরাং, খানিক বাদেই দেখা গেলো আমি প্রবল উৎসাহ নিয়ে বিছানার বুকে আধশোয়া হয়ে বসেছি... রফিক আমার মাথার কাছে রাখা কাঠের চেয়ারটাতে হেলান দেয়, তারপর কিছুটা সময় চুপ করে থেকে গাঢ় গলায় আবৃত্তি শুরু করে-

"এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;- বারবার রোদ তার সুচিক্বণ চুল
কাঁঠাল জামের বুকে নিঙড়ায়ে;- দহে বিলে চঞ্চল আঙুল
বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন..."


সময় বয়ে চলে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি আমার প্রিয় কবির নির্জন সব কবিতা। মায়াভরা কন্ঠে রফিক আবৃত্তি করে যায়-

"কোথাও মঠের কাছে — যেইখানে ভাঙা মঠ নীল হয়ে আছে
শ্যাওলায় — অনেক গভীর ঘাস জমে গেছে বুকের ভিতর,
পাশে দীঘি মজে আছে — রূপালী মাছের কন্ঠে কামনার স্বর
যেইখানে পটরানী আর তার রূপসী সখীরা শুনিয়াছে
বহু বহু দিন আগে — যেইখানে শঙ্খমালা কাঁথা বুনিয়াছে
সে কত শতাব্দী আগে মাছরাঙা-ঝিলমিল — এঁকেছে কড়ির ঘর..."


"ভেবে-ভেবে ব্যথা পাবো;- মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকিতাম বেঁচে
দেখিতাম সেই লক্ষ্মীপেঁচাটির মুখ যারে কোনোদিন ভালো ক'রে দেখি নাই আমি-
এমনই লাজুক পাখি,- ধূসর ডানা কি তার কুয়াশার ঢেউয়ে ওঠে নেচে;
যখন সাতটি তারা ফুটে ওঠে অন্ধকারে গাবের নিবিড় বুকে আসে সে কি নামি?
শিউলির বাবালার আঁধার গুলির ফাঁকে জোনাকির কুহকের আলো
করে না কি? ঝিঁঝিঁর সবুজ মাংসে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে বউদের প্রাণ
ভুলে যায়; অন্ধকারে খুঁজে তারে আকন্দবনের ভিড়ে কোথায় হারলো
মাকাল লতার তলে শিশিরের নীল জলে কেউ তার জানে না সন্ধান...."


অপূর্ব সেসব কবিতা আমার মনের চোখে রঙ তৈরি করে, আমি কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পাই সে লক্ষ্মীপেচা অথবা বাংলার সবুজ, করুণ ডাঙা! চঞ্চল শালিক স্বপ্নীল বাস্তবতায় তার খয়েরী কোমল পাখা আমার হৃদয়ে ছোয়ায়; আমি কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাতের গন্ধ পাই, বুঝতে পারি কামরাঙ্গা লাল মেঘ ডুবে যাচ্ছে পদ্মাসাগরের ঢেউয়ে.... মায়াময় সে দৃশ্যগুলি আমার মনের গহীনে গভীর বিষণ্ণতা তৈরি করে, চোখদু'টো ভিজিয়ে তোলে গাঢ় আবেগে। দৃষ্টিহীন এক সামান্য মানবের চোখ থেকে ফোটা ফোটা গড়িয়ে পড়ে তরল, উজ্জ্বল স্ফটিক!

রফিক আবৃত্তি করেই যায়-

".....বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি — ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্নে ভরে;

সোনালি রোদের রঙ দেখিয়াছি — দেহের প্রথম কোন প্রেমের মতন

রূপ তার — এলোচুল ছড়ায়ে রেখেছ ঢেকে গূঢ় রূপ — আনারস বন;

ঘাস আমি দেখিয়াছি; দেখেছি সজনে ফুল চুপে চুপে পড়িতেছে ঝরে

মৃদু ঘাসে; শান্তি পায়; দেখেছি হলুদ পাখি বহুক্ষণ থাকে চুপ করে,

নির্জন আমের ডালে দুলে যায় — দুলে যায় — বাতাসের সাথে বহুক্ষণ,

শুধু কথা, গান নয় — নীরবতা রচিতেছে আমাদের সবার জীব...."

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৭ রাত ৮:০০
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×