somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বোঝা

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


লোকটার নাম সুবেশ পাল অথবা গোবিন্দ ধর। আবার নাও হতে পারে। বয়স — পঞ্চাশের এদিক ওদিক। এলোমেলো চুল, না-কামানো তিন দিনের আধা-কাঁচা দাড়ি। চোখ দুটো চকচক করছে চেলা মাছের মতো। গাল বসে গেছে, যেন অদৃশ্য দুটো আঙ্গুল চেপে ধরে অবিরাম চোয়ালটাকে সামনে টানছে। এখনও বুঝতে পরিষ্কার — কোনও এক কালে মুখটা ভরাটই ছিল দেখতে, চোয়ালের ভারে তা ঝুলে পড়েছে। উদোম শরীরে হাঁপাচ্ছে— দৌড়ুচ্ছে, চোখ বুজে… কাঁধে ঝুলে পড়ছে বারবার ম্যালেরিয়ার রোগী — মেয়ে অনিন্দিতা।
‘মা শক্ত হ, মাথা ভাল করে ধরে থাক, পড়িস না…’

বাঁশঝাড়ের শুকনো পাতা ভয়ে সামনে সরে যায়। শেয়াল অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হলদি-ক্ষেতে একটু থামে সে — কথা ভেসে আসে পাশ থেকে। ডানে-বামে তাকিয়ে, সুবেশ বা গোবিন্দ বোঝার চেষ্টা করে কিছু। মিনতিভরা করুণ কণ্ঠ কেঁদে ওঠে, ‘বাবারা আমার মেয়েটি খুব ছোট — তোমরা একজন করে আসো…’ কিন্তু কথাগুলো রূপান্তরিত হয় ঘোড়া শাবকের চি হি হি চি হিতে।
‘যে কয়জন খুশি… তোমার কী… তোমার মাইয়ারে বড় কইরা দিতাছি। আমরা সব পারি, চাইয়া চাইয়া দেখো …’

ছুটতে থাকে আবার, কবরস্থান বামে ফেলে। পড়ে থাকে কবরের শূন্যতা… কবর এসে সামনে দাঁড়ায় — ছোন-গাছের সারি ফাঁড়ি দিয়ে, ভেতর দিয়ে ছুটতে থাকে। সঙ্গে ছুটে আসে খরগোশ-ছানা, কিছুদূর পথ দেখিয়ে যায়। তারপর কেটে পরে।

একটা পুকুর — চাঁদ উঠেছে গোল হয়ে — ভাসছে জলে — দেখার কেউ নেই। জ্যোৎস্না হাবুডুবু খেয়ে মরতে বসে — বাঁচাবার কেউ নেই। পাড় ধরে যেতেই দাঁড়িয়ে পড়ল — কয়েকজন মানুষের জটলা। ‘এসো না এদিকে, মেয়ে মানুষ আছে।’

সে-ও ছুটতে শুরু করেছিল, যদিও নিষেধ ছিল, তার জোরে হাঁটার। সবার দেখাদেখি ঘরে থাকেনি, বেরিয়ে পড়েছে। ছুটে এসেছে অত-বড় পেট নিয়ে। দৌড়ের মধ্যে জন্ম নিয়েছে, একটি কান্নার। সবাই চেষ্টা করছে শিশুটাকে বাঁচাবার। মা-টি থরথর করে কাঁপছে … বুঝতে পারছে না, কী তার অন্যায়। ডাক্তারের নিষেধ না মেনে দৌড়নো — শিশুকে গর্ভধারণ ভুল সময়ে — না কি একরত্তি এই আদরকে আছাড় মারা …

আঁচলে মুখ ঢেকে আছে, কিছু করার নেই বলে। শিশুটি ফের কেঁদে নড়ে উঠল। এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে কিছু খুঁজল মনে হয়। অথবা ইশারা করল কোনও। ছোঁ দিয়ে নিয়ে নিল কেউ। মাকে দুজন ধরল দুদিক থেকে। আবার ছুটতে থাকল তারা।


অনিন্দিতা ঘুমিয়ে পড়েছে বাবার কাঁধে। খেয়াল নেই বাবার। তার লক্ষ্য একটাই — কীভাবে পেরিয়ে যাবে এই লোকালয় ছেড়ে, দূরে, বহুদূরে। যেখানে কোনও মানুষ নেই, কোনও অবিশ্বাস নেই — কেউ চেনে না — সবাই পর … পা টলে যাচ্ছে বারবার। পিঠের সাথে পেট প্রায় লেগে আছে। মনে হয় নাড়ি-ভুঁড়ি, কলজে, কিডনি কিছুই নেই — মসৃণ পেট। এই পেট তো আর কারও হতে পারে না। তাইতো! এটা তো সেই পেট বলেই মনে হচ্ছে! আর তার কাঁধে! ঐ তো ক্রুশ … তিনি বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কোথায় যাচ্ছেন তিনি? তাঁর দৌড়নো দেখে মনে হয় — নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানোর জন্য সম্মোহিত! তাঁকে যেখানে ক্রুশবিদ্ধ করা হবে, সেই স্থান খুঁজছেন! কাঁধের ভার থেকে মুক্তি পেতে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাইছেন!

বিলের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে পা ফেলল, এক নতুন শহরে। মিশে গেল কোলাহলে, জনতার ভীরে।

লোকটির নাম বের করা, খুব কঠিন হবে, মনে হয় না। পরিষ্কার মনে আছে — পূর্ণিমারানি, উল্লাপাড়া, মুখে উচ্চারণ করেছিল। সে ঘনঘন শ্বাস ফেলছিল, কথা বলছিল হড়বড় করে। কিন্তু নাম দুটি সে স্পষ্টই উচ্চারণ করতে পেরেছিল।


এখনও শহরে মেয়েকে কাঁধে করে ঘুরে বেড়ার সে। মুখ শুকিয়ে থাকে, চোয়াল আরও ভেঙ্গে গেছে, চোখে-মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে থাকে সব সময়। চারিদিকে তাকায় অবিশ্বাসের চোখে, তারপর আবার ছুটতে থাকে, ভুল জায়গায় থেমেছে বলে।

আমাদেরকে কেউ ধাওয়া করে নিয়ে এসেছে এই ঘরে। চিৎকার করি আর বাইরের শীতের ভয় দেখাই পরস্পরকে। শীত জেঁকে বসেছে এবার। ঠাণ্ডা হাওয়ায় জানালা কাঁপতে থাকে। ফাঁক-ফোকর খুঁজতে থাকি, এক ফোঁটা বাতাস যেন ঢুকতে না পারে ঘরে। শেয়াল কেঁদে ওঠে। বাদুর উড়ে যায়, শিশির ভেঙ্গে।

টেবিলে পড়ে থাকা সংবাদপত্র তুলে নেই কেউ। পড়তে থাকি — সবাই ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বা হাতে গাল ভর দিয়ে, গম্ভীর হয়ে শুনতে থাকি। পাঠককে মাঝেমাঝে মনে হয় — কোনও আলখাল্লা-ধারী পাদ্রী বাইবেলের কোনও কাহিনী বর্ণনায় ব্যস্ত।

‘নির্বাচন শেষ না হতেই সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ’ ‘ধর্ষণ অগ্নিসংযোগ মারপিট’ ‘সারাদেশে বিজয়ী দলের তাণ্ডব।’ ডাইরির অংশটুকুতে লেখকের নাম বা কোনও তারিখ নেই — ছিঁড়ে ফেলা। আমরাই কেউ হয়ত এক ফাঁকে করেছি তা, কিন্তু স্বীকার করছি না কেউ।

পিতামহের সাথে আমরা তর্কে জড়িয়ে পড়ি।
‘লোকটি সুবেশ পাল বা গোবিন্দ ধর নয়, ওর নাম অমর সিং। লাহোরের পাশেই একটা জায়গায় ছিল ওর বাড়ি। তখন পাঞ্জাব বিভক্ত হয়নি — আমাদের সঙ্গে কাজ করত। দেখতে তখন ছিল বেশ, আর খাবার তৈরিতে ছিল ওস্তাদ। যে ছেলের কথা তোরা বলছিস — কাঁধে করে ঘুরে বেড়ায় — ওর নাম অনিন্দিতা নয়, নিনাদ সিং।’
ইসমাইল মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে, ‘হতেই পারে না। ওর সাথে দেখা হয়েছিল আমাদের রিয়াদে। ভাষা শুনেই বুঝেছিলাম ও ফিলিস্তিনই।’
কোণা থেকে মোচড় দিয়ে জয় কেশে যোগ করল, ‘যে মেয়েটির কথা বলছ — ওর নাম ইসাম্বা, কঙ্গোর মেয়ে। শত্রু-গোষ্ঠীর লেন্দু উপজাতির কয়েকজন, তার স্বামীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে ওরা এসে ওকেও নিয়ে যায়। ভেবেছিল কিছু শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। মেয়েটির সামনে, ওর স্বামীকে ওরা জবাই করল। টুকরো টুকরো করে কাটল, সেই মাংস রান্না করতে বাধ্য করল। কাঁদতে কাঁদতে রান্না করে মেয়েটি। ভোজের সময় তাকেও সেই মাংস খেতে বাধ্য করে। সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে পালাচ্ছিল, বমি করতে। ওর কোনও গর্ভপাত হয়নি — ওটা ছিল বমি — উদর ভর্তি করা স্বামীর দেহ। যেহেতু লোকটি দৌড়োতে দৌড়েতে তাকে দেখেছিল। দুজনের বাড়ি একই এলাকায় হবারই কথা। যে কোনও একজনের ঠিকানা বের করলেই হয়ে যায়।’

পিতামহ কিছুতেই মানতে নারাজ, ‘ও অমর সিং-ই হবে।’
আমি বলি, ‘আপনার কথা যদি ঠিক হয়ে থাকে, তবে এটা কেমন কথা যে — এত বছরেও সে নিরাপদ একটু জায়গা পায়নি, যেখানে ছেলেকে কাঁধ থেকে নামাতে পারে। যখন আপনি তাকে চিনতেন, সে তো যুবক ছিল।’ দাদু একটু হাসলেন।

আমাদের তর্ক চলতেই থাকে — কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারি না। তবে একটা বিষয়ে সকলেই একমত হই — লোকটি এখনও জীবিত, এই শহরেই থাকে আর ঘুরে বেড়ায়। সে কাউকে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না।


আহা রুবন
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:৩৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যারিস্টার সুমন দায়মুক্ত , চু্ন্নু সাহেব কি করবনে ?

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ০৮ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৭


দেশে প্রথম কোন সংসদ সদস্য তার বরাদ্ধের ব্যাপারে Facebook এ পোষ্ট দিয়ে জানিয়ে থাকেন তিনি কি পেলেন এবং কোথায় সে টাকা খরচ করা হবে বা হচ্ছে মানুষ এসব বিষয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৮










চিত্রকলার কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ছোট বেলায় যেটুকু শিখেছিলেন গৃ্হশিক্ষকের কাছে আর পাঁচজন শিশু যেমন শেখে। সে ভাবে আঁকতেও চাননি কোন দিন। চাননি নিজে আর্টিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতা বনাম ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত বিবিধ দোষ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৪



জাহান্নামের শাস্তির তীব্রতার বিবেচনায় মুমিন ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে অমুসলিম উপস্থাপিত দোষারোপ আমলে নেয় না। আমার ইসলাম সংক্রান্ত পোষ্ট সমূহে অমুসলিমগণ ইসলামের বিবিধ ক্ষেত্রে বিবিধ দোষের কথা উপস্থাপন করে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×