পালিত হয়ে গেল মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার জন্য অঙ্গিকার করলাম নতুন করে। প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালাম। আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা ছাড়াও শিক্ষার্থীদের কুচকাওয়াজ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল দেশের বিভিন্ন স্থানে। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়া হল। কিন্তু বিস্তৃতি কতটা ছিল, কতটা গভীরে ছিল এর আবেদন? এ প্রশ্ন করাই যায়।
এখনও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যারা ঠিক মতো জাতীর সঙ্গীত গাওয়ায় না। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে সে আশা করা বোকামি।
জাতীয় দিবসগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ খোলা রাখতে নির্দেশ দেয়ায়, গত কয়েক বৎসর যাবত খোলা রাখা হয়। উদ্দেশ্য—এদিন শিক্ষার্থীরা জাতীয় দিবস নিয়ে বিভিন্ন খোলামেলা আলোচনা করবে। আয়োজন করা হবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ তাদের মনে ছড়িয়ে দিতে পারব। ইতিহাস সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর হবে। সরকারি নির্দেশ আসার পরে থেকে শিক্ষকগন শিক্ষালয়ে উপস্থিত থাকেন। শহিদ স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে বা মিলাদ পড়িয়ে তাঁরা বাড়ি ফেরেন। এটি এখন শিক্ষকদের দায় সারার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়, সেই ছাত্ররাই থাকে অনুপস্থিত! হ্যাঁ শুনতে খুব খারাপ লাগলেও বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের খুব সামান্য পরিমাণ স্কুলেই শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হয়। প্রত্যেক অভিভাবক, শিক্ষকদের সচেতন করা না হলে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর তদারকি না করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।
দেশে ভয়ানকভাবে জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে গিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবার মধ্য ছড়াতে পারিনি, স্বাধীনতা অর্জনের এত বছর পরেও রাজাকারের সমর্থকদের দেখি। যাদের মধ্যে অনেকেই জন্মেছে একাত্তর পরবর্তী সময়ে। এ ব্যর্থতা আমাদের, এ লজ্জা সবার! তরুণদের বিরাট অংশ নেশায় বুঁদ হয় আছে—মহামারির মতো ক্রমাগত বাড়ছে। শহর, উপশহর হতে আজ অখ্যাত গ্রামে থাবা বসিয়েছে নেশার বিষবাষ্প। খেলা-ধুলা, যাত্রাপালা, পল্লীগানের আসর, লাঠি খেলা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তরুণেরা ব্যস্ত থাকবে কী নিয়ে! উর্বর ভূমিতে চাষাবাদ না করলে আগাছা জন্মাবেই।
সমাজের এই সমস্ত আগাছা উপড়ে ফেলতে হলে আমাদের মূলে ফিরে যেতে হবে। আমাদের বারবার স্মরণ করতে হবে আমাদের পূর্বতনরা দেশের জন্য কতটা ত্যাগ করেছেন। কতটা ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীন দেশ। চিন্তাকে প্রসারিত করতে হবে, আশা জাগিয়ে তুলতে হবে। এটি অবিরাম প্রক্রিয়া। আমাদের আছে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যেগুলো আমাদের সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারে। প্রত্যেকটি দিবসে ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত হবে, তারা রচনা লেখার প্রতিযোগিতা করবে, ছবি আঁকবে, কবিতা লিখবে, কবিতা আবৃত্তি করবে, গান করবে, নৃত্য করবে, নাটক করবে, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেবে তাঁর বীরত্বের গল্প শুনবে, লাঠি খেলবে, এসবের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরবে। আর এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবে অভিভাবক, ছোট-বড় ভাই-বোন, প্রতিবেশী, মহল্লাবাসী। কেন এমন হতে পারে না? আমাদের সমস্যা কোথায়?
এমন কি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু বিষয়ে সর্ব সাধারণের অংশ গ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে। নাগরিকরা, প্রধানত তরুণরা যেন তার এলাকার বিদ্যালয়ের সঙ্গে, তাদের অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকে তার উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই-না জাতি হিসেবে আমরা সবাই অগ্রসর হতে পারব। আমাদের ধারণাটা বদলাতে হবে, জাতীয় ছুটিগুলো যে বাড়িতে ঘুমনোর জন্য নয়—নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের জন্য, সন্তানের সঙ্গে তার বিদ্যালয়ে কাটানোর জন্য—এই বোধ তৈরি করতে হবে। এজন্য সচেতনদের এগিয়ে আসতে হবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচারণা চালাতে হবে এবং তদারকি জোরদার করতে হবে।
আমার এ লেখাটি আজকের ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৭ সকাল ৮:১৬