somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের দরবেশ

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ওর নাম এখনও জানা হয়নি—কেননা ওকে কেউ কখনও নাম ধরে ডাকত না। জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকত। আর সে যদি অপরিচিত বা বাইরের কেউ হত বলত ‘দরবেশ’।
বার বছরে যখন গ্রাম ছাড়ি সে সমবয়সী ছিল। পরে গ্রামে গেলে আর দেখা পাইনি—শুনেছিলাম কাপড়ের দোকানে কাজ নিয়েছে।

কুচকুচে কাল গায়ের রঙ, লিকলিকে পাতলা শরীর আর বকের মত করে মাটিতে পা ফেলত—আধ মাইল দূর থেকে ঠিক চিনে নেয়া যেত ওটা ‘দরবেশ’। চোখ দুটো ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ বড়—পাতলা দেহ যেটাকে আরও বেশি স্পষ্ট করে তুলত—দুধের মত ধবধবে সাদা অক্ষি গোলক। আমাদের মাজেদা ফুফুর ছেলে সে।

জন্মের পর গায়ের রঙ দেখে বাবা বলল ‘এটা আমার না...’ অবাক বাড়ির মানুষ। ‘তবে কার?’ যতই বোঝানো হয় চেহারা তো দেখা যায় বাপের মত। কিন্তু বাপের এক কথা ‘আমি শ্যামলা, মায়ে ধলা—আমার বাপ-মা, ভাই কারে দেখো এই আলকাতরার চেহারা?...’ সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
‘তুই আমার চেয়ে বেশি জানোস! বউরে দুই বছরে বাড়ির বাইরে যাইতে দিছোস নাকি? বাপের বাড়িতেও তো যাইতে দিলি না... বউয়ের নামে কলঙ্ক দিবি না খালি খালি...’ মায়ের কথা শুনে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তমিজ।

বাপের ঘৃণা আর পরিবারের অন্যদের দয়ায় বড় হতে থাকে সে। ওর মায়াভরা বড় বড় চোখ দুটো অনেক কথা বলত। যখন বয়স দুইয়ের মত, অল্প অল্প কথা ফুটছে। এক দিন মুড়ির বাটিতে খেজুর গুড় দিয়ে মা বলল ‘যা তোর বাপকে দিয়া আয়। বাবা বইলা ডাক দিস।’
তমিজ ভাঙ্গা একটা বেড়া মেরামতের জন্য উঠোনে বসে বাঁশের বাতা চাঁচছিল।
‘বা-য়া-বা-য়া মুলি নে...’
বাঁশ চাঁচা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এক লাফে। লাথি দিয়ে মুড়ির বাটি ফেলে দেয় তমিজ।
‘বাবা না?! কে তোর বাপ? কোনকার কোন জাইরা... আবার যদি বাপ কইছোস... এই দাও দিয়া টুকরা টুকরা কইরা... চোখ গাইলা দিমু—দেখোস কী? বাপ ডাকনের খুব সখ...’ ভ্যা করে কাঁপতে থাকে শিশুটি। হাতে দা নিয়ে রা রা করে ঘরে ঢোকে তমিজ।
‘ওই মাগি যদি আমার ভাত খাইবার চাস, ঐ বেজন্মারে বিদায় কর... মায়ের কথাও আজ রাখমু না...’ সেদিন বিকেলে থেকে সে আমাদের গ্রামে।

নানির কাছে বড় হতে থাকে। কিন্তু কাউকে সে কোনও সম্বোধন করে না। সবাই ভাবল বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। যখন বয়স ছয়, নানি মানা গেল। তত দিনে আমাদের গ্রামটাকে সে নিজের করে নিয়েছে। মামাদের সঙ্গে ক্ষেতে যায়, ছাগল চরায়, কখনও ভাতের ভাণ্ড মাথায় করে ক্ষেতে যায়। ফাঁক-ফোকর পেলে আমাদের সঙ্গে খেলায় যোগ দেয়। আমরা খেলার সময় এসে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে থাকে। যদি তাকে কেউ বলে ‘খেলবি?’ কিছু না বলে চলে আসে—যে দলেই নেয়া হয়, ওর কোনও আপত্তি থাকে না। খেলার সময় ওর কোনও অভিযোগ থাকে না—আসলে সে অভিযোগ করতেই জানত না। আমরা যা ধার্য করতাম তাই মেনে নিত—কিন্তু সমস্যা একটাই কথা বলে না, কাউকে ডাকে না সে।

এক দিন খাবার পর মামি মামাকে বলল ‘তোমার দরবেশকে ডাক দাও। ভাত দিয়া উঠান ঝাড়ু দেই।’ সে কারও সামনে খাবার খেত না—থালা নিয়ে বসে থাকত। মামির দেয়া ‘দরবেশ’ নামটাই ওর নাম হয়ে গেল মুখে মুখে।

দরবেশের কথা শোনার জন্য আমরা উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। হঠাৎ করেই সে কথা বলে উঠত, আর সেসব ছিল একেকটা বোমার মত—মারাত্মক কৌতুককর। কথা বলত না দেখে, আমরা প্রচণ্ড বিরক্ত হতাম—পরিণামে এর ওর কাছে মার খাওয়াটা ছিল নিত্যকার ঘটনা। অথচ সে কাঁদত না, শুধু বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকত। আমরা বলাবলি করতাম দরবেশ বিড়ালের মাংস খেয়েছে তাই ও ব্যথা পায় না, ওর চোখে জল তৈরি হয় না তাই লজ্জাও নেই। কে যেন বলেছিল চোখে জল না থাকলে লজ্জা শুকিয়ে মারা যায়। চুপ করে দাঁড়িয়ে সে মার খেত—আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে বুঝত মার খাওয়া শেষ হয়েছে, তখন সে হেঁটে বাড়ি চলে যেত। কখনও অভিযোগ করত না। বিকেলেই যদি খেলায় ডাকা হত, কোনও রকমের ইতস্তত না করে সামনে এসে দাঁড়াত।

এক দুপুরে আমারা মাত্র কলা পাতায় কাঁচা আম নুন-মরিচ মেখে খেয়ে উঠেছি। ওকে দেখলাম ভেজা প্যান্ট পরে ওর মামা বাড়ির দিকে যাচ্ছে। জহিরুল বলল ‘মনি তুই যদি দরবেশকে মাইরা কান্দাইবার পারোস আধ সের গরম জিলাপি খাওয়াব।’
মনি ডাক দিতেই দরবেশ পেছন ফিরে একটু তাকিয়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। মনি পটল ক্ষেতের বেড়া থেকে একটা কঞ্চি উঠিয়ে দরবেশের উরুতে দুটো বাড়ি মারল। দরবেশ দু হাতে সেখানটায় চেপে ধরে। সে মনির দিকে তাকিয়ে থাকল, কিন্তু কিছু বলল না। মনি এরপর সপাসপ বাড়ি দিতে থাকে। জায়গায় জায়গায় লম্বা হয়ে ফুলে উঠতে লাগল—হালকা রক্তের রেখার মত দেখা গেল। কিন্তু ওর চোখে কোনও জল নেই—শেষে মনি কঞ্চিটা দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। মাথা নিচু করে দরবেশ ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। তখনই দেখা গেল ওর ছোট মামাকে। হাল চাষ করে গরু নিয়ে কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে বাড়ি ফিরছে।
‘আপনাগোরে দরবেশকে মাইরছে...’ তোরাবের বুদ্ধি-সুদ্ধি বরাবরই কম। আমার আঁতকে উঠলাম। ওকে ডাক দিয়ে থামায়, কিন্তু ওর ছোট মামাকে কারও নাম বলল না।
বারবার জিজ্ঞেস করায় শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। বিরক্ত হয়ে ওর মামা হাতের গরু পিটানো লরি দিয়ে দু ঘা লাগিয়ে বলল ‘যা শালা মর গা...’

অনেক দিন পর তালুকদার বাড়িতে অনিক ভাই এসেছে। ছাত্রাবস্থায় ছুটি হলেই চলে আসত মামা বাড়িতে—তাদের নাকি গ্রামে বাড়ি ছিল না, আদি বাড়ি শহরে। নতুন বৌ নিয়ে এসেছে দেখাতে। অনিক ভাই আমাদের ডেকে বলল ‘একটা ফুটবল খেলার আয়োজন কর তোরা দক্ষিণ পাড়ার সাথে—পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। আর যারা জিতবে তাদের একটা ভাল বল দেব। হারজিতের সবাই এক সাথে বনভোজন করব—একটু আনন্দ, ফুর্তি করব। আমি মাংস, মসলা, ডাল দেব। তোরা চাল আর খড়ি দিবি—খিচুরি মাংস হবে।’
আমারা সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। খেলার দিন দরবেশকে গোলরক্ষক করা হল। ও বেশ কয়টা নিশ্চিত গোল হওয়া থেকে আমাদের বাঁচাল। আমাদের দল দুই গোলে জিতে যায়।

সন্ধ্যায় ফাঁকা ধান ক্ষেতে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে , এক চুলোয় খিচুরি, অন্যটায় মাংস-আলু রান্না হচ্ছে। বাবুর্চি আমরাই—অবশ্য অনিক ভাইয়ের বৌ—আমাদের নতুন ভাবি মাঝে মাঝে দেখিয়ে দিচ্ছে।

খেলা শেষ হবার পর থেকে অনিক ভাইকে দেখা যাচ্ছে না। তার গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন গেছে। হঠাৎ হৈ হৈ রবে অনিক ভাইয়ের কণ্ঠ শোনা গেল।
‘তা বাবুর্চিরা বাতাসে যে- ঘ্রাণ ছুটেছে...তর সইছে না।’ ঢাকনা খুলে দেখল আনিক ভাই। এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘কীরে! দরবেশ কোথায়?’ এতক্ষণে আমাদের খেয়াল হল—আসলেই তো? দরবেশ গেল কোথায়! ওকে ডাকার জন্য লোক পাঠিয়ে আসছি বলে অনিক ভাই বাড়ি চলে গেল।

দরবেশকে ডেকে আনা হয়েছে। ভাবিকে সঙ্গে করে একটা ব্যাগ নিয়ে এল। ‘কী রে, সবাই আনন্দ করছে; আর তুই কোথায় গিয়েছিলি?’
‘আমি চাল দেই নাই।’
‘আমি জানি তুই তোর মামির কাছে চাল চাবি না। তাই আমিই দিয়ে দিয়েছি।’ অনিক ভাই ব্যাগটা দরবেশের হাতে দিল ‘খুলে দেখ।’
দরবেশ ব্যাগ হাতে করে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল। ক-বার বলার পরও যখন সে ব্যাগ খুলল না, তখন অনিক ভাই ব্যাগ হাত থেকে নিয়ে এক সেট সুন্দর সার্ট-প্যান্ট বের করে ওর গায়ের সাথে লাগিয়ে ধরে রইল।
‘হ্যাঁ ঠিক আছে।’
আমরা সবাই হাত তালি দিয়ে সন্ধ্যাটা গরম করে ফেললাম। ওর সার্ট-প্যান্ট আমাদের হাতে হাতে ঘুরতে থাকল। দরবেশ ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে, শুধু থুতনিটা বুকের সঙ্গে লেগে গেছে।
‘কী রে দর-বে—শ! পছন্দ হয়নি!!’
কোনও সাড়া নেই। অনিক ভাই দরবেশের চিবুক ধরে উঁচু করল। ওর চোখ-মুখ কুচকে বিকৃত হয়ে গেছে। আমরা বিস্ময়ে হতবাক! দরবেশের দুচোখ বেয়ে অঝরে জল গড়িয়ে পড়ছে!!

ছবি - গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:৫৫
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×