somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অন্তরে বাহিরে

৩১ শে মে, ২০১৭ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



‘বাহ‍‍‍! তুমি দেখছি এলাহি কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছো! গ্রামের মধ্যেই এত বড় কাজ আর আমরা জানিই না! কাগজে তোমার ছবি দেখে তো চোখের পলক আর পড়ে না...’
‘আসলে স্যার গ্রামের শেষ মাথায় তো, আর আসতেও নদী পাড় হতে হয়... বসুন স্যার, গাছ-তলাতেই। খুব ঠাণ্ডা-ছায়া লিচু গাছের। আমি সারাদিন এখানেই কাটিয়ে দেই।’
চেয়ার জোড়া এগিয়ে দিতে দিতে বলল রহমত আলি। ইদানীং নামের সঙ্গে লিচু যুক্ত হয়েছে—লিচু রহমত।
‘মনিরুল, রহমত আমার ছাত্র ছিল, অবশ্য ভাগ্নেও হয়।’
‘আমি আসছি স্যার, মনিরুল চল-তো।’
হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল বাগানের পশ্চিম প্রান্তে।
‘কিরে তুঁতে কম পড়বে না তো?’
‘হয়ে যাবে।’
গলা চড়িয়ে দিল রহমত, ‘কাজ বাদ দে। স্যার এসেছেন—পাকা দেখে গোটা-পাঁচেক লিচু নিয়ে আয়। খুব বড় মনের মানুষ বুঝলি। তেমনি রুচিমান। আমরা ক্লাসে যমের মত ভয় করতাম। কোনও দিন তাকে ইস্ত্রি-বিহীন সার্ট পরতে দেখিনি। সবাই বলাবলি করত; তাকে নাকি কেউ কখনও দাঁড়ি মাখানো গাল দেখেনি, এমন কি কাটতেও দেখেনি। সেই কাক-ডাকা ভোরে শত ব্যস্ততার মধ্যেও ক্ষৌরকর্ম শেষ করে ফেলতেন। যৌবনে দারুণ বল খেলতেন, নাটক করতেন মঞ্চ কাঁপিয়ে। তাঁর হুঙ্কারে নায়কের অভিনয় তলিয়ে যেত ফুটো নৌকোর মত। পাঁট ফুট এগার ইঞ্চ লম্বা যে মানুষ, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর কেউ ভয় পাবে না তাই হয়! এখন দেখে অবশ্য অতটা লম্বা মনে হয় না। ... কিরে হা করে তাকিয়ে আছিস যে? কি বললাম তোকে? আচ্ছা থাক, জিজ্ঞেস করি কোন গাছের লিচু পছন্দ করেন? আগে দর্শনদারি তার পরে অন্য সব... ও কাজ করুক মনিরুল তুই-ই আয়।’

‘রহমত তোমার ছুটি কতদিন?’
‘এইতো মামা এক মাসের। সবাই অযথা ছুটি নষ্ট করে, আমি বাগানে সময় দেই। অনেক শখ করে বাগানটা করেছি মামা।
‘খুব ভাল, কতগুলো গাছ তোমার?’
ছোট-বড় মিলে ছেচল্লিশটা মামা।’
‘কাজের মত একটা কাজ করেছ...’
রহমত লজ্জা মাখানো হাসি দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাতে থাকে। তারপর সোজা হয়ে গলা পরিষ্কার করে বলে ‘পরশুদিন চৌধুরি সাহেব বাগানে এসেছিলেন। আমি তো অবাক! আমার বাগান দেখতেই গ্রামে এসেছেন। এমন মহৎ কাজ না দেখে থাকতেই পারলেন না।তাও আবার নিজের গ্রামের ছেলে করেছে...’
‘সে-তো করবেনই। আমিও খুব খুশি হয়েছি, তোমার কাজ দেখে। তোমার মত সচেতন যুবকেরা এ-ধরণের কাজে উদ্যোগী হলে দেশ থেকে অপুষ্টি বিদায় নিতে বাধ্য।’
‘তা যা বলেন স্যার। এই আর কী....’
‘না না মোটেই হালকা বিষয় নয়। অনেক বড় কাজ করেছ তুমি।’
গর্বিত ভঙ্গিতে রহমত বলতে থাকে ‘চৌধুরি সাহেবের সামনে পিরিচে করে লিচু দিলে কী বললেন জানেন স্যার?’ মামা স্যার জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালেন রহমতের মুখে। ‘খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলেন কিনা “এগুলো তো রসগোল্লার চেয়েও বড় বড়। ” নাকের কাছে ধরে ঘ্রাণ নিয়ে বললেন “প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।” বলেন কিনা আমায় “তোমার লিচুর কত বিক্রি করো?” বললাম, আট শত টাকা “মানে আট টাকা পিস।” তিনি একটা মুখে পুরে বলেন “এই অসাধারণ জিনিসটি দেখার জন্যই তোমাকে দেয়া উচিত দুই টাকা আর সুবাসের জন্য তিন টাকা। খাওয়ার জন্য দশ টাকা।” পাঁচটি লিচু খেয়ে আমাকে দুই-শ টাকা দিলেন।’
‘দুই-শ টাকা কেন?’
‘সে আর কী বলব?... বাকিটা মহৎ কাজের উৎসাহ প্রদান স্বরূপ....’
‘নিন স্যার একটু খেয়ে দেখুন।’
‘আসলেই অসাধারণ তোমার কীর্তি! এমন স্বাদের লিচু জীবনে কখনও খাইনি।’
‘চৌধুরি সাহেবও তাই বললেন। তা স্যার কিছু লিচু কি নেবেন?’
‘হ্যাঁ সেটাই ভাবছি। এই স্বাদ একা গ্রহণ করলে পরকালে হিসাব দিতে হবে। তোমার বাগানটাও কিন্তু বেস। গাছে গাছে পাখিরা ছোটাছুটি করছে। দেখলেই মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। আবার আসার সময় কাগজ-কলম আনতে হবে। কবিতা লেখার মত জায়গা বটে।’
‘ঠিকই বলেছেন স্যার। এখানে এলে মনের মধ্যে কেমন একটা ভাব চলে আসে। দুপুরের ঘুঘুর ডাক, বুলবুলির লাফালাফি চমৎকার লাগে।’
রাতের বেলা মাঝে মাঝে টর্চ হাতে গাছ তলায় চলে যায় রহমত। আলো ফেলে দেখতে পায় হাজার হাজার পরীকন্যারা পা ঝুলিয়ে ডালে বসে আছে— নকশাকাটা কাঁচুলি বুকে। ঘুম না ভাঙ্গে সাবধানে যত্ন করে লিচুগুলো— তার কাছে উদ্ভিন্ন যৌবনা পরীকন্যার স্তনে হাত বুলিয়ে চুপি চুপি আদর রেখে দিয়ে আসে প্রতি রাতে।

‘স্যার কতগুলো নেবেন?’
‘তোমার খুশি...’
ভ্রু কুঁচকে রহমত ভাবল কিছু।
‘না স্যার আপনি যতগুলো চাইবেন দিয়ে দেব। বলুন কতগুলো দেব, নিজের বাগানের জিনিস।’
‘নিশ্চয় আনেকেই চেয়ে রেখেছে, সবাইকেই তো খুশি রাখতে হবে। তোমার সুবিধা মত দিয়ো। দুই এক দিন পরেই পাড়বে তাই না?’
হ্যাঁ স্যার... কত দেব বললেন না কিন্তু?’
‘ঠিক আছে পাঁচ শত দিয়ো।’
‘কোনও অসুবিধে নেই, দিয়ে দেব। কত জনের কাছেই তো বিক্রি করি। সবার কাছে তো আর বেচা চলে না। আপনারা হলেন মানুষ তৈরির কারিগর, তারপর আবার মামা হন।’
স্যার মামা গর্বের সঙ্গে মুচকি হাসেন। ‘তোমাদের জন্য খুব গর্ব হয়। ফেলে আসা জীবনের কথা যখন ভাবি, একেবারে মন্দ লাগে না—কিছু মনে হয় করতে পেরেছি।’
‘কিন্তু একটা সমস্যা আছে স্যার।’ সার্টের পকেট থেকে একটা নোট বই বের করে হাতে দিল। তিনি হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরলেন, সাব্বির কাকা – ৩০০০, এসপি বদর – ২০০০, জহির ভাই – ৮০০, সাংবাদিক জাকির – ৫০০.....লম্বা লিস্ট, নোটবুকে থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞাসার চোখে তাকালেন স্যার।
‘চাহিদা মোট ৩০৬০০ কিন্তু গাছে আছে ২৮০০০ এর কিছু বেশি। নতুন গাছ তো দু-এক বছরে আরও ফলন বাড়বে তখন কোনও সমস্যা থাকবে না। অবশ্য উপায় আমি ঠিক করে রেখেছি। আপনি চাইলে না হয় একই জাতের লিচুই কিনে দিতে পারি। আপনি ঠকবেন না। ঘাটতি লিচু আমি তাই করব। আপনার জন্য না হয় একটু বেশিই করলাম—বাগান থেকে দিয়ে দিলাম। ঠকবেন না স্যার।’
‘তা পাঁচ শত কত হতে পারে?’
‘চার হাজার এর নিচে পাওয়া যাবে না স্যার।‘’
‘চার!’ চোখদুটো পিট পিট করতে লাগলেন।
‘কমে হবে না স্যার। এ জাতের লিচুর দাম বেশিই দিতে হবে, নইলে বোম্বাই জাত গছিয়ে দেবে।’
‘না থাক, তাহলে। চার হাজার টাকা দিয়ে লিচু খাওয়া.... না থাক, থাক.....’
‘ঠিক বলেছেন মামা—এত দাম দিয়ে লিচু খাওয়ার কোনও মানে হয়! লিচুতে হাইপোগ্লাসিন-এ তারপর মেথিলিন-সাইক্লোপ্রোপাইল গ্লাইসিন থাকে। ছোট লিচুতে এই আকাইমা জিনিস থাকে আরও বেশি। একসাথে বেশি লিচু খেতে নেই, নইলে শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা কমে পটল তুলতে হয়। লিচু সহজে হজম হতে চায় না, পেট গরম হয়। এর পুষ্টিগুণও কিন্তু খুবই কম মামা। এর চেয়ে আমড়া, তেঁতুল বা আইটা কলায় অনেক বেশি পুষ্টি থাকে। কেন যে গাধারা এত দাম দিয়ে এই সব খেতে যায়। সব জোচ্চোর, অবৈধ রোজগার—বুঝলেন স্যার!’

মামা স্যার বিড়বিড় করতে করতে মাথা নিচু করে রাস্তা ধরলেন। বাতাসে পাঞ্জাবিটা পতপত করে উড়তে লাগল। পিঠের ফাঁকে বাতাস ঢুকে মাঝে মাঝে ঢোল হয়ে উঠছে। আবার পরক্ষণেই গায়ের সঙ্গে পাঞ্জাবিটা লেপটে যাচ্ছে—রোগা শরীর ফুটে উঠছে।


‘মনিরু-ল’ একটা লম্বা ডাক ছাড়ে রহমত।
‘এই তো ভাই।’
‘লোকটা খুব অহঙ্কারী... হাঁটার সময় পথ যেন ভেঙ্গে ফেলতে চাইত। চক্ষুলজ্জা বলে কিছুই নেই। গলাবাজি করলেই যদি অভিনেতা হওয়া যেত, তবে গোরু হত সবচেয়ে বড় অভিনেতা। কোথায় লম্বা মানুষ! আমি তো দেখি মাথায় পাটের বোঝা নিয়ে এক কুঁজো কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি যাচ্ছে....’
‘ভাই কার কথা বলছেন?’
কটমট করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। মনিরুল চুপসে যায়, চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর বলল, ‘যা পাম্প চালা। গোসল করব।’
মনিরুল ফিরে যেতে নিলে চিৎকার করে বলল ‘হিসাবের খাতায় লিখে রাখ, বাদুড়ে খেয়েছে ১৭ তারিখে পাঁচটি লিচু। না লিখবি রক্তচোষা বাদুড়...’

ছবি: গুগল থেকে সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৭ দুপুর ১:০১
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×