এরপর এই ক্ষ্যাপাটে পিয়ানিস্ট নিজের ঘরে গেলে, পরিবারের সঙ্গে দাঁড়ালে ঠিকই এড়াতে পারেন না বাস্তবতা। একে একে কতাকে শুনতে হয় এবং মানতে হয় নাৎসিদের চাপিয়ে দেওয়া মৃতু্যগন্ধি শাস্তি। নাৎসিরা প্রথমে কেড়ে নেয় ঘর, তারপর অস্থাবর সব সম্পতি। স্পিলমানরা অধিকার হারায় পাবলিক পার্কের, 2000 মুদ্রার অধিক সব মুদ্রা দিয়ে দিতে হয়; ধীরে ধীরে স্বাধীনতাটাকেও গ্রাস করে ফেলে।
তাদের নিপে করা হয় কথিত নতুন ইহুদিপাড়ায়। আসলে নিপে করা হয় যুদ্ধবন্দিদের ক্যাম্পে। কেবল স্পিলমান একাই পালিয়ে যেতে সম হন। তিনি শহরে নাৎসিদের তত্বাবধানে কাজ নেন সাধারণ শ্রমিকের। সেখানে প্রতিদিন বাজির মতো ঘটতে থাকা মৃতু্যদণ্ডকে পাশ কাটিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি আর বেঁচে থাকা হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র ইহুদিসঙ্গীকে নিয়ে পরিকল্পনা করেন বিদ্রোহের।
পালানো ছাড়া বাঁচা অসম্ভব_ এমন মুহূর্ত যখন হাজির; দেহ ও মনে কান্তি ও বিতৃষ্ণা চলে আসে স্পিলমানের। তবু জীবনটাকে দেখার ইচ্ছেয় বিদ্রোহের আগেই স্পিলমান পালিয়ে যান কাজ থেকে খ্রিস্টান এলাকায় লুকিয়ে বাঁচার আশায়। সাহায্য মেলে সুন্দরী ভক্তের। নিঃশব্দে-ুধায় গৃহবন্দি হয়ে পালিয়ে থাকার একটা সময় এক ঘরে পরিত্যক্ত পিয়ানোর দেখা পেলেও স্পিলমানের বাজানোর মতা তখন শূন্য। কারণ, এতটুকু শব্দ হলেই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। আর ধরা পড়ে যাওয়া মানে মৃতু্য। অথচ পিয়ানো তাকে প্রতি মুহূর্তে ভেতর থেকে ডাকে। এই ডাকে বাস্তবিক সাড়া দিতে অপারগ হলেও মনে মনে হাওয়ায়-হাওয়ায় আঙুল চালিয়ে বাজাতে থাকেন নানা সুর। এ সময় এই পিয়ানো-পাগল মানুষটা অবয়বে ভেসে ওঠে সুকরুণ বেনার ছায়া।
1945 এর শীতের সময়টা আরো বৈরি হয়ে আসে স্পিলমানের জন্য। এ সময় টানা একমাস কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাননি তিনি। খাবার সরবরাহ করতে আসতে পারেন নি কোনো শোভাকাঙ্খি। তার দেহ ুধায় আর বন্দিদশার যন্ত্রণায় এতো রুগ্ণ হয়ে গিয়েছিল যে, তাকে দেখাচ্ছিল বস্তিতে ঝুলে থাকা শতচ্ছিন্ন পোশাকের মতো। এরকম অসহ্য সময়ে নাৎসিদের বোমা গুড়িয়ে দেয় তার লুকিয়ে থাকার ঘরের একটা দেয়াল। সেই দেয়াল দিয়ে যে অবাক আলো ঢুকে পড়ে, তার অলৌকিক আহ্বানে স্পিলমান বেরিয়ে পড়েন মৃতু্যর ভয়কে পাশে রেখে খাবারের সন্ধানে। খাবারের বদলে পাশে খুঁজে পান অগুণতি তাজা মৃতদেহ। এমন সময় নাৎসি এক অফিসারের হাতে ধরা পড়েন নির্লিপ্ত স্পিলমান। পিয়ানিস্ট জেনে শত্রু অফিসার তাকে পরিত্যক্ত পিয়ানোটার কাছে নিয়ে যান এবং তার থেমে তোলা সুরের মাদকতা 'ভালোমানুষ' অফিসারের মনের লুপ্ত কোমলাতাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। পােিলয়ে থাকা যায়গাটায় এসে স্পিলমানকে খাবার দিয়ে যাওয়া তো বটেই, এলাকা ছেড়ে পালানোর সময় নিজের শীতকিষ্ট-রুগ্ণ এই পিয়ানিস্টকে নিজের অফিসিয়াল পোশাকটাও দিয়ে যান এই নাৎসির বড় কর্মকর্তা।
যুদ্ধ শেষে আমৃতু্য ওয়ারশো থেকে পিয়ানোর ঝংকারে সবাইকে মাতিয়েছেন এই কিংবদন্তি পিয়ানিস্ট।
দর্শকের চোখ:
আত্মজীবনীর উপর ভিত্তি করে তৈরি এই চলচ্চিত্রটি রোমান পোলস্কির চমৎকার নির্মাণশৈলীতে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। নাৎসিদ্বারা অবরুদ্ধ এক ঠিকানাবিহীন মহিলা কেমন পাগলপরা হয়ে স্বামীকে খুঁজছে; হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে না পারায় পঙ্গু বৃদ্ধকে নাৎসি সেনারা কিভাবে উপর থেকে ফেলে দিচ্ছে, ুধার্ত বৃদ্ধ তরল খাবার ছিনতাই করতে গিয়ে বালুতে পড়ে গেলে কিভাবে কুকুরের মতো চেটে খাচ্ছে কিংবা প্রিয় শিশু সন্তান কোলে মরে যাচ্ছে আর তার মা হাজারো মানুষেরা কাছে প্রার্থনা করছে একফোঁট পানি_ অথচ কারো কাছেই এতটুকুও পানি নেই_ এরকম অনেক বাস্তব দৃশ্যকে পোলস্কি খুবই সূভাবে দেখাতে পেরেছেন। অথবা, সেই মেয়েটার কথা, দখলমুক্ত হবার আগমুহূর্তে যে দৌড়ে পালাতে গিয়ে পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে রাস্তায় ঠিক সেজদার ভঙিতে, আর ওভাবেই পড়ে থাকে অনেকণ, পাশ দিয়ে পালিয়ে যাবার সময় স্পিলমান সেজদা-ভঙ্গি এই নারীর মৃতদেহের দিকে যেভাবে তাকায়_ তাতে ফুটে ওঠে মানবতার প্রতি ভালোবাসার, জীবনের প্রতি মমত্ববোধের পবিত্র উপস্থাপনা।
ভেতরের খবর :
এ ছবির গল্প কোন ছায়া-গল্প নয়; বরং পোল্যান্ডের কিংবদন্তি পিয়ানিস্ট ওয়াল্ডিশ্লো স্পিলমানের আত্মজীবনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে 'দ্য পিয়ানিস্ট'। ছবিতে স্পিলমান চরিত্রে অভিনেতা আদ্রিয়েন ব্রডিকে যা যা করতে দেখা যায়, বাস্তবে ঠিক এমনই লোমহর্ষক সময় কাটিয়েছেন স্পিলমান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। এমনকি যুদ্ধ থেমে গেলেও 6 জুলাই 2000-এ 88 বছর বয়সে মৃতু্যর আগ পর্যন্ত ওয়ারশোতেই থেকেছেন স্পিলমান। আর তার প্রতি মমত্ববোধ দেখিয়েছিলেন যে জার্মান অফিসার, সেই ক্যাপ্টেন ওয়াল্ম হোসেনফিল্ড 1952 সালে সোভিয়েত যুদ্ধবন্দি কারাগারে নিহত হন।
তথ্য :
দ্য পিয়ানিস্ট
মুক্তির তারিখ : 27 ডিসেম্বর 2002 (ইউএস, লিমিটেড)
দৈর্ঘ্য : 2 ঘন্টা 28 মিনিট
পরিচালক : রোমান পোলস্কি
প্রযোজক : রোমান পোলস্কি, রবার্ট বেনমুসা ও এলিয়েন সার্ডে
চিত্রনাট্য : রোনাল্ড হারউড (ওয়াল্ডিশ্লো স্পিলমানের গ্রন্থ অনুসরণে)
সিনেমাঅটোগ্রাফি : পাওয়েল এলম্যান
সঙ্গীত : ওজিক কিলার
সম্পাদক : হার্ভ ডি লুসি
অভিনয় : আদ্রিয়েন রৃডি, থমাস রিচমান, এমিলিয়া ফঙ্, এড স্টপার্ড, ফ্যাঙ্ক ফিনলে, মওরিন লিপম্যান, জুলিয়া রায়নার, জেসিকা কেট মেয়ার প্রমুখ
[রুদ্র আরিফ : খিলক্সেত, ঢাকা; সেপ্টেম্বর 2006]
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



