লাইফ ইজ বিউটিফুল শুরুর আগে : কিছু মানুষ ক্লাউন হয়ে বাঁচে; অন্যরা নিজের ভেতরের ক্লাউনপনাকে আচমকা ধাক্কায় বাইরে ঠেলে দেয়। ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে গেলে স্কুলছাত্র রবার্তো বেনিনিকে জানা থাকলে ভালো হয়_ যার সহজাত হিউমার বিচু্যতি ঘটাতো রাসভারি খুঁত-সন্ধানী শিক্ষকদের, এমনকি শত্রুদেরও বিচলিত করতো। দেখতে যেমন-তেমন, অনেকটাই হাস্যকর চেহারার এই লোকটি নিজের সম্পর্কে ভালোই জানতেন। তার নির্মাণ করা বিখ্যাত ছবি 'লাইফ ইজ বিউটিফুল' তাই হয়ে উঠেছে অনবদ্য উপস্থাপন শৈলীতে পূর্ণ। ছবির ভেতরে : বুঝে ওঠার হিসেবে ছবিটাকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমভাগে নির্ভেজাল কমেডি। অন্যভাগে দর্শকের কাজ হয় কেবল কান্না চোখ মুছতে মুছতে বেকুবের মতো মুচকি হাসা! ছবির প্রধান চরিত্র গুডো। সময়টা 1939। ছবির শুরুতে গুডো চুরি করা গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ে শহরে। মজার ব্যাপার হলো, গাড়িটির ব্রেক ছিল না। এমন বেলা ভুল থেকে তার পরিচয় ঘটে এক উচ্চ পদস্থ ভদ্রমহিলার সঙ্গে। তার নাম ডোরা। সুন্দরী স্কুল শিকিা ডোরার প্রেমে পড়তে সময় লাগে না গুডোর। এক ফ্যাসিস্ট ক্লার্ক, যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ডোরার, অঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তাকে হটিয়ে ডোরার মনে ও জীবনে জায়গা করে নেওয়ার নানা কসরত চালায় গুডো। গুডো ওয়েটারের কাজ করে ইটালির একটি গ্রাণ্ড হোটেলে। সমকালীনতার সঙ্গে চমৎকার সামঞ্জস্যে ও সতর্কতায় ডোরা জীবনের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছিল একগুঁয়ে ফ্যাসিস্টের জীবনযাপন। গুডো তাকে মুক্ত করতে চায়। ছবির শুরুর দিকের যতো কমেডি, তাতে গুডোর অদ্ভুত ধরণের হ্যাটটির সঙ্গে নীরব অথচ সক্রিয়ভাবে খেলা করে মানবজীবনের করুণ নিয়তি। একই সঙ্গে এ সময়টা দর্শকদের জানান দেয় কিছুর উদ্বেগজনক তথ্য; যেমন_ গুডো দেখতে সুন্দর নয় মোটেই, অসম্ভব সুন্দরী মেয়ে ডেরা, দুজনের আর্থিক অবস্থাও আকাশ-পাতাল, তার উপর গুডো একজন ইহুদি, ইহুদি নয় তবু ডোরা ফেরাতে পারে না গুডোর ভালোবাসার আহ্বান। অভিজাত সম্প্রদায়ের এক অনুষ্ঠানে ভালোবাসার টান একটা টেবিলের নিচে ফোরে দুজনকে একান্ত কথা বলার ঝুঁকি নিতে প্ররোচিত করে। ধনীকন্যা ও আরেকজনের বাগদত্তা ডোরা সেইণে আবেগে থরোথরো করে কাঁপে, আর ফিসফিসিয়ে বলে_ 'আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে...!' তারপর পলায়ণ! অশেষ বুদ্ধির রাজা গুডো নিজের জীবনকে সাজাতে থাকে নিজের মতো, সঙ্গী ডোরা। কয়েকবছর পর, 1945-এ যুদ্ধের শেষ দিকে, ডোরা-গুডো আর তাদের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে জসুয়া অন্য ইহুদিদের মতো ফ্যাসিস্ট বাহিনী দিয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ট্রেনে করে তাদেরও নিয়ে যাওয়া হয় অমানবিক আর ভয়ানক 'ডেথ ক্যাম্প'-এ। সেই মর্মন্তুর জার্নিতে গুডো সহজাত কমেডিতে পরিবেশটাকে করে তুলে হাস্যরসাত্মক, যেন তার ছোট্ট ছেলেটা এবারো ঘাবড়ে না যায়। ডোরা ইহুদি নয়, তবু সেই মৃতু্যস্পর্শী যাত্রায় স্বামী ও সন্তানের সঙ্গ ছাড়েনি। ডেথ ক্যাম্পে সন্তানকে টেনশন ফ্রি রাখতে মজার যতো গেমস্ খেলছিল গুডো। বদরাগি ফ্যাসিস্ট কমা-ার যখন কথায় কথায় মৃতু্যদন্ডের হুমকি দিচ্ছিল আর তার কার্যকর করছিল নির্মমভাবে, তার দোভাষী হিসেবে ইটালিয়ান সহবন্দি ও তার সন্তানের কাছে গুডো সেসব বিষয়কে বোঝাচ্ছিল উলটো ও মজা করে। বলছিল, এই ক্যাম্পের নিয়ম হচ্ছে লুকিয়ে থাকা, যে বেশিণ গুটি মেরে লুকিয়ে থাকতে পারবে, সে তত পয়েন্ট পাবে। যে প্রথম 1000 পয়েন্ট পাবে, সে পাবে একটা সত্যিকারের ট্যাংক উপহার। আর একবার কারো চোখে ধরা পড়লেই সে ছিটকে পড়বে প্রতিযোগিতা থেকে। বলা বাহুল্য, ছেলের কাছে সহবন্ধিদের প্রতিযোগি হিসেবে উললেখ করেছিল গুডো। যুদ্ধটাকে, সহবন্ধিদের হত্যাদৃশ্যকে নানা কৌশলে মজা করে উপস্থাপন করেছে গুডো, এমনকি যুদ্ধ যুদ্ধদের শেষ সময়টায় ফ্যাসিস্টরা অবরোধ তুলে চলে যাওয়ার সময় যখন এলোমেলো গুলিতে হত্যা করছিল পলায়ণপর বন্দিদের, তখন ছেলেকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে লুকিয়ে রাখার সময় গুডো উৎসাহ দেয় এই বলে_ 'এই শেষবার, আজ যদি তুমি লুকিয়ে থাকতে পারো, সবার আগে তোমার 1000 পয়েন্ট হবে, তুমি তোমার স্বপ্নের ট্যাংক পাবে।' ছেলেটা ট্যাংক ঠিকই পেয়েছিল, ইটালিয়ান সৈন্যদের ট্যাংক দেখে সে ভেবেছিল_ এ উপহার তারই, তার বাবা পাঠিয়েছে; কিন্তু প্রকৃতার্থে একদম শেষবেলা স্ত্রীকে খুঁজতে গিয়ে ধরা পড়া গুডো হয়েছিল ফ্যাসিস্টদের শেষ শিকার। বন্দি অবস্থায়, নিশ্চিত মৃতু্যর মুখোমুখি হয়ে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে, কবরের মতো সুনসান মৃতু্য-উপত্যকার সময়কে সন্তানের জন্য উপভোগ্য করে তুলতে গুডোর যে হিউমার_ তা সাধারণ দৃষ্টিতেই অনন্যসাধারণ। ভেতরের ছবি: একবার টরেন্টোর এক ফিল্ম-ফ্যাস্টিবলে বেনিনি জানিয়েছিলেন, ছবিটাতে হিউমারের মধ্য দিয়ে তিনি ইতালিয়ান রক্ষণশীল গোষ্ঠীকে ব্যঙ্গ করতে চেয়েছেন; পানস্নরে এর প্রকৃত ম্যাসেজ সাম্যবাদের তখনকার অবস্থানকেও কটা করে। 'লাইফ ইজ বিউটিফুল' কেবল নাৎসি আর ফ্যাসিস্টদের ধ্বংসযজ্ঞই প্রকাশ করে না, মানুষের নৈতিক দিককেও ফুটিয়ে তোলে অনবদ্য ঢঙে। তুমুল দুঃসময়ে কোমল ভবিষ্যতের আশাবাদ আর 'ভালো'র অস্তিত্বকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টাও এতে পাওয়া যায়। অতীত বা বর্তমান থেকে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা কিংবা প্রবঞ্চনা শেখানোর চেয়ে সবকিছু শিশুদের সামনে উপস্থাপন করা উচিত সুন্দর ও নির্মলভাবে_ এ ছবিতে নিজের এ মতবাদকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন বেনিনি। কারিগর: নির্মাণ : ইতালি, 1997 ইউএস রিলিজ : অক্টোবর 1998 (লিমিটেড) সময় : 1 ঘন্টা 54 মিনিট পরিচালক : রবার্তো বেনিনি চিত্রনাট্য : ভিনচেনজু কিরামি ও রবার্তো বেনিনি প্রযোজক : গিলৌজি ব্রাচি ও এলডা ফেরি সিনেমা অটোগ্রাফি : টনিনো ডেলি কলি সঙ্গীত : নিকোলা পিওভানি অভিনয় : রবার্তো বেনিনি, নিকোলেটা ব্রাচি, গস্টিনো ডোরানো, সার্গেই বিনি বাস্ট্রিক, মারিসা প্যারাডাইস, হস্ট বুসল, জর্জ ক্যান্টারিনি মজার খবর: ছবিতে কেবল কাহিনী রচনা বা পরিচালনাই করেননি বেনিনি, এই মহৎ লোকটি অভিনয় করেছেন গুডো চরিত্রে। সুন্দরী ডোরার চরিত্রে অভিনয় করা নিকোলেটা ব্রাচিও তার প্রকৃত জীবনসঙ্গী। [রুদ্র আরিফ। খিলক্ষেত, ঢাকা। 2006]
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০০৬ ভোর ৫:১৭