somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্লাকআউট : অবদমনে ক্লান্ত ফড়িঙজীবন

২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৬ রাত ১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পরিবেশটা আমাদের পরিচিত। বিষয়টা আমাদের প্রতিদিনকার। তবু, আমরা, প্রতিদিনের জীবনে মৌলিক যে বিষয়টাকে পাশ কাটানোই শ্রেয় ভেবে নেই, অনেকটা রোদের গল্প করতে করতে জীবনের সঁ্যাতসঁ্যাতেপনাকে পাশ কাটানোতেই অভ্যস্থ_ সেই লুকিয়ে রাখা বাস্তবতাকে একটানে সরিয়ে ফেলেছেন ব্লাকআউটের নির্মাতা। বাল্লাকআউট দেখার পর, এ কারণেই, কিছুণ টাস্কি খেয়েছিলাম_ এই টাস্কি খাওয়ায় মুগ্ধতা নেই, মুগ্ধতা তো রোদের বিষয়, প্রকাশ্যে গর্ব বিলিয়ে বেড়ানোর গল্প; এই টাস্কি খাওয়া অবদমনে ক্লান্ত আমাদের প্রতিদিনকার ব্যক্তিগত জীবনের লুকানো কাদাময় বা পচা অথচ সত্য গল্পের চিত্রয়াণ দেখে। আমরা তো এ সত্যকে পাশ কাটাতে চাই আধুনিতকা ও স্মার্টনেসের দোহাইয়ে; কিন্তু, রোদ নিভে গেলে কিংবা নিজের ঘরের ভেতর রোদকে ঢেকে দিলে দরোজায়, যে জীবন আমাদের, যে চিরায়ত সাধারণ অথচ অপ্রকাশনীয় জীবন_ তার খোঁজ দিতে বা নিতে অভ্যস্থ নই আমরা। ব্লাকআউট আমাদের সেই অনভ্যস্থতাকে ধাক্কা দেওয়ার কাজটাই করেছে। সময়, সবুজ ডাইনি: ব্লাকআউটের গল্প সাধারণ, সাদামাটা। কোনো পোশাকী রঙ নেই, রোদ নেই। দুই তরুণের মেসজীবনই এর গল্প। আর গল্পের ফাঁক ফোঁকরে সাপের ফোঁস ফোঁস তেজ আর পিচ্ছিলতা নিয়ে মেসের দরজা ঠেলে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়ে গ্লানিকর অথচ সবুজ অতীত এবং কল্পনার বর্ণিল পাখা। একজন কবি। একজন পেইন্টার। একজন রোদের আলোয় স্নান করে, ভেসে যায়; তারপর ঠোঁকর খেয়ে সূর্যের, ফেরত আসে আহত ঘোড়ার তেজ নিয়ে। আরেকজনের ঘুমচোখ-মাতলামি জুড়ে অবদমনের পিষ্টতা। আসলে,ওরা দুইজন আমাদের জীবনের দুটি ফটোকপি। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না: অবদমনে কান্ত, বিপ্তি কবিকে বাইরের জগত টানে না আর। সারাদিন ঘরে শুয়ে থেকে থেকে নিজের মনটাকেও বন্দি করে ফেলতে চায় বুঝি বা সে! এই কবি, যে ছোটবেলায় লুকিয়ে বিড়ি খেতে গিয়ে মার হাতে ধরা পড়ে জনসমক্ষে নাকে খত দিয়েছিল, যে বাউলের শঙ্খধ্বনিতে দিনের শুরুটা দেখত অবাক হয়ে, টগবগে ঘোড়ার মতো দাবড়িয়ে বেড়াতো প্রিয় আজিজ মার্কেট আর কবিতার অলিগলি, অবদমনে ক্লান্ত-বিপ্তি সে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে ভাড়াঘর ও ছাদের গণ্ডিতে। তার আড়মোড়ায়, তার স্বপ্নে, তার মাস্টারবেশন ও মদ্যপানে একঘেয়ে জীবনের প্রতি ভয়াবহ বিতৃষ্ণা। রুমমেটের বান্ধবীকে দেখে তার অবদমিত যৌনবৌধ জেগে ওঠে তুমুলভাবে। ফলে, বাথরুমে ঢুকে 'কৃত্রিম ঝর্ণা' ছেড়ে স্নানকরার আগে নির্মাতা এই কবির সঙ্গে নোংরা ডোবায় ডুব দিয়ে নাকে কাদা নিয়ে ভেসে ওঠার যে মুর্হর্তকালীন দৃশ্য জুড়ে দিয়েছেন, তা তুমুল সেক্স প্রত্যাশা করে আবারো অবদমনের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। কল্পনার সবুজ জগতে ফুলে ঢাকা প্রেমিকার ঠোঁকে ডুবিয়ে দিয়ে সে খুঁজে বেড়ায় শরীরের সাড়া। আই ওয়ান্ট টু বি এ মডেল: আমাদের প্রজন্মের ভেতর, প্রতিষ্ঠিত হবার পথে, মগজকে পাশ কাটিয়ে, চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে শরীরকে দাঁড় করিয়ে দেবার যে জনপ্রিয় প্রবণতা_ তারই প্রতিনিধিত্ব করে কিশোরী মিটি। তরুণ আর্টিস্টের সাথে তার সময় কাটানো, তার ঢঙ করা, তার এক্সপ্রেশন_ সবটাতেই হাই এম্বিসাস লুকিয়ে আছে। প্রেমিক আর্টিস্টের কল্পনায় সে বার বার আসে, এলোমেলো হয়ে আসে, অগোছালো হয়ে আসে, ছিড়ে-খুঁড়ে আসে। কিন্তু প্রকৃতার্থে পেইন্টিংয়ের মডেল হতে সে আগ্রহী নয়, তার আগ্রহ বাণিজ্যিক প্রসাধনে। 'আই ওয়ান্ট টু বি এ মডেল'_ 2006-এ একটি প্রজন্মের একদল মেয়ের ঘুম ও জাগরণের, হাঁটা ও শুয়ে পড়ার স্বপ্নীল বিষয়। আহমদ ছফা: দ্য প্রফেট ছবিতে আর্টিস্ট ধ্রুব এষ স্বপ্ন দেখেন এবং দর্শককে দেখান আহমদ ছফা'র 'পুষ্প বৃ ও বিহঙ্গপুরান' নিয়ে সিনেমা বানানোর। কিন্তু, আর সব নিয়ে ভাবনা না থাকলেও ধ্রুব এষ সমস্যায় পড়েন আহমদ ছফা'র চরিত্রটি কাকে দিয়ে করাবেন_ এই ভেবে। কে হবে ছফা ভাই_ এ রকম জিজ্ঞাসা তিনি ছুড়ে দিলে ব্লালাকআউটের সাব টাইটেলে 'আহমদ ছফা' শব্দের বদলে 'দ্য প্রফেট' ভেসে ওঠে। যেহেতু ব্লালাকআউট সারাবিশ্বের সিনেমা, ফলে 'আহমদ ছফা' নামটাকে বাংলাভাষার বাইরের দর্শকেরা না চেনারই কথা, আর না চিনলে কেন তার চরিত্রটি নিয়ে নির্মাতা হতেচ্ছুক আর্টিস্ট দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন_ তা ভেবে উঠতে বেগ পেতে হতে পারে; তাই সাব টাইটেলে 'প্রফেট' শব্দটি দিয়ে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে চরিত্রটির গুরুত্বপ্রকাশে অদ্ভুত কৌশল নিয়েছেন নির্মাতা। দিস ইজ ঢাকা, বাংলাদেশ; আরেকটু হলেই ভুলে গিয়েছিলাম ওদের ঘরের দেয়ালে সেঁটে রাখা মৃতফড়িঙগুলোর মতোই ওদের অতিমানবিক যৌনবোধ রঙিন, অথচ উড়ার আকাশ নেই বলে চার দেয়ালে গুমোটবন্দি। তবু সব পাশ কাটিয়ে শরীর যখন কথা কয়ে ওঠে, তখন উত্তর প্রত্যাশা থাকে আরেক শরীরের। ফলে, মাধ্যে মধ্যে, একই রকমের শরীর হলেও দুটো শরীর ঠিকই আহত ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠতে চায়। লাফিয়ে ওঠেও। কিন্তু রাশ টেনে ধরে তাদের ভেতরে বাস করা রোজকার সমাজের অভ্যস্থ ছাপ। রাশ টেনে ধরেন টোকন ঠাকুর। দুই বন্ধু ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের কিছু মনে থাকে না, মনে নেই। মনে না থাকলেও, তাদের শেষ আড়মোড়া, তাদের পরস্পরের শারীরিক স্পর্শকাতরতা যে ইঙ্গিত দেয়, সিনেমা শেষে এনিমেটেড ঘোড়া তাকে বয়ে নিয়ে ঢুকে পড়ে আস্তাবলে। কী আছে তাতে? অবদমনের বিপরীত কোনো শব্দ? বোধ করি, ইঙ্গিত, ইঙ্গিত আর ইঙ্গিতে ঠাসা ব্লাকআউট প্রকৃতার্থেই একটি পূর্ণাঙ্গ আধুনিক ছবি। কিন্তু, সমস্যা হলো, এইসব ইঙ্গিত বুঝতে হলে দর্শকের জানাশোনার গণ্ডিটা সাধারণ সিনেমা দেখার গণ্ডির বাইরে নিতে হবে, শিল্প-সাহিত্য ও বিশ্ব সিনেমার খোঁজখবরটা তার কাছে থাকলে ভালো হয়। তা না হলে, ছবিতে হুট করেই বয়স্ক এক লোকের ফটোগ্রাফে ফুলের মালার চিত্র দেখে কী বুঝবেন পাঠক, যদি কবি বিনয় মজুমদারকে তার চেনা না থাকে? যিনি জানেন বিনয়কে, তার তো এরূপ ইঙ্গিত বুঝতে সমস্যা হবার কথা নয়। এমনি করে ইভা ব্রাউনের স্তন, ভ্যানগগের শস্যেেত উড়ে যাওয়া একদল কাক, পিয়েতা... ইত্যাদি হাজারো ইঙ্গিত কবিতার অর্থবহ রহস্যময়তা নিয়ে ছড়িয়ে আছে সিনেমাটায়; এই ইঙ্গিতসমগ্রই ব্লাকআউটের শস্য। করিগর: চিত্রনাট্য ও পরিচালনা : টোকন ঠাকুর অভিনয় : রাহুল আনন্দ, তানভীর হাসান, তিনা, সারা, ধ্রুব এষ, কফিল আহমেদ, বাপ্পি আশরাফ, আবদুল হালিম চঞ্চল, মোমিন আলী মৃধা দাদু, বিমল বাউল, বর্ষা বিভাবরী প্রমুখ। [রুদ্রআরিফ । খিলক্ষেত, ঢাকা। ডিসেম্বর 2006]
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৬ রাত ১:৪৭
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এমন রাজনীতি কে কবে দেখেছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২০


জেনজিরা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামল দেখেছে। মোটামুটি বীতশ্রদ্ধ তারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। এক দল আর কত? টানা ১৬ বছর এক জিনিস দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো জিনিসও একসময় বিরক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রবাসীর মৃত্যু ও গ্রাম্য মানুষের বুদ্ধি!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০



একজন গ্রামের মানুষের মাথায় ১০০ জন সায়েন্টিস্ট, ৫০ জন ফিলোসফার, ১০ জন রাজনীতিবিদ এবং ৫ জন ব্লগারের সমপরিমাণ জ্ঞানবুদ্ধি থাকে, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন এসব লোকজন বাংলাদেশের এক একটি সম্পদ।

বিস্তারিত:... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন নারী শিক্ষিকা কীভাবে কন্যা শিশুর সবচেয়ে অসহায় মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করতে পারেন?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৩


বাংলাদেশে মাঝে মাঝে এমন সব মানুষ রূপী শয়তানের সন্ধান মেলে যাদের দেখে আসল শয়তানেরও নিজের উপর হতাশ হওয়ার কথা। এমন সব প্রজাতির মানুষ বাংলাদেশে বসবাস করেন যাদের মস্তিষ্ক খুলে দেখার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মানুষ মানুষকে কীভাবে এত অপদস্ত করে এই ব্লগে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৪

আমি তো কারও সাতেও নাই পাঁচেও নাই। এত সময়ও নাই মানুষকে ঘাঁটার। ব্লগের ব্লগারদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানি না। তবে পোস্ট পড়ে কিছুটা আন্দাজ করা যায় -কে কী রকম। আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×