একটি কালো গোলাপ
১
ছাদের রেলিং ধরে উদাস উদাস তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে খেয়াল হলো তার অদূরেই এক তরুণীও রেলিং ধরে উদাস উদাস তাকিয়ে আছে। সে প্রথমে বিব্রত বোধ করলেও পরে উৎসুক হয়ে উঠলো। হালকা বাতাসে তরুণীর কালো ওড়না উড়োউড়ি করে। তার ভালো লাগে। তরুণীর গড়ন ও রূপ তাকে মোহিত করে কিন্তু তরুণীটা বয়সে তার থেকে বড় হবে ভেবে কিছুটা বিচলিত বোধ করে।
২
বিষয়টা এরকম দাঁড়ায় যে, মানুষ তার ভালো লাগার জিনিস বার বার পেতে চায় কিংবা ঐ জিনিসটাকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখতে চায়। তারও এমন হয় যে, তার প্রতিদিন বিকালে ছাদে যেতে ভালো লাগে এবং সে দুপুর থেকেই ছাদে বসে থাকে বিকালের প্রতীক্ষায়। আর প্রতিটি বিকালেই তার ছাদের রেলিং, বিকালের রোদ, রঙিন আকাশ আর তরুণীর ওড়নার উড়াউড়ি দেখতে ভালো লাগে। তরুণীর অবয়ব, ফর্সা দুটি খালি পা, বেনী করা দীঘল চুল আর তরুণীর চুপচাপ দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখা দেখতে সে পুলক বোধ করে। সন্ধ্যাবধি যতক্ষণ না তরুণী ছাদ ছেড়ে না যায় ততক্ষণ এবং চলে যাওয়ার পর তরুণীর দাঁড়িয়ে থাকা স্থানটার বাতাস স্পর্শ না করা পর্যন্ত সেও ঘরে ফেরে না।
তার ও তরুণীর চোখ তখনও পরস্পর সরাসরি দৃষ্টি বিনিময় করেনি। তরুণীর ও তার কণ্ঠজাত শব্দে যোগাযোগ রক্ষিত হয়নি কিন্তু এই নয় তার অবস্থান সম্পর্কে তরুণী অজ্ঞাত।
৩
সে জেনে যায় ৬ তলার বাম পাশের ফ্ল্যাটেই তরুণীর বসবাস। তরুণী ছাড়াও সে ফ্ল্যাটে তিনজন রয়েছেন। সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ, পঁয়ত্রিশ বছরের এর মতো বয়সের এক যুবক পুরুষ আর তের চৌদ্দ বছরের এক বালক। সে সকালে যুবক পুরুষটিকে, তারপর বালকটিকে এবং দুপুরের দিকে বৃদ্ধটিকে বাইরে যেতে দেখেছে। পুরুষ যুবকটি চাকরিজীবীদের মতো শার্টপ্যান্ট ও জুতো, বালকটিকে স্কুল ইউনিফর্ম আর বৃদ্ধটিকে শাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পড়ে বাইরে বেরুতে দেখে।
৪
বিগত ষষ্ঠ দিবস যাবৎ তরুণীর ছাদে আগমন এবং রেলিং ধরিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য অবলোকন করিবার পর তাহার মনে উদয় হয় এক্ষণ আর চুপচাপ দর্শন নহে এইবার কথা বলিতে হইবে। আর একটি কথা অব্যক্ত থাকিয়া যায় ষষ্ঠ দিবস ধরিয়া তরুণী কালো পোশাক পরিধান করিয়াই ছাদ ভ্রমণ করিতে আসে।
৫
সপ্তম দিবসেও তরুণী যথারীতি কালো পোশাক পরিধান করে নাঙা পায়ে হেঁটে এসে ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। এবং চুপচাপ আকাশ দেখে, পাখিদের উড়ে যেতে দেখে, পাশের বাড়ির ছাদ দেখে, ইত্যাদি ইত্যাদি দেখে কিন্তু তাকে দেখে না। সে নিঃশব্দে এসে তরুণীর পাশে দাঁড়ায়। বাতাসে তরুণীর ওড়নার উড়াউড়ি থামে না। ওড়নার একপ্রান্ত তাকে স্পর্শ করে। সে মন্ময় হয়ে বাতাসের ঘ্রাণ শুষে নেয় দীর্ঘশ্বাসে। তখনো তরুণীর কোন প্রতিক্রিয়া না ঘটলে সে তার কন্ঠ থেকে 'শুনুন' শব্দটি বাতাসে নিসৃত করে। তরুণী চকিত ঘুরে তাকায়। আর প্রথমবারের মতো সে তরুণীর পূর্ণ মুখশ্রী দর্শন করে। তরুণীর গভীর দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে সে আর কোন কথা খুঁজে পায় না কেননা তার পৃথিবী থমকে যায়। তার আর কিছুই স্মরণ হয় না।
৬
অষ্টম দিবসে সে সকাল থেকেই অস্থির হয়ে ছাদে বসে থাকে তরুণীর প্রতীক্ষায়। সকাল গলে দুপুর, দুপুর পোড়ে বিকাল এবং প্রতিটি মুহূর্ত তার বাম পাঁজরে ধরাস ধরাস করে আঘাত হানে। এবং ক্রমেই বিকাল সন্ধ্যেয় রূপান্তরিত হয়। কিন্তু কালো পোশাক পরিধানকারীনি সেই তরুণীটি আজ আর ছাদে আসে না। তার ভেতর ভেতর দারুন অস্থির লাগে। তার অসহ্য লাগে বেঁচে থাকতে। সে চুপচাপ ছাদে এলিয়ে থাকে সারা সন্ধ্যা অথচ ভেতরে তোলপাড় করে অজানা অচেনা অদ্ভুত ব্যথা।
৭
নবম ও দশম দিবসও তরুণী না এলে। একাদশ দিবসে সকালে সে ভবনটির নীচতলায় প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। পুরুষ যুবকটিকে ফটকের কাছে আসতে দেখে সে এগিয়ে যায়। 'ভাই শুনেন!' সৌম্য পুরুষটি স্মিত হেসে ভরাট কণ্ঠে বলে-'জ্বি!' এবার সে জিজ্ঞেস করে ' আপনি কী ছ'তলার বাম পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন? নতুন আসছেন?' যুবক পুরুষটি উত্তর করে ' জ্বি।' এবং পুরুষটির মুখ হাস্যোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে যুবকটির কাছে জানতে চায়, 'আপনার নাম কী?' যুবকটি হেসে হেসে উত্তর করে 'মৌমন'। তারপর আর কোন কথা না বলে তাকে পাশ কাটিয়ে যুবকটি তার গন্তব্যের দিকে চলে যায়। আর সে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়েই থাকে।
আরো কিছু সময় পর বালকটিকে আসতে দেখে সে আদরে তাকে ডেকে নেয়, 'স্কুলে যাচ্ছো?' বালকটি হেসে স্কুলব্যাগের ফিতাদুটি টেনে জবাব দেয় 'জ্বি'। সে আবার জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কি? বালকটি পুনরায় হাসি মুখে জবাব দেয়, 'মৌমন'। সে আশ্চর্য হয়ে পুনরায় বালকের নাম জিজ্ঞেস করে। কিন্তু বালকটি এবারো জবাব দেয় 'মৌমন'। তারপর স্তম্ভিত তাকে পাশে কেটে চলে যায়।
আরো পর। দুপুরে বৃদ্ধটিকে আসতে দেখে সে মার্জিত ভঙিতে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু বৃদ্ধটি তাকে দেখে হাসতে হাসতে ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলে 'আমার নাম মৌমন।' তখন সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বৃদ্ধের চলে যাওয়া দেখে।
৮
একাদশ দিবসের বিকালে তরুণীটি ছাদে আসে। তখন সে বিধ্বস্ত, ম্লান। তরুণী তার সামনে দাঁড়ায়। সে নত মুখ উঁচু করে। তরুণীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ভাষাহীন। তরুণী ঠোঁট বাঁকায়। তারপর ঠোঁট দুটি তার চোখের কাছে নামিয়ে নিয়ে আসে ফিস ফিস করে বলে, আমাকে একটি কালো গোলাপ এনে দিলে প্রতিদিন বিকালে আমি এসে এখানে দাঁড়াবো। কথা বলবো। তোমার সাথে প্রেম করবো। তারপর মুখ সরিয়ে নিয়ে তরুণী মিষ্টি করে হাসে। সে মন্ময় হয়ে তরুণীর হাসি দেখে। ম্লান ভাঙ্গা কণ্ঠে কেবল একবার বিস্মিত স্বরে বলে, ‘একটি কালো গোলাপ!’
৯
তার শহরের প্রতিটি ফুলের দোকান, প্রতিটি বাগান খুঁজেও সে কোথাও কালো গোলাপ পায় না।
সে বিমর্ষ হয়। তার কষ্ট হয়। তার বুক ভেঙ্গে যেতে থাকে। তারপর সে জেলা শহরে যায়, বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে ঘোরে। কিন্তু কোথাও সে কালো গোলাপ পায় না। শহরের প্রতিটি মানুষের কাছে সে কালো গোলাপের কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কেউ তাকে কালোগোলাপের সন্ধান দিতে পারে না।
১০
অনেক দিন পর একদিন সে ঘুম থেকে জেগে ওঠে জানলার পাশে টবে লাগানো গোলাপ গাছটায় কালো গোলাপ ফুটতে দেখে তার মন ভালো হয়ে যায়। গোলাপ ফুলটিকে যত্ন করে বেড়ে উঠতে দেয়। তারপর এক বিকেলে কালো গোলাপটি ডাল থেকে ছিঁড়ে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে ছাদে দাঁড়ায়। সে তরুণীর প্রতিক্ষা করে। প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি তারপর ভারি বর্ষণ শুরু হলেও সে বৃষ্টিতে কালোগোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং একসময় লক্ষ্য করে বৃষ্টির জলে গোলাপের কালো রং ধুয়ে যাচ্ছে। কালো গোলাপের পাপড়ি থেকে কালো রং ধুয়ে গিয়ে ক্রমশ শাদা হয়ে যাচ্ছে। সে প্রাণপণ কালোগোলাপটিকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে চেষ্টা করে। ঠিক এই সময়েই সেই তরুণী বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। সে তার হাতের মুঠো খুলে কালো অথচ ধুয়ে ক্রমশ শাদা হওয়া গোলাপটিকে তরুণীর দিকে উদগ্রীব হয়ে মেলে দেয়। এবং সে লক্ষ্য করে কেবল গোলাপটিই নয় তরুণীর পোশাকটিও ক্রমশ কালো রং ধুয়ে ধুয়ে শাদা হয়ে যাচ্ছে। তরুণীটি তার হাতের গোলাপটির দিকে একবারও না তাকিয়ে তার চোখে চোখ রেখে খুব গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম কী?’
তার সবকিছু বিস্মরণ হয়। সে তার নাম মনে করতে পারে না।
বৃষ্টিময় ছাদে একটি শাদা গোলাপ হাতে সে তার নিজের নাম খুঁজতে থাকে। সেখানে আর কেউ নেই।