বর্তমান যুগ মিডিয়ার যুগ। তথ্য প্রযুক্তির যুগ। একটি দেশের স্বাধীনতা-সাবর্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করে সেই দেশের মিডিয়া বা গণমাধ্যম। বর্তমানে মিডিয়া স¤প্রসারিত হচ্ছে। তাই তরুণ সমাজ তাদের পছন্দের পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার প্রতি ঝুঁকছে। আর এ সাংবাদিকতা চর্চার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অনেকেই দেশ-বিদেশের খ্যাত সাংবাদিক। যারা গণমাধ্যমগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্বগৌরবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মুক্ত গণমাধ্যাম র্চচায় বাধাগ্রস্থ হয় তাহলে সংবাদকর্মীরা কিভাবে দেশের কল্যাণে কাজ করবে?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও বার্তা সংস্থার প্রতিনিধি রয়েছে। এরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পড়াশুনার পাশাপাশি তারা জাতির কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা চিত্র তুলে ধরে। কিন্তু এ চিত্র যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নানা অনিয়ম-দূর্নীতির চিত্র হয় তখন ঘটে আপত্তি। তাদের অনিয়ম-দূর্নীতি ঢাকতে চলে সাংবাাদিক নিয়ন্ত্রন প্রচেষ্টা। কিন্তু ক্যাম্পাসগুলোতে অর্থ দিয়ে সাংবাদিকদের খুব কমই কেনা যায় এ ধারণা প্রশাসনের খুব ভালো করেই জানা। ফলে প্রশাসন ভিন্ন কৌশল হিসেবে বৃটিশদের দেয়া ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ ( ভাগ কর শাসন কর) নীতি অনুসরণ করে। বৃটিশদের সেই ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি কিভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োগ করছে প্রশাসন জানা যাক সে সম্পর্কে কিছু অব্যক্ত কথা।
২০০৮ সাল। ক্ষমতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চলে আগের নিয়োগকৃত ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য দিয়ে। ক্যাম্পাসের সব সাংবাদিকরা এক প্লাটফর্মে। প্লাটফর্মের নাম ২৬ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব। অবশ্য তার কিছু আগে কিছু সাংবাদিক প্রেসক্লাবের বাহিরে আমতলা-জামতলায় কাটিয়ে অবশেষে বোধদয় হলে প্রেসক্লাবে ফিরে নির্বাচনকে সামনে রেখে এবং তৎকালীন প্রশাসনের সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টার কারণে। এক্ষেত্রে অবশ্য অবদান রেখেছে তৎকালীন উপাচার্য ও ছাত্র উপদেষ্টা। অনেক প্রচেষ্টার পর স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে সরাসরি গোপন ভোটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কয়েকটি পদ পেলেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে পরাজয় হয় আমতলার (রাবিসাস) সাংবাদিকদের। ২০০৯ সাল। ক্ষমতার পরিবর্তন। সেই সাথে প্রশাসনেও পরিবর্তন। নতুন দায়িত্বে আসে সরকার সমর্থিত উপাচার্য প্রফেসর এম আব্দুস সোবহান। তিনি প্রশ্রয় দিতে থাকেন কিছু পছন্দের সাংবাদিকদের। প্রশ্রয় পেয়ে খোড়া অজুহাতে প্রেসক্লাব থেকে বের হয়ে আসে ভিসি’র সমর্থিত কিছু সাংবাদিক। সাংবাদিকদের মাঝে আবারও ধরে ফাটল। এক বছরের জন্য নির্বাচিত কমিটিকে বাতিল করে অগণতান্ত্রিকভাবে প্রশাসন নতুন করে আবারও নির্বাচনের তাগিদ দেয়। কেন এই অগণতান্ত্রিক মনোভাব? উদ্দেশ্য, হয় নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের অনুগামী সাংবাদিকদের সভাপতিসহ গুরুত্বপুর্ণ পদ দখল নইলে বৃটিশদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি অনুসরণে প্রেসক্লাব বন্ধ করে আলাদাভাবে নতুন সংগঠন দ্বার করানো।
সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার প্রথম ধাপে সাংবাদিক নামধারী কিছু দলীয় সাঙ্গ-পাঙ্গদের প্রেসক্লাবের নতুন সদস্য করে নির্বাচনে কাজে লাগানোর জন্য ২০০৯ সালের ১১ এপ্রিল সাংবাদিকদের ব্যাপারে একটি নীতিমালা তৈরী করে সেটি প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায় প্রক্টর প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়া। যদিও প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ি সাংবাদিকদের কোন কাজে প্রক্টর অথবা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ অবৈধ। প্রক্টর স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে যার স্বারক নং-২৮৯৯/প্রক-তে উল্লেখ করা হয়, প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য সাংবাদিকদেরকে প্রক্টর অফিস বরাবর স্বহস্তে আবেদন করতে হবে। যা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে (১৯৮৬ সালে) প্রণীত সংবিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং মত প্রকাশে স্বাধীন সাংবাদিকদের কার্যপ্রণালীর রীতিমত সাংঘর্ষিকও বটে। সংবিধান অনুযায়ী প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য সভাপতি বরাবর আবেদনপত্র জমা এবং শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্ররাই সদস্য পদ লাভের যোগ্যতা রাখে। অথচ প্রক্টর প্রেরিত ঐ চিঠিতে এ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে প্রক্টর ও প্রক্টরয়িাল বডিই ক্লাবের সব ধরণের কর্মকান্ড পরিচালনা করবেন এমনটিই বলা হয় পরবর্তীতে সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাতকালে।
চিঠি প্রাপ্তির দুইদিন পর ১৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা চিঠিতে উল্লেখিত বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রক্টর অফিসে যায় এবং প্রক্টর অফিস বরাবর আবেদন করে সদস্যপদ নিতে অস্বীকৃতি জানালে প্রক্টর জোর গলায় দাবি করেন, ‘সবকাজ আইনের মধ্যেই হচ্ছে’। এরপরই প্রক্টর উপস্থিত সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে বলেন “বিং এ প্রক্টর অব রাজশাহী ইউনিভার্সিটি, অলসো আই ওয়াজ এ ম্যাজিষ্ট্রেট, সুতরাং আইন দিয়ে কি করতে হয় তা আমার ভালো করেই জানা আছে।” একই সঙ্গে তাদের সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হবে অন্যথায় সাংবাদিকদের ছাত্রত্ব বাতিল করে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার হুমকি দেন তিনি। এরপর যা ঘটার তাই ঘটে। প্রেসক্লাবের সাংবাদিকদের ভাগ্যে জুটে নতুন উপাধী বিএনপি-জামায়াত-শিবির। আর ভিসি’র পছন্দের সাংবাদিকরা হয়ে যায় প্রগতিশীল। ২৪ এপ্রিল। শুক্রবার। খুব সকালেই প্রশাসনের রাজনৈতিক মুখপাত্র প্রক্টর তার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে প্রেসক্লাব সিলগালা করে দেয়।
প্রেসক্লাবের মত স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে প্রক্টরের অবৈধ হস্তক্ষেপের বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টে প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ একটি রিট পিটিশন দায়ের করলে শুনানি শেষে আদালত প্রক্টরের ওই অবৈধ হস্তক্ষেপকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে মর্মে রাবি প্রশাসনের প্রতি রুল জারি করে চিঠি প্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোরও নোটিশ দেয়। এরপর দীর্ঘ ৩ বছর পার হলেও আজ অবধি বন্ধ রয়েছে প্রেসক্লাব। সুস্থ ও মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চায় বাধা হয়ে আছে প্রশাসন।
আবার একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। প্রেসক্লাব সিলগালা করে দেয়ার কিছু দিন পর ভিসি’র সমর্থিত নির্বাচনে পরাজিত সাংবাদিকদের আলাদাভাবে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের মতো একটি নিরিবিলি জায়গায় অফিস বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রেসক্লাবের টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ওই টেলিফোন নম্বরসহ সেখানে সংযোগ দেয়া হয়। মজার বিষয় হলো, ভিসি’র সমর্থিত সাংবাদিকের মধ্যেও আবার পদ-পদবী নিয়ে শুরু হয় কামড়া-কামড়ি আর লবিং-গ্রুপিং। নির্বাচন কেন্দ্রীক জটিলতায় ভিসিপন্থীরা গঠণতন্ত্র জালিয়াতি করার পর হাতে-নাতে ধরা পরে কোণঠাসা হয়ে পড়লে ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারী সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়েও তালা ঝুলানো। এবারও তালা ঝুলানোর চরিত্রে একই ব্যক্তি প্রক্টর চৌধুরী মো. জাকারিয়া।
এভাবেই ক্যাম্পাসে প্রতিটি পদে পদে বাধাগ্রস্থ হতে থাকে সাংবাদিকরা। তাছাড়া বর্তমান ভিসি’র আমলে গত প্রায় সাড়ে ৩ বছরে অন্ততপক্ষে অর্ধশতাধিক সাংবাদিক প্রক্টর, শিক্ষক, ছাত্রলীগ ও সন্ত্রাসীদের হাতে মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হলেও একটি ঘটনারও কোন সুষ্ঠু বিচার পায়নি সাংবাদিক। সাংবাদিকতার কারণে ভিসি বিরোধী হওয়ায় ছাত্রত্বও হারাতে হয়েছে এক সাংবাদিককে। তিনি সাংবাদিকদেরকে এতটাই ভয় পান যে, তার পছন্দের দু’একজন ছাড়া কোন সাংবাদিকের সাথেত কথা বলেন না এবং সংবাদের প্রয়োজনে ফোন দিলে রিসিভ করেন না। গত সাড়ে ৩ বছরে তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন (সংবাদ সম্মেলনে) মাত্র ৩ থেকে ৪ বার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার এই চিত্র দেখে যে কেউ বলবেন ক্যাম্পাসে মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চায় প্রধান বাধা এখানকার প্রশাসন। #

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



