২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ। দিনটি ছিল শুক্রবার। আমার মোবাইলে একটি নম্বর তুলিতেছি। নম্বরখানি দিয়াছেন ‘বেস্ট লাইফ ইনসিওরেন্স’ এর জিয়া স্যার। বিমা কোম্পানিতে আমি যখন কাজ করিব না, আমার প্রতি তাহার অশেষ মায়া হয়। কয়েকটি টিউশনির ব্যবস্থা করিয়া দিতে চাহিয়াছিলেন তিনি। কোনো কারণে সম্ভব হয় নাই। তাই একখানি নম্বর দিয়াছেন, এইখানে লোক লাগিবে। আশা করা যায় আমার কোনো গতি হইবে। ইহার পূর্বে আমাকে তিনি অন্য একটি এনজিওতে পাঠাইয়াছিলেন। দুর্ভাগ্য আমার, সেইখানে কর্ম খালি নাই।
নম্বরখানি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব ছামাদ মাস্টারের। স্কুলটির নাম ‘গাজীপুর শাইনিং পাথ হাইস্কুল’। সঙ্কোচের সহিত তাহাকে ফোন দিলাম। ফোন রিসিভ করিতেই লম্বা একখানি সালাম দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার স্কুলে ইংলিশের শিক্ষক লাগিবে কি না? উনি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেন এবং তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে বলিলেন। কোথায় এবং কীভাবে যাইতে হইবে; সেই ঠিকানাও বলিয়া দিলেন।
একা যাইতে সঙ্কোচ লাগিতেছিল। মেসের রুমমেট ছোটো ভাই শাহ্ আলমকে লইয়া রওয়ানা দিলাম। আমার বাসস্থান অবসরকূল ছাত্রাবাস হইতে বাহির হইয়া ভাওয়াল কলেজের ছাত্র হোস্টেলের উত্তর পাশ দিয়া কিছুদূর যাইতেই ডানদিকে একটি রাস্তা বাঁকিয়া গিয়াছে। সেই রাস্তা ধরিয়া মিনিট দশেক হাঁটিলেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক। মহাসড়ক দিয়া পনেরো-বিশ মিনিট উত্তরে গেলেই বিটিআরসি; এর সম্মুখ দিয়া তিন মিনিট হাঁটিলেই টেকনগপাড়া বাজার। বাজারের নিকটেই স্কুলটি। স্কুলে যাওয়ার আরও একটি সংক্ষিপ্ত রাস্তা আছে অবশ্য। তেলিপাড়ার সম্মুখে দশতলা; এর পাশ দিয়া আট-দশ মিনিট হাঁটিলেই স্কুলে পোঁছা যায়। এই রাস্তাটি আবিষ্কার করিতে কয়েকমাস লাগিয়া গিয়াছিল। তদ্দিন বিটিআরসির সম্মুখ দিয়াই হাঁটিয়া যাইতাম।
যেহেতু দিনটি ছিল শুক্রবার। স্কুল বন্ধ। কোচিং চলিতেছিল শুধু। ছামাদ মাস্টার বাহিরে চেয়ার-টেবিল পাতিয়া বসিয়া ছিলেন। শিক্ষকগণ কোচিং করাইতেছিলেন।
আমি আর শাহ্ আলম তাহাকে সালাম দিলাম। তিনি সালাম লইলেন, অতঃপর টুকটাক প্রশ্ন করিলেন। আমার হাতের লেখা পরখ করিলেন। হাতের লেখার লেজেগোবরে অবস্থা দেখিয়া কিছুক্ষণ ওয়াজ-নসিহত করিলেন। অনতিকাল পর বেতনাদি লইয়া কথা বলিলেন। যৎসামান্য বেতন! আমি চাকরি করিব না বলিয়া মনস্থির করিলাম। বিরক্ত হইয়া উঠিতে উদ্যত হইতেই শাহ্ আলম আমাকে থামাইয়া দিল। কারণ, সে জানিত আমি কত অভাবে আছি!
আমরা কথা বলিতে বলিতে আরও এক প্রার্থী হাজির। মাহমুদুল নাম। তাহাকেও পরীক্ষা করা হইল। তাহার হাতের লেখা অবশ্য ভালো ছিল, আমার মতো এত কথা তাহাকে শুনিতে হয় নাই। যাহা হউক, মাহমুদুল এবং আমি- দুই জনকেই বাছাই করা হইল। পরবর্তী দিন হইতেই যোগদান করিতে হইবে।
পরবর্তী দিন সকাল আটটায় স্কুলে পৌঁছিলাম। সালমা নামের জনৈকা ম্যাডাম সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত আমাকে পঞ্চম শ্রেণিতে ক্লাশ করাইতে পাঠাইয়া দিলেন। ততক্ষণে প্রধান শিক্ষক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। শিক্ষার্থীদিগকে কী করিয়া পড়া মুখস্ত করাইতে হইবে; সেই সবক দিলেন। তিন-চার বছর পড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে; হঠাৎ এমন অনভিপ্রেত ঘটনা আমায় বিস্মিত করিল। পরবর্তীতে কী ঘটে, তাহা দেখিবার প্রতীক্ষায় রহিলাম।
প্রাথমিকভাবে আমাকে ৩য়, ৪র্থ, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির ক্লাস দেওয়া হইল। ক্লাস করাইতে লাগিলাম। প্রধান শিক্ষক হঠাৎ হঠাৎ ক্লাসে ঢুকে বয়ান দেন, আমার ভালো লাগে না। বিশেষ করিয়া মুখস্তবিদ্যা- এসব কোনো কালেই আমার ধাঁতে ছিল না।
ইহার মধ্যে প্রধান শিক্ষক আমাকে অফিসকক্ষে ডাকিয়া পাঠাইলেন, ভর্ৎসনা করিলেন। আমি যে তাহার নিয়মকানুন পছন্দ করিতেছি না, তিনি কী করিয়া যেন বুঝিতে পারিলেন। আমাকে লোভী, ঠান্ডা মাথার বেয়াদব বলাসহ এমন সব কথা কহিলেন, আমি কোনোকালেই শুনি নাই। পরবর্তীতে জানিয়াছিলাম শিক্ষকদের ধরিয়া রাখিবার জন্য নানান সময় তিনি নানান রুপ ধরেন।
চাকরিটি আমার জরুরি ছিল। কারণ, আমার পঁচিশ হাজার টাকা ঋণ হইয়া গিয়াছিল। থাকা-খাওয়ার টাকা-পয়সা ছিল না। যে করিয়াই হোক আমাকে টিকিয়া থাকিতেই হইবে, মাথা গরম করিলে চলিবে না।
স্কুলের বেতন অল্প; বলিলাম, কোচিংয়ের ব্যবস্থা করিয়া দিন। অষ্টম শ্রেণির সকালের কোচিং দেওয়া হইল, একসময় বিকেলের কোচিংও দেওয়া হইল। আপাতত নিশ্চিন্ত হইলাম ঋণ শোধ করিতে পারিব, থাকা-খাওয়ার আর কষ্ট থাকিবে না।
পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটিয়া স্কুলে আসিতে হয়। দুপুরে খাওয়া বা বিশ্রামের সুযোগ নাই। প্রধান শিক্ষক পিয়ন রাজ্জাক মামার সঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা করিতে বলিলেন। তাহা আর করিতে হয় নাই। ছোটন নামের জনৈক স্যার, যিনি অষ্টম-নবম-দশম শ্রেণিতে ইংরেজি পড়ান; তিনি আগাইয়া আসিলেন। তাহার ঐখানে আপাতত দুপুরের খাওয়া ও বিশ্রাম চলিল। ছোটন স্যার আমার জেলা ময়মনসিংহেরই লোক, তাহার বাড়ি মুক্তাগাছায়। আমাকে তিনি অশেষভাবে ঋণী করিয়াছেন, দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াইয়াছেন।
প্রধান শিক্ষক সকলের সঙ্গেই রূঢ় ব্যবহার করেন। সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেই বোধহয় আনন্দ পান। আমার ওপরও অত্যাচারের খড়গ নামিয়া আসিল। আমি নবম-দশমে পড়াইতে পারিব কী না, আমি গ্রামার জানি কী না; বহুবার বলা হইয়াছে। আমি বিবিএ-এমবিএ করা- সুতরাং ইংলিশে সমস্যা হওয়া কথা না। আমি একাধিক স্কুলে পড়াইয়াছিও। তারপরও আমার কী অপরাধ বুঝিতে পারিলাম না? নিজের মতো পড়ানো কি অপরাধ? মুখস্ত বিদ্যার বিরোধিতা করা কি অপরাধ? পড়ালেখা সম্পন্ন হওয়া কি অপরাধ?বুঝিতে পারিলাম না কিছু! অভিজ্ঞতা-শিক্ষা-দীক্ষার কি এক-পয়সারও দাম নাই তাহার নিকট? ছোটন স্যারও একদিন জিজ্ঞাসা করিলেন, নবম-দশমে পড়াইতে পারিব কী না!
হঠাৎই ময়মনসিংহে একটা প্রকল্পে ছোটন স্যারের চাকরি হইল। সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস করাইতে পারিবেন না; এইবার বুঝিতে পারিলাম আমাকে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানে কী! কপাল খুলিয়া গেল বোধহয়। আমি নবম-দশমে ক্লাস করানো শুরু করিলাম। স্কুলে আমার প্রভাব বাড়িয়া গেল, যদ্যাপি আমি সবসময় সাধারণই থাকিতে চাহিয়াছি।
অষ্টম শ্রেণির ছেলেরা ভালো প্রশ্ন করে, আমি উত্তর দিই। উত্তর মনঃপূত না হলে রিঅ্যাক্ট করে। কী অদ্ভুত! আমি বোধহয় সব চাইতে বেশি ভালোবাসিয়াছিলাম সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদিগকে; ইহার প্রতিদান তাহারা আমাকে কাঁদাইয়া দিয়াছে। নবমের শিক্ষার্থীদিগকেও ভালোবাসিয়াছিলাম, তাহারাও অশ্রুজলেই প্রতিদান দিয়াছে।
আমি দশম শ্রেণির মেয়েদিগকে কখনোই ভুলিব না। বিশেষ করিয়া শামসুন্নাহার, স্মৃতি, আরজু, মেহেরুন, ইরা, লাবণ্য, নাসরিন, মাহমুদা, রিমি, রীমা, দীপ্তিসহ আরও অনেককে। ছেলেরা তো সংখ্যায় পাঁচ জন ছিল। শান্ত, হৃদয়, শরিফ, ওমর ফারুক, জাকির, মিদুলকেও ভুলিব না। বোধকরি তাহারাও আমাকে ভুলিবে না।
তিন জনকে লইয়া বেশি ঠাট্টা-তামাশা করিয়াছি; ইহারা হইল- ইরা, মাহমুদা ও দীপ্তি। একজনের প্রেমেও পড়িয়া গিয়াছিলাম বোধহয়। বিষয়টি যদিও লজ্জার! আসলে বাস্তবতা কী, মানুষ যাহাকে বেশি অবমূল্যায়ন করে, একসময় তাহার কথাই বেশি ভাবে। এই যেমন আমি একজনকে বারংবার ভাবিতেছি। তাহার কথা ভাবিতে ভাবিতে আমার দিবস-রজনী কাটিতে চাহে না। ছেলেদের মধ্যে শরিফকে বেশি কথা শুনাইয়াছি, ভর্ৎসনা করিয়াছি। ক্লাসে বড্ড প্রাণোচ্ছ্বল ছিল ছেলেটি।
দুই বেলা কোচিং, একবেলা ক্লাস- আমি হাঁপাইয়া উঠিয়াছিলাম। রাত্রি নয়টায় যখন মেসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতাম, শরীর চলিত না। টলিতে টলিতে পথ চলিতাম (শেষদিকে অবশ্য শাহ্ আলম সঙ্গ দিত; সে তেলিপাড়ায় একটি স্কুলে চাকরি লইয়াছিল)। মনে হইত রাস্তায়ই ঘুমাইয়া যাই।
একসময় বুঝিতে পারিলাম মেস পাল্টাইতে হইবে। রুমমেট তৌহিদ ও শাহ্ আলমের সাথে পরামর্শ করিয়া মেস পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিই। নূতন আবাসস্থল হয় তেলিপাড়া কাউন্সিলরের অফিসের নিকটেই। ঐখান থেকেই স্কুলে যাতায়াত করিতে থাকি। তাহারও কয়েকমাস পর আগস্ট মাসের শেষেরদিকে স্কুলটি ছাড়িয়া দিই। কারণ, হিসাবে জানাই আমি গুরুতর অসুস্থ।
চলবে...
৫ ভাদ্র ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
ভালুকা, ময়মনসিংহ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৩:৪২