somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কৈশোরে যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন "মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান", বার্ধক্যে সেই তিনিই আবার বলেছিলেন, " মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে"

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মৃত্যু ব্যাপারটা আসলে কেমন? ভয়ঙ্কর? ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর?
এটা মনে হয় ঠাহর করা যায় না। কারণ, কেউ মরে এসে বলে যায় নি।
কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার যথার্থই বলেছিলেন, "চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে? কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কী সে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে"। বাস্তবিকই সুখী মানুষ, দুঃখীদের বেদন বুঝতে পারে না, সাপ যাকে কামড় দেয় নি সে কামড়ের ব্যথা বুঝবে না।

অবশ্য সবকিছু যে সরাসরি উপলব্ধি করতে হবে, এমন না। আগুনের কাছাকাছি গেলেই বোঝা যায় যন্ত্রণাটা কেমন হবে। জলে ডুবে মরা, সড়ক দুর্ঘটনায় মরা যে কাউকে দেখলেই সামান্য হলেও ধারণা করা যায় মৃত্যু আসলে কী!

মৃত্যু যদি নিজের হাতে হয় সেটা কেমন? সেটা মনে হয় আরও ভয়ঙ্কর। মানুষ মৃত্যুর তারিখ জানে না, তাই তো আশা নিয়ে বাঁচতে পারে অনেকদিন। আর যদি জানতে পারে, মৃত্যুটা তারই হাতে সেই বিভীষিকার আঁচটা কেমন?

কেউ তো আর স্বেচ্ছায় মরতে চায় না, জগতের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন দাঁড়িয়ে থাকে, তার অনুভূতিটা তখন কেমন থাকে?

মরার সময় বেঁচে থাকার একটা স্পৃহা জাগে হয়ত। সমুদ্রে ডুবে যাওয়া লোকটা যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, গলায় ফাঁস নেওয়া লোকটাও গলা থেকে দড়ি খুলতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়, যদিও খোলার মত শক্তি থাকে না। কিংবা বিষ খেয়ে নীল হয়ে যাওয়া লোকটার বাঁচার আকুতি দেখেও বোঝা যায় মানুষ আসলে যে করেই হোক বাঁচতেই চায়, সুখী-দুঃখী সবাই।


খুব সম্ভব ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ের ঘটনা। একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক সবাই পূর্বদিকে ছুটছে। কৌতুহল চেপে রাখতে পারলাম না, আমিও দিলাম ছুট।

এক কিলোমিটার হেঁটে একটা আমগাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। আমার মত অনেক কৌতুহলী মুখ সেখানে দাঁড়ানো। সবাই আমগাছের ডালের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও এক নজর তাকালাম।
ঝুলে থাকা লাশটা কমবয়েসী মোটামুটি সুন্দরী মতন এক স্ত্রীলোকের। ভিক্ষে করত এলাকায়। কেন ফাঁস নিয়েছে কেউ বলতে পারে না।
একটা ঘরে একা থাকত। কারও সাথে তেমন যোগাযোগ ছিল না। হত্যা না আত্মহত্যা কেউ বলতে পারে নি।

গলায় দড়ি গেঁথে গিয়েছিল। জিহ্বা বেরিয়ে এসেছিল। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য এখনও মনে দাগ কেটে আছে, মনে হলে গা শিউরে ওঠে।


সন্ন্যাসী হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল বরাবরই। তবে এ আকাঙ্ক্ষায় কিছুটা ভাটা পড়েছে শরৎচন্দ্রের 'বিলাসী' গল্পটা পড়ার পর। মশার কামড় সহ্য করতে না পেরে উনি সন্ন্যাসধর্ম ত্যাগ করেছিলেন। মশার ভয় পাই না, হয়ত একদিন সন্ন্যাসী না হোক ভবঘুরে হয়েই যাব।

'বিলাসী' পড়ার পর আরও একটা অদম্য ইচ্ছে অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে গেছে, সেটা হলো সাপুড়ে হওয়া। ঐ সময়ই উপলব্ধি করি সাপুড়েদের পেশাটা ছল-চাতুরীর, বড্ড লোক ঠকানো।

'বিলাসী' নিয়ে এত কথা কেন বলছি? প্রাসঙ্গিকতা আছে বৈকি। কারণ, কৈশোরে এই গল্প পড়ে আমি কেন জানি না আত্মহত্যাকে মৌন সমর্থন করতে শুরু করি। মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যু হওয়ার পর বিলাসীর আত্মহত্যাকে আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি। শাস্ত্রমতে তার নরকে যাওয়ার কথা। এমন ঘটনা পরিক্রমায় গল্পের লেখকের মতো আমিও নরকে যাওয়ার পক্ষে।


সেদিন গাজীপুরের একটা গ্রামে ঢুকলাম। ঐ গ্রামেরই দু'জন আমার সঙ্গে ছিল। আমরা যখন হাঁটছিলাম, মাটির তৈরি সুন্দর একটা বাড়ি চোখে পড়ল। দরজা বন্ধ থাকায় পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কেউ থাকে কী না। সে জানাল, কেউ থাকে না।
বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। কোন এক সময়ের জমজমাট বাড়িটা অনাদরে-অবহেলায় জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে আছে।
কথা বলে জানতে পারলাম, এখানে এক স্ত্রীলোক তার স্বামীকে নিয়ে থাকতেন। স্বামীটা ছিল পাঁড় মাতাল। রোজ রাত করে বাড়ি ফিরত।
কোন এক প্রত্যুষে দেখা গেল, স্ত্রীলোকটা গলায় ফাঁস নিয়ে ঝুলে আছে। শুনলাম, স্বামী তাকে মারধর করত না। ভালোবাসত যথেষ্ট। তাহলে কেন আত্মহত্যা করল? স্বামীর প্রতি বিরক্ত হয়ে? নাকি মাদকাসক্ত স্বামীই খুন করে ঝুলিয়ে রেখেছিল? সদুত্তর পেলাম না, পুলিশও নাকি ব্যাপারটা নিয়ে এত মাথা ঘামায় নি।

একটা ব্যাপার খুব রহস্যজনক। লাশ নাকি মাটি ছুঁয়ে ছিল। এটা কী করে সম্ভব? বলা হয়ে থাকে, ফাঁস অন্য জায়গায় নিয়েছিল। লোকজন লাশ নামিয়ে পুলিশি ঝামেলা হবে ভেবে তড়িঘড়ি করে লাশটা আবার গলায় দড়ি লাগিয়ে ঐ অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখে। খুব সম্ভব আইন-আদালতের ফাঁপড়ে পড়তে চায় নি। আত্মহত্যা করেছে এটাই ঠিক। পুলিশকে তাই বুঝিয়েছে।

তবে এ কথাগুলো আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি। কেন হয় নি জানি না।
সুন্দর একটা পরিবার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। কেন পড়ল? মানুষ কেনই বা ঘর বাঁধে?

বাড়িটা কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। হালকা বাতাসে শরীরটা কেঁপে ওঠেছিল আমার। মনে হচ্ছিল বাতাস কিছু বলে যাচ্ছে। কী বলে যাচ্ছে আমি বুঝতে পারি না। আমি আসলে কিছুই বুঝি না।

জন্ম নিলে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। মানুষের জন্মই তো হয় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করার জন্য।
মধুসূদন বলেছিলেন, "জন্মিলে মরিতে হবে, অমরকে কোথা কবে? স্থির কবে নীর হায় রে জীবন নদে?" জগতে কোনকিছুই স্থায়ী নয়।
জন্মটা যেমন স্বাভাবিকভাবে হয়েছে, সবার মৃত্যুটাও যেন তেমন স্বাভাবিক হয়। প্রকৃতির কাছে এরচেয়ে বেশি কী চাওয়ার থাকতে পারে?

৩ মাঘ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
গাজীপুর।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:১৮
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×