সমরেশ মজুমদার একবার হুমায়ুন আহমেদকে জনপ্রিয় লেখক সম্বোধন করে আলাপ করছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ তো লজ্জায় কাঁচুমাচু। বিনয়ের সাথে যা বললেন, তার মানে দাঁড়ায়- দেশভাগের পর ভারত থেকে বই আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এদেশের পাঠকশ্রেণিতে একটা বিরাট শূন্যতা বিরাজ করে। হুমায়ুন পরবরর্তীতে এই শূন্যতাটা পূরণের চেষ্টা করেন। ওনি বলেন যে ওনার লেখা পাতে তোলার মতো না।
সম্ভবত সৈয়দ শামসুল হক ওনার লেখা নিয়ে বিদ্রুপ করেছিলেন। ওনি না কি টাকার জন্য লেখেন।
হুমায়ুন সহাস্যে বলেছিলেন, ওনি টাকার জন্যই লেখেন। সত্যিই লেখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অবস্থায় ওনার দিন ভালো যাচ্ছিল না। টানাপোড়েন লেগেই ছিল। তখন বিটিভির ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেছিলেন। হুমায়ুন বলেছেন, সেই ধারাবাহিকের টাকা দিয়ে ওনি সন্তানদের জন্য বাসায় টিভি কিনেছিলেন।
হুমায়ুন আজাদ ওনার উপন্যাসকে অপন্যাস বলেছিলেন। বলেছিলেন, এতে শেখার কিছু নেই।
হুমায়ুনও রসিক। বলেছিলেন, ওনি আসলে পাঠ্যবই লেখেন না।
চিন্তা-ভাবনা বা মত প্রকাশে তিনি এমনই সৎ ছিলেন।
লেখালেখি করে সবাই যে বিখ্যাত হতে চায়- এমন না। কেউ কেউ নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে তৃপ্ত হন। হুমায়ুন পড়ুয়া পরিবার থেকে এসেছিলেন। ওনার মা-বাবা প্রচুর পড়াশোনা করতেন। সন্তানদেরও উৎসাহিত করতেন। ফলস্বরূপ তো বলা হয় বাংলাদেশের অর্ধেক সাহিত্য ওনাদের পরিবারের (হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল, আহসান হাবিব)।
ওনি বিখ্যাত হওয়ার অভিপ্রায়ে লেখালেখি করেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু পাঠক তার লেখা গ্রহণ করেছে। বিখ্যাত করে তুলেছে।
ওনার কালজয়ী কিছু বই আছে যেমন (জোছনা ও জননীর গল্প, শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, ১৯৭১, বাদশাহ নামদার, মধ্যাহ্ন) কিছু অহেতুক বইও আছে। সমালোচকরা যেগুলোকে ফরমায়েশি লেখা বলেন। শঙ্খ ঘোষকে একবার বলা হয়েছিল, আপনার কিছু কিছু লেখা একদম যায় না আপনার সাথে। ওনি জবাবে বলেছিলেন, আমরা সবসময় ভালোমন্দ খাই না। মাঝেমধ্যে মলমূত্রত্যাগও করি।
একজন লেখকের সব লেখাই ভালো হবে তা কিন্তু না। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আমরা বলতে পারি ওসব না লিখলেও চলত। অনেকে তো এক দুটো বই লিখেই বিখ্যাত হয়েছেন। যেমন অদ্বৈত মল্ল বর্মন শুধু একটা বই লিখে (তিতাস একটি নদীর নাম) বিখ্যাত। জীবিতদের মধ্যে হেলাল হাফিস 'যে জলে আগুন জ্বলে' লিখে বিখ্যাত। এগুলো আমাদের মতামত কিন্তু মতামত কি লেখকদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারি?
তিনগোয়েন্দা বা অন্যান্য কিছু দিয়ে একটা প্রজন্ম বই পড়া শুরু করত। তারপর ধীরে ধীরে অন্যদের বই পড়ে। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে যে প্রজন্মটা বেড়ে উঠছে, এরা হুমায়ুন আহমেদের বই পড়েই বেড়ে উঠছে। তারপর এক পর্যায়ে শরৎচন্দ্র শুরু করে। সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু শুরু করে। তারও পর মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর শুরু করে। তারপর ধীরে ধীরে বাইরের দেশের বই শুরু করে। তো এই যে প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, এদের বই পড়ার গোড়াপত্তন করার অবদানটা কিন্তু হুমায়ুন আহমেদকে দিতে হবে।
এখন অবশ্য লোকজন বইপত্র কম পড়ে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের যুগে বই পড়ার সময় কোথায়? তাও যারা পড়ছে তাদের একাংশকে বইমুখী করার জন্য হুমায়ুন আহমেদ অবশ্যই প্রশংসিত হবেন৷ অবশ্য কেউ যদি এক হুমায়ুন আহমেদকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থেকে নিজেকে সাহিত্যবোদ্ধা দাবি করে তার দায় নিশ্চয়ই হুমায়ুন আহমেদের নয়।