somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দূরের বাদ্য মধুর শোনায় শূন্য হাওয়ায় সঞ্চরি (হুমায়ুন-গুলতেকিন প্রসঙ্গ)

২১ শে এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বারো-তেরো বছরের এক কিশোরী হঠাৎ সাতাশ-আটাশ বছরের এক যুবকের প্রেমে পড়ল। যুবকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। পাঠদানের পাশাপাশি লেখালেখি করেন। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগারসহ বেশ কিছু বই বেরিয়েছে তার। শামসুর রাহমান তার লেখার প্রশংসা করে পত্রিকায় লিখেছেন। আহমেদ ছফাও লিখলেন। যুবকটির প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে প্রকাশে সহযোগিতাও করেছেন।

মেয়েটি মাঝেমধ্যেই যুবকটির অফিসে গিয়ে বসে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে তার কথা। এমন রোমান্টিক মানুষ সে জীবনে দেখেনি। মানুষটা জ্যোৎস্না পছন্দ করে, বৃষ্টি পছন্দ করে। শুধু পছন্দ করে না, বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ করে। তার গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না নামে দারুণ একটা কবিতা বহুবার পড়েছে সে।

একদিন হুট করে যুবকটির সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল। চালচুলোহীন এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে মেয়েটির পরিবার মানতে চায় নি। মানবে কেন? মেয়েটি যে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি। এত বড় ঘরের মেয়েকে কি এমন ছেলের সঙ্গে মানায়? মেয়েটি কারও কথা শুনল না।

ছেলেটির বাবা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। মা, তিন ভাই আর দু'বোনকে নিয়ে টেনেটুনে তাদের সংসার চলছিল। তার ছোটভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সেও লেখালেখি করে। তাদের পুরো পরিবারটাই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের। তিন ভাইই লেখালেখি করে। তাদের বাবা এই অভ্যাসটা গড়ে দিয়েছিলেন।

শহিদ পরিবার হিসেবে একটা ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল সরকারের তরফ থেকে। সেখানেই থাকে তারা। ঘরে তেমন আসবাবপত্র নেই। বাইরে থেকে কিছু আসবাবপত্র ভাড়া আনা হয়েছিল। দেখা গেল বিয়ের দিন সেসব নেওয়ার জন্য লোক হাজির। বিব্রত সবাই। কী হচ্ছে, মেয়েটা কিছুই বুঝতে পারছিল না।

অবাক হওয়া আরও বাকি ছিল। সরকার থেকে বরাদ্দ পাওয়া বাড়িটা একসময় বেদখল হয়ে গেল। গোটা পরিবার এখন কোথায় যায়? কী করে? কী খায়?

যুবকটার প্রতি যে মুগ্ধতা ছিল, একসময় ফিকে হয়ে যেতে থাকে মেয়েটির। মেয়েটা বুঝতে পারে কল্পনা আর বাস্তব এক না। সে যে ঝোঁকের মাথায় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; এটা বুঝতে অল্পসময়ই লাগল।

উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে। পড়ালেখার ইচ্ছে আছে। অথচ স্বামী থেকে তেমন সহযোগিতা পাচ্ছে না। দেখা গেল, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় স্বামীর সঙ্গে বিদেশ যেতে হলো।

একসময় অবশ্য পরীক্ষা দিল, পাশও করল। কিন্তু সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সহযোগিতা করলেন না স্বামী। নিজের চেষ্টায় যতদূর পারল, এগোতে লাগল মেয়েটি।

না, স্বামী ততদিনে আর গরিব নেই। গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি উনি নাটকও লেখেন। অয়োময়, এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবারসহ অনেক নাটক লিখেছেন, কিছু কিছু পরিচালনাও করেছেন। নাটক লিখে বাসায় টিভিও কিনে ফেলেছেন।

একসময় শিক্ষকতা ছেড়ে চলচ্চিত্রও পরিচালনা শুরু করলেন। আগুনের পরশমণি, চন্দ্রকথা, দুই দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন পরিচালনা করলেন। পরবর্তীতে পরিচালনা করলেন নয় নম্বার মহা বিপদ সংকেত, ঘেঁটুপুত্র কমলাসহ আরও অনেক চলচ্চিত্র। নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক তিনি। শোনা যায়, কক্সবাজারে না কি রিসোর্টও কিনেছেন।

অনেক বছর পরের কথা। বিটিভির এক সাক্ষাৎকারে লেখক আনিসুল হক যখন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি আপনার মেয়েদের বিয়ে কোনো লেখকের সঙ্গে দেবেন?’

ঐ মুহূর্তে সাহিত্যিক মহাশয় (ততদিনে তিনি আর আগের যুবক নেই) বেশ বিচলিত এবং উত্তেজিত। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি।

স্ত্রী নেতিবাচক উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চেহারাটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল তার।

আনিসুল হক যখন প্রশ্ন করলেন, ‘এখন হলে আপনি উনাকে বিয়ে করতেন কি না?’

ভদ্রমহিলা ক্যামেরার সামনে সুচিন্তিতভাবে জানিয়ে দিলেন, না, এখন হলে তাকে বিয়ে করতেন না।

লেখক ভদ্রলোকের মাথা আরেকবার নিচু হয়ে গেল ক্যামেরার সামনে।

ততদিনে তাদের সংসারে তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। সবাই প্রতিষ্ঠিত। মেয়েদের বিয়েও হয়েছে ভালো জায়গায়। কিন্তু তবু কি সুখ এল সংসারে? লেখক ভদ্রলোক বাবা হিসেবে ১০০ তে ১০০ পাবেন। কিন্তু স্বামী হিসেবে?

শেষ বয়সে পরিবার, সমাজ সবকিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে হাঁটুর বয়সী একজনকে বিয়ে করলেন, যে নাকি তার মেয়ের সহশিল্পী ছিলেন। আগের স্ত্রীকে দিলেন তালাক। ছিছি পড়ে গেল সারাদেশে। লোকজন বলতে লাগল শেষ পর্যন্ত মেয়ের বান্ধবীকে?
যদিও পরবর্তী স্ত্রী এসবের জবাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কি লোকজনের জবান বন্ধ হয়?

ব্যাপারটা এমন না যে লেখক ভদ্রলোক নারী লোভী ছিলেন। উনার যে অবস্থান, উনি চাইলেই শত শত নারী তার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ার কথা। তাও এমন করলেন কেন তিনি? শেষ বয়সে নতুন করে বিয়েই বা করলেন কেন?

আসলে উনি মুগ্ধতা চেয়েছিলেন। যা একসময় আগের স্ত্রীর মধ্যে ছিল না। অথবা কম ছিল (লেখক ভদ্রলোক না কি বাসররাতে জাদু দেখিয়ে স্ত্রীকে চমকে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্ত্রী চাতুরী ধরে ফেলায় খুব হতাশ হয়েছিলেন)। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকলে মুগ্ধতা কমারই কথা। আমাদের চারপাশে আমরা কত শত বিবাহবিচ্ছেদ দেখি, কেন এমন হয়? সবারই কি চরিত্র খারাপ?

মোটেই না। আমরা আগ্রহ ধরে রাখতে পারি না। একসময় যাকে ভালো লাগে, একটা সময় পরে সে ভালো লাগাটা আর থাকে না। পানসে হয়ে যায়। এতদ্বসত্ত্বেও যারা থাকে, তারা অভ্যাসের বশে থাকে। লোকনিন্দার ভয়ে থাকে।

লেখক ভদ্রলোক প্রয়াত হয়েছেন। উনার আগের স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করেছেন। সন্তানের যে যার মতো ভালো ভালো অবস্থানে। উনার পরবর্তী স্ত্রী আর বিয়ে করেননি। দুই সন্তান নিয়ে স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছেন।

আজও যখন স্বামীর স্মৃতিচারণ করেন, তার চোখে স্বামীর জন্য প্রেমিকার উচ্ছ্বাস থাকে। বিষাদ থাকে। পুরুষের কাছে স্ত্রীর এই প্রেমিকার চোখ বা মুগ্ধতার চেয়ে বড় কিছু আর নেই।

ছবিসূত্র
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০২৩ বিকাল ৪:২৩
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×