আমি মাঝেমধ্যেই এর-ওর সাথে সুখ-দুঃখের কথা শেয়ার করি। দেখা যায়, সুখের ঘটনা কম, বেশিরভাগই দুঃখের ঘটনা। অনেকে সমব্যথী হয়, আবার অনেকে মজা নেয়। শুভানুধ্যায়ীরা বলেন, দুঃখের দিন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এসব না বলাই ভালো। এখন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে। অথচ দিন বদলালে এরাই প্রশংসা করবে।
শুভানুধ্যায়ীয়ের কথাই ঠিক। তাও নিজেকে বদলাতে পারি না। আমার মনে হয়, এসব ঘটনা মাঝেমধ্যে শেয়ার করলে আপন-পর চেনা সহজ হয়। জীবনের একটা সময় মনে হতো সবাই আপন, এভাবেই তো তারপর একসময় বুঝতে শিখি সবাই আপন হয় না।
অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর নিজে নিজে চলার চেষ্টা করছিলাম। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। সহপাঠীরা ধুমসে টিউশনি করাচ্ছিল অথচ আমি পাই না। একে-ওকে বলি কেউ দেয় না। সিভি নিয়ে কোচিং থেকে কোচিং এ দৌড়াই, জুতার তলা ক্ষয়ে যায় কিন্তু কেউ ডাকে না।
এভাবে ৫-৬ বছর কেটে যায়, মাসে মাত্র ৩ হাজার টাকা উপার্জন করার যোগ্যতা হয় না আমার। গার্মেন্টসেও চাকরি হয় না। মাস্টার্সে উঠার পর কোনোমতে ছোটখাটো একটা-দুটো কাজ পাই, পেট চালানোও কঠিন। লড়াইটা আমার চলতেই থাকে।
এসব ঘটনা পরিচিতজনরা অনেকেই জানেন। মজার ব্যাপার হলো, সবচেয়ে কাছের মানুষেরা বেশিরভাগ জানেন না। ব্লগেও মাঝেমাঝে শেয়ার করেছি। সমব্যথী হয়েছে অনেকে, অনেকে আবার নিন্দাও করেছে। একজন তো সরাসরি খোঁটাও দিয়েছিলেন, অনার্স-মাস্টার্স করেও কিছুই করতে পারিনি। আঘাত করে অনেক কথাও বলেছেন। খুব ব্যথিত হয়েছিলাম এটা ভেবে যে, এই ভদ্রলোক একসময় আমার জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন।
একজন আমার টিউশনি নিয়ে বাহাসও করেছিলেন। আমি অবশ্য তেমন কিছু মনে করিনি। এটা স্বাভাবিক। মানুষ তো যোগ্যদেরই মনে রাখবে। অযোগ্যদের কে মনে রাখে? আর যোগ্যতা নিজেকেই অর্জন করতে হয়। অনার্সের পর নয় মাস বাড়িতে বসেছিলাম। নিজের মা-বাবা, পাড়া-পড়শীরা পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আমাকে নিয়ে কেউ বাহাস করবে- এটা অস্বাভাবিক কিছু না।
অনার্সে থেকে যখন একটা টিউশনি জোগাড় করতে পারছিলাম না, এক মামা বলেছিলেন সবাই টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। আমি কেন পারছি না। আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম না কেন পারছি না। এত অসহায় লাগছিল, মনে হচ্ছিল যে কোনো কাজ পেলেও করব। কিন্তু তেমন কাজও পাইনি।
আহমদ ছফা একবার না কি না খেয়ে ঢাকা শহর টইটই করে ঘুরছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ জিগ্যেস করেছিলেন, ঘটনা কী? ছফা জানান, তিনি খিদে নিয়ে গল্প লিখবেন। খিদের গল্প আমি ভালোমতোই জানি। আমি এটাও বুঝি কেউ নিজে ভুক্তভোগী না হলে অন্যের কষ্ট বোঝে না।
অবশ্য অনেকে নিজের লড়াইটা ভুলে যায়। এই যেমন আমি যখন একটা কোয়ার্টারে ভাড়া থাকতাম, আমার এক-দু'জন বন্ধু আসত বাসায়। সরকারি চাকুরে আমার রুমমেট বিরক্ত হতো। তাচ্ছিল্য করে এটা-ওটা বলে ফেলত। অথচ একসময় সে নিজেও বেকার ছিল। সেও এর-ওর বাসায় থেকে পরীক্ষা দিত।