কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়
আমার বাবা-কাকারা সর্বমোট সাত ভাই, আর ফুফু দুইজন। সবমিলিয়ে নয়জন। একজন নাকি জন্মের পর মারা গিয়েছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমার পিতামহ কামেল লোক ছিলেন। ওদিকে মাতামহও কিন্তু কম যান না। উনারও সাত ছেলে, তবে মেয়ে একজনই। তিনি আমার মা।
এত এত ছেলেমেয়ের তো এক বাড়িতে থাকা সম্ভব না। তারপর আবার বিয়ে-শাদী করেছেন কয়েকজন। সন্তানাদিও হয়েছে। বাড়িটাই যেন একটা মহল্লা। এই যখন অবস্থা, আমার এক কাকা সপরিবারে ময়মনসিংহ শহরে চলে গেলেন। আরেক কাকা চলে গেলেন রাজধানী ঢাকায়। একজন চলে গেলেন মালয়েশিয়ায়। সবচেয়ে ছোটোজন পড়ালেখার সুবাদে বাড়ির বাইরে থাকতেন।
আমার বাবাও তার গন্তব্য খুঁজে নিলেন। পুরাতন বাড়ি থেকে এর দূরত্ব অবশ্য খুব বেশি না; মাত্র দুই-তিন মিনিটের পথ। রাস্তার পাশেই একটা ঘন জঙ্গল। এর আশেপাশেই একটা মাটির ঘর তোলা হলো। বাবা-মা এখানে থাকা অবস্থায়ই আমার, আমার মেজোবোন আর ছোটোবোনের জন্ম। বড়োবোনের জন্ম পুরাতন ভিটায় থাকা অবস্থায়ই।
ঘন জঙ্গল। তার পাশে গোরস্থান। ডানে-বামে দুইপাশে পুকুর। বাবা সারাদিন কাজের কারণে বাড়ির বাইরে থাকতেন। মাঝেমধ্যে কয়েকমাসের জন্য দূর-দূরান্তে চলে যেতেন। উনি মূলত নলকূপ স্থাপনের কাজ করতেন। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম। এই জেলা থেকে ওই জেলা ঘুরে ঘুরে তাকে কাজ খুঁজতে হতো।
বড়োবোন তো নানার বাড়ি থাকতেন। এদিকে আমার মা আমাদের নিয়ে পড়লেন মহাবিপদে। তিনটে ছোটো ছোটো সন্তান লালনপালন করতে হিমশিম খেতেন তিনি। মেজোবোনের বয়স তখন ছয়-সাত। সে আমার চেয়ে দু'বছরের বড়ো। ছোটোবোনের বয়স সবে এক। মেজোবোন ভদ্র-শান্ত স্বভাবের হলেও আমি ছিলাম দুষ্টুর একশেষ। মা রান্না করতে বসলে আমি চুপে চুপে জঙ্গলে চলে যেতাম। পাশেই একাধিক পুকুর; ওই সময়টায় পুকুরে ডুবে অনেক ছেলেমেয়ে মারা যেত। সংখ্যাটা এখনও যে কমেছে, তা কিন্তু না। তো মা বাড়ির বাইরে ছাগল বা গোরু চরাতে গেলে আমাকে শেকলে বেঁধে রেখে চলে যেতেন। আর আমার মেজোবোন কেঁদে কেঁদে বলত, আমার ভাইকে ছেড়ে দে।
অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের বাড়ি বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। পুকুর-জঙ্গল থেকে একটু দূরে খোলা একটা জায়গা নির্দিষ্ট হলো। মাটির ঘর তোলা হলো। তবে আমার দুষ্টুমির কিন্তু শেষ ছিল না। বয়স সবে সাত-আট, তবে ততদিনে আমার বাঁদরামি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাবা নলকূপ গাঁড়লেন। আশপাশের কাকি-ভাবিরা পানি নিতে এলে আমি কাঁচি নিয়ে দৌড়ানি দিতাম। মাটির কলস ভেঙে দিতাম। লোকজন ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠল।
মামারা সিদ্ধান্ত নিলেন বাবাকে সৌদি আরবে পাঠাবেন। মায়ের আপত্তি ছিল। তবে কিছু করার ছিল না। বাবা দেশে থাকলেও সেই দূর-দূরান্তেই থাকতেন। বিদেশে গিয়ে দুটো পয়সা বেশি এলে সংসারেরই মঙ্গল।
বাবা তো বিদেশ চলে গেলেন। কিন্তু এদিকে আমরা পড়লাম অকূল পাথারে। বাবা তখনও কোনো কাজ পাননি। গ্রাম এলাকায় পড়েছেন। আমাদের সংসার চালানো অনেক কঠিন হয়ে গেল। মা শাকপাতা, কচুর লতা এসব তুলে এনে আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন। আলুর ভর্তা খেতে খেতে এই খাদ্যটার ওপর রাজ্যের বিরক্তি এসে গেল। মাছ-মাংস জুটানো তো দূরের কথা, একসময় ভাত খাওয়াও কঠিন হয়ে গেল।
নতুন যে ঘরটা তোলা হলো, সেটার দরজা-জানালা তখনও কিছুই লাগানো হয়নি। আর চালাটাও ছাপড়া। কথা ছিল বাবা বিদেশে গিয়ে টাকা-পয়সা পাঠাবেন, তারপর সব করা হবে। কিন্তু কোনো কিছুই করানো হলো না। আমরা চোখের সামনে ঘোর অমানিশা দেখতে লাগলাম।
একবার প্রচণ্ড ঝড় হলো। মনে হচ্ছিল পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তার ওপর বজ্রপাত। মা, আমি, মেজোবোন আর ছোটোবোন তো ভয়ে প্রায় শেষ। ঘরের চালাটা হঠাৎ উড়ে গেল। আমরা দৌড়ে একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। সেটা যখন ভাঙার জোগাড়, আমরা খোলা জায়গায় দাঁড়ালাম। আমার মা দিশে পাচ্ছিলেন না এসময় কাকে ডাকবেন। প্রচণ্ড তুফানের মধ্যে কারও বাড়িতে যাওয়ার সুযোগও ছিল না।
পরদিন আমি আর আমার বোনেরা আমাদের চালা খুঁজতে লাগলাম। আমরা খুব কাঁদছিলাম এটা ভেবে যে, আমাদের থাকার কোনো জায়গা নেই। আমাদের সাহায্য করারও কেউ নেই। কাকারাও জানি না কী কারণে দূরত্ব বজায় রাখতেন। যাহোক, খুঁজতে খুঁজতে একসময় পাশের বাড়ির পুকুরে আমাদের টিনের চালাটা আবিষ্কার করলাম। মাকে দৌড়ে এসে বলতেই, মাও ছুটে এলেন। আমরা ভাবছিলাম কী করে এই চালা ঘরে লাগাব।
চলবে...
ছবি: প্রতীকী
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৪১