somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়

২৩ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায়
আমার বাবা-কাকারা সর্বমোট সাত ভাই, আর ফুফু দুই জন। সবমিলিয়ে নয় জন। একজন নাকি জন্মের পর মারা গিয়েছেন। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমার পিতামহ কামেল লোক ছিলেন। ওদিকে মাতামহও কিন্তু কম যান না। উনারও সাত ছেলে, তবে মেয়ে একজনই। তিনি আমার মা।

এত এত ছেলেমেয়ের তো এক বাড়িতে থাকা সম্ভব না। তার ওপর আবার বিয়ে-শাদী করেছেন কয়েকজন। তাদের সন্তানাদিও হয়েছে। বাড়িটাই যেন একটা মহল্লা। এই যখন অবস্থা, আমার এক কাকা সপরিবারে ময়মনসিংহ শহরে চলে গেলেন। আরেক কাকা চলে গেলেন রাজধানী ঢাকায়। একজন চলে গেলেন মালয়েশিয়ায়। সবচেয়ে ছোটোজন পড়ালেখার সুবাদে বাড়ির বাইরে থাকতেন।

আমার বাবাও তার গন্তব্য খুঁজে নিলেন। পুরাতন বাড়ি থেকে এর দূরত্ব অবশ্য খুব বেশি না; মাত্র দুই-তিন মিনিটের পথ। রাস্তার পাশেই একটা ঘন জঙ্গল। এর আশেপাশেই একটা মাটির ঘর তোলা হলো। বাবা-মা এখানে থাকা অবস্থায়ই আমার, আমার মেজো বোন আর ছোটো বোনের জন্ম। বড়ো বোনের জন্ম পুরাতন ভিটায় থাকা অবস্থায়ই।

ঘন জঙ্গল। তার পাশে গোরস্থান। ডানে-বামে দুইপাশে পুকুর। বাবা সারাদিন কাজের কারণে বাড়ির বাইরে থাকতেন। মাঝেমধ্যে কয়েকমাসের জন্য দূর-দূরান্তে চলে যেতেন। উনি মূলত নলকূপ স্থাপনের কাজ করতেন। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম। এই জেলা থেকে ওই জেলা ঘুরে ঘুরে তাকে কাজ খুঁজতে হতো।

বড়ো বোন নানার বাড়ি থাকতেন। এদিকে আমার মা আমাদের নিয়ে পড়লেন মহাবিপদে। তিনটে ছোটো ছোটো সন্তান লালনপালন করতে হিমশিম খেতেন তিনি। মেজো বোনের বয়স তখন ছয়-সাত। সে আমার চেয়ে দু’বছরের বড়ো। ছোটো বোনের বয়স সবে এক। মেজো বোন ভদ্র-শান্ত স্বভাবের হলেও আমি ছিলাম দুষ্টুর একশেষ। মা রান্না করতে বসলে আমি চুপে চুপে জঙ্গলে চলে যেতাম। পাশেই একাধিক পুকুর; ওই সময়টায় পুকুরে ডুবে অনেক ছেলেমেয়ে মারা যেত। সংখ্যাটা এখনও যে কমেছে, তা কিন্তু না। তো মা বাড়ির বাইরে ছাগল বা গোরু চরাতে গেলে আমাকে শেকলে বেঁধে রেখে চলে যেতেন। আর আমার মেজো বোন কেঁদে কেঁদে বলত, আমার ভাইকে ছেড়ে দে।

অনেক ভেবেচিন্তে আমাদের বাড়ি বদলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। পুকুর-জঙ্গল থেকে একটু দূরে খোলা একটা জায়গা নির্দিষ্ট হলো। মাটির ঘর তোলা হলো। তবে আমার দুষ্টুমির কিন্তু শেষ ছিল না। বয়স সবে সাত-আট, তবে ততদিনে আমার বাঁদরামি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাবা নলকূপ গাঁড়লেন। আশপাশের কাকি-ভাবিরা পানি নিতে এলে আমি কাঁচি নিয়ে তাদের দৌড়ানি দিতাম। মাটির কলস ভেঙে দিতাম। লোকজন ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠল।

মামারা সিদ্ধান্ত নিলেন বাবাকে সৌদি আরবে পাঠাবেন। মায়ের প্রবল আপত্তি ছিল। তবে কিছু করার ছিল না তার। বাবা দেশে থাকলেও সেই দূর-দূরান্তেই থাকতেন। বিদেশে গিয়ে দুটো পয়সা বেশি এলে তো সংসারেরই মঙ্গল।

বাবা বিদেশ চলে গেলেন। এদিকে আমরা পড়লাম অকূলপাথারে। বাবা তখনও কোনো কাজ পাননি। গ্রাম এলাকায় পড়েছেন। আমাদের সংসার চালানো অনেক কঠিন হয়ে গেল। মা শাকপাতা, কচুর লতা এসব তুলে এনে আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন। আলুর ভর্তা খেতে খেতে এই খাদ্যটার ওপর রাজ্যের বিরক্তি এসে গেল। মাছ-মাংস জুটানো তো দূরের কথা, একসময় ভাত খাওয়াও কঠিন হয়ে গেল।

নতুন যে ঘরটা তোলা হলো, সেটার দরজা-জানালা তখনও কিছুই লাগানো হয়নি। আর চালাটাও ছাপড়া। কথা ছিল বাবা বিদেশে গিয়ে টাকা-পয়সা পাঠাবেন, তারপর সব করা হবে। কিন্তু কোনো কিছুই করানো হলো না। আমরা চোখের সামনে ঘোর অমানিশা দেখতে লাগলাম।

একরাতে প্রচণ্ড ঝড় হলো। তার ওপর বজ্রপাত। মনে হচ্ছিল পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। মা, আমি, মেজো বোন আর ছোটো বোন তো ভয়ে প্রায় শেষ। মনে মনে প্রার্থনা করছি কখন সকাল হবে। এই যখন অবস্থা, ঘরের চালাটা হঠাৎ উড়ে গেল। আমরা দৌড়ে একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। সেটা যখন ভাঙার জোগাড়, আমরা খোলা জায়গায় দাঁড়ালাম। আমার মা দিশে পাচ্ছিলেন না এসময় কাকে ডাকবেন। প্রচণ্ড তুফানের মধ্যে কারও বাড়িতে যাওয়ার সুযোগও ছিল না।

পরদিন আমি আর আমার বোনেরা আমাদের ঘরের চালা খুঁজতে লাগলাম। আমরা খুব কাঁদছিলাম এটা ভেবে যে, আমাদের থাকার কোনো জায়গা নেই। আমাদের সাহায্য করারও কেউ নেই। কাকারাও জানি না কী কারণে আমাদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখতেন। যাহোক, খুঁজতে খুঁজতে একসময় পাশের বাড়ির পুকুরে আমাদের টিনের চালাটা আবিষ্কার করলাম। মাকে দৌড়ে এসে বলতেই, মাও ছুটে এলেন। আমরা ভাবছিলাম কী করে এই চালা ঘরে লাগাব।

আমাদের সদ্য খনন করা পুকুরটা বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেল। যত মাছ সেখানে ছিল, আটকানোর সুযোগ রইল না। আমি আর দুই বোন শিউলি ও হ্যাপি জালি পেতে মাছ ধরার চেষ্টা করলাম বটে, একটা-দুটো পোনামাছ ছাড়া জালিতে কিছু উঠল না। বড়ো মাছগুলো লাফিয়ে চলে গেল।

মাছগুলো আটকানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারায় আমাদের খুব দুঃখ হতে লাগল। বাবা বিদেশে চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে মাত্র পুকুরটা খনন করা হয়েছে, ভালোভাবে পাড়ও বাঁধা হয়নি। বৃষ্টি পড়লে কাঁচা পাড় ভেঙে পড়ে। যদিও পরবর্তীতে মা, আমি আর বোনেরা মিলে সেখানে ঘাস লাগিয়েছিলাম।

চলবে...

ছবি: প্রতীকী
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২৪ সকাল ৯:১২
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একুশ বছর

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ভোর ৪:৩৬



একুশ বছর—
সাত হাজার ছয়শত পঁয়ষট্টি রাত
আমি নির্ঘুম— চোখের নিচে কালো দাগ সাক্ষী।
আজও ভেসে ওঠে তোমার প্রিয় হাসিমুখ
আর কাজল কালো এণাক্ষী।

প্রথম যেদিন আমি, তোমার পানে চেয়েছি
তোমার দুচোখে আমি, আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

"বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী".....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২২

"বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী".....

ভারতীয় উপমহাদেশ প্রায় ২০০ বছর বৃটিশদের অধীনে ছিলো। দীর্ঘ বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান হলে আমরা পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেলাম। আবার দুই যুগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশী হিন্দুরা কেন শক্তভাবে কথা বলতে পারছেনা?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:২১


বাংলাদেশের হিন্দুরা বলতে গেলে ৯৫ পার্সেন্ট আম্লিগকে ভোটি দেয় ইহা ধ্রুবসত্য। অনেকেই হয়তো দ্বিমত পোষণ করতে পারে সেটা তার নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তারা সবসময়ই ভাবে আম্লিগ তাদের রক্ষাকর্তা কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরে বাধ্য হবে ভারত: ড. ইউনূস

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮





অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষে রায় হলে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানাবে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে দু’দেশের স্বাক্ষরিত একটি আন্তর্জাতিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্বে ভুয়া তথ্য ছড়ানোয় শীর্ষে ভারত

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৪




বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়ানো দেশের তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে ভারত। মাইক্রোসফটের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর ছড়ায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×