'একটি কুঁড়ি দুটি পাতা রতনপুর বাগিচায়
কোমল কোমল হাত বাড়িয়ে লছমি আজও তোলে..'
2014 শরৎ এর সকালবেলা,পুজো আসতে এখনো 1 মাস বাকি ছুটির দিনে কানে হেডফোন লাগিয়ে একমনে গান টা শুনছিলাম,অনেকদিন থেকেই মন টা পাহাড় পাহাড় করছে।।আসলে অনেকদিন পাহাড় না গেলে আমার মন খুঁতখুঁত করে,কোনো কাজে মন বসে না,পাহাড় থেকে ঘুরে এলে মন শান্তি হয়ে যায়।।গান টা পস করে গুরুদেব কে ফোন লাগালাম,আপনারা ভাবছেন আমি হয়তো তন্ত্র সাধনা তে বিশ্বাস করি,তাই হয়তো গুরুদেব এর কথা বলছি।।কিন্তু এ সেই গুরুদেব না,আসলে আমার কলকাতার মেস জীবনে অন্যতম পাওয়া এক দাদা,যার সাথে মনের সব কিছু বলতে পারতাম এক নিমেষেই।।
-'বলছি পুজোতে একটা প্ল্যান করি পাহাড় যাওয়ার?'
-'হ্যাঁ করে ফেল,কৃশানু,পম,হিরক কে একটু বলিস,ওরা উত্তরবঙ্গের ছেলে তো রাজি হয়ে যাবে।।আর যদি রাজি না হয় আমায় বলিস।।
-তোমাকে রাত্রে ফোন করে কনফার্ম করছি,সেই মতো টিকিট এর ব্যবস্থা করতে হবে।
-একদম
সবাইকে ফোন করে কনফার্ম করে নিলাম,সবাই রাজি কিন্তু কৃশানু দার অফিস আছে তাই একদিন পরে যোগ দেবে আমাদের সাথে।।কৃশানু দা এলাহাবাদ ব্যাংক এর ম্যানেজার রায়গঞ্জ এর ছেলে এখন ডালখোলা তে থাকে।।পম দা,মানে অনুপম দা আর হিরক দা বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মী দুজনেই রায়গঞ্জ এর ছেলে,পম দা কর্মসূত্রে আলিপুরদুয়ার এ থাকে,হিরক দা বাড়িতেই থাকে।।আর গুরুদেব মানে কুমারেশ দা আমাদের আদরের কুমু দা বোলপুর এ ব্যাংক এ কাজ করে,আর আমি ছাত্র তখন।।
14 র পুজো তে নবমী,দশমী একই দিনে পড়েছিলো,আমাদের টিকিট কাটা ছিলো নবমীর দিন সকালে কাঞ্চন জঙ্ঘা এক্সপ্রেস বোলপুর থেকে সকাল ৯ টায়,আমি আর কুমু দা চাপবো ওদের সাথে দেখা হবে ডালখোলা স্টেশনে,কৃশানু দা ওই দিন যাবে না পরের দিন আমাদের সাথে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে দেখা করবে।।আমি আর কুমু দা বাড়ি থেকে ব্যাগ গুছিয়ে অষ্টমির দিন দুপুরে চলে গেলাম বোলপুর,কুমুদার ভাড়া বাড়িতে।।সন্ধ্যেবেলা আমি আর কুমু দা মিলে বোলপুর শহরের ঠাকুর দেখলাম,যেহেতু কাল সকালে ট্রেন আর দুজনেই ঘুম থেকে দেরি করে উঠি তাই রিস্ক না নিয়ে তাড়াতাড়ি বিরিয়ানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম।।
আমার কাছে পাহাড় মানে অঞ্জন দত্ত,ছোটোবেলা থেকে নেশা বলতে অঞ্জন দার গান,আমায় পাহাড় ভালোবাসতে শিখিয়েছে অঞ্জন দার গান।।রাত্রে বেলা কানে হেডফোন নিয়ে কিছুখন অঞ্জন দার গান শুনলাম,ভেতরে ভেতর অদ্ভুত এক আনন্দ হচ্ছে আমার।।কিছুক্ষন গান শুনে ফোন চার্জে বসিয়ে এলার্ম দিয়ে চলে গেলাম ঘুমের দেশে।।
সকাল 6 টা বাজতেই এলার্ম এর শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো,বিছানায় আর একটু গড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়লাম।।জানি কুমু দা এখন ডাকলেও উঠবে না,তাই ওকে না ডেকে নিজের কাজকর্ম গুলো সব সেরে নিলাম।।৮ টায় কুমু দা কে ঘুম থেকে তুলে দিলাম,সময় গড়িয়ে যাচ্ছে,কুমু দা গড়িমসি করেই যাচ্ছে,চাপ দিচ্ছি আমি শুনছেই না,আমায় কিছুখন জ্ঞান দিয়ে দিলো।।সব কিছু রেডি করে তাড়াহুড়ো তে বেরোতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে কুমু দার ফোনের স্ক্রিন টা গেলো ভেঙে।।স্টেশন এসে শুনতে পেলাম স্টেশনের মাইক্রোফোনে ঘোষণা হচ্ছে--'অনুগ্রহ করে শুনবেন,13173 আপ কাঞ্চন জঙ্ঘা এক্সপ্রেস 2 নং প্লাটফর্ম এ আসছে'।।অবশেষে কুঝিকঝিক করে প্লাটফর্ম কাঁপিয়ে ট্রেন ঠিক সময়ে স্টেশনে প্রবেশ করলো,আমরা আমাদের সংরক্ষিত কামরায় প্রবেশ করলাম।।সিট খুঁজে নিয়ে বসে চায়ের লোক খুঁজছি,সকাল থেকে এক কাপ চা পেটে পড়ে নি।।দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি প্লাটফর্ম এর উপরে গরম গরম লুচি ভাজা হচ্ছে,লোভ সংবরণ করে নিলাম,কুমু দা বললো ট্রেনে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়া যাবে।।আমি গল্পের বই খুলে বসলাম,যে কোনো দূর সফরে গল্পের বই আমার সঙ্গী,এই বারে সুচিত্রা ভটচার্জের মিতিন মাসি সমগ্র নিয়ে এসেছি।।দেখলাম কুমু দা ফোনে চার্জ দিচ্ছে,আর সাথে সাথে সমানে ফেসবুক করে যাচ্ছে।।আমার পাশের সিটে দেখলাম তিনজন ভদ্রলোক রাজনীতি নিয়ে তর্ক জুড়েছে,মন গেলো একবার ওদের তর্ক আলোচনায় যোগ দিই,কিন্তু মিতিন মাসি আমায় টানছিলো,তাই কানে হেডফোন লাগিয়ে রহস্য উন্মোচনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।।
'সিঙ্গাড়া নেবে সিঙ্গাড়া,গরম গরম সিঙ্গাড়া আছে' দূর থেকে এক গলা পেলাম,আমি লোক টা কাছে আসতেই,দেখি কুমু দাও চলে এসেছে।।৪ টে সিঙ্গাড়া নেওয়া হলো সাথে চাটনি,কিন্তু চা তো আর পাচ্ছিলাম না,লোক টা কে বলতেই চা এর লোক টাকে সে ফোন করে আসতে বলে দিলো,গরম গরম চা চলে এলো।।এই দিকে কুমু দা ফোনে চার্জ দিতে যেয়ে খবর নিয়ে এসেছে বগির শেষ দিকে এক ভালো 'মামনি' আছে,তাকে ১০ এর মধ্যে ৭ না সাড়ে ৭ দেওয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই ট্রেন ঢুকে পড়লো সাইথিয়া,শহরের মায়া কাটিয়ে ঢুকে পড়লো গ্রাম আর ধানের মাঠ ঘেরা সেই আলো-আঁধারির মায়ারাজ্যে।।মনে হচ্ছে সেই কতো চেনা গ্রাম,পাখির নীড়ের মত চোখ না তুলেও যে নীরবে জিজ্ঞাসা করতে ভোলে না-'এতদিন কোথায় ছিলেন কাকা?'।ট্রেন চলছে ঢিমেতালে,হয়তো কুমু দা কে কয়েকটা ছবি তোলার সুযোগ করে দিতেই।।
'যেথায় সন্ধ্যে ছটার আগে
হাঁচতে গেলে টিকিট লাগে
দুচ্ছাই সেই শহর ছেড়ে
পালাচ্ছি সই অনেক দূরে
কুঝিকঝিক কুজিয়ে গাড়ী
দিচ্ছে অচিন রাজ্যে পাড়ি'--হঠাৎই কুমু দার ডাকে আনমনা ভাব টা কেটে গেলো-'খিদে পাচ্ছে রে,দুপুরে কি খাওয়া যায় বল তো?'ট্রেন তখন ফারাক্কা ব্রিজ পেরোচ্ছে।।'বিরিয়ানি খাবি?' কুমু দা আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।।আমি অনেক লোভ নিবারণ করে বললাম ওটা রাত্রের জন্য রেখো,এখন ফ্রায়েড রাইস খাও।।কুমু দা মেনে নিয়ে IRCTC থেকে অর্ডার করে দিলো।।পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে আমের বাগান,ঘরবাড়ি,সর্ষে ক্ষেত,ট্রেনের দিকে সকৌতুকে তাকিয়ে আছে গ্রামের ভাই বোন গুলো,আর এদিকে ট্রেন এর ভেতর গলা চড়ছে 'আমাদের রাজ্যে শুধু মালদা তেই ভালো আম চাষ হয় কেনো? এই অঞ্চলের আদিবাসী দের উন্নয়ন এর মডেল কি হওয়া উচিত,ম্যানুফ্যাকচারিং না সার্ভিসেস' এই সব নিয়ে তুমুল তর্কের মাঝেই হটাৎ করে আমি গল্পের বই টা বন্ধ করে বাইরের দিকে তাকালাম,মন টা কেমন কেমন করে উঠলো।।'যাহা গম ভি না হো,আসুঁ ভি না হো' গুনগুন করে উঠলো কে একজন।।পাশের কমপার্টমেন্টে অন্ধ ভিখিরির গলায় উঠছে ভাওয়াইয়ার সুর,ট্রেনের শব্দের সাথে মিলে সে এক অনবদ্য সারেগামাপা।।
মালদা টাউনে ট্রেন থামতেই খাবার চলে এলো,ফ্রায়েড রাইস,স্যালাড,আর সাথে আমার প্রিয় রায়তা।।ততক্ষনে সত্যিই পেটের মধ্যে ডুয়ার্সের হাতি ডন মারা শুরু করেছিল।।কাজেই খুব তাড়াতাড়ি খাবার উড়ে গেলো।।আমি হাত ধোওয়ার অছিলায় সেই 'মামনি' কে দেখেও চলে আসলাম।।ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে,পরের স্টেশন,এবং আমাদের গন্তব্য,আমার কাছের খুব খুব কাছের উত্তরবঙ্গ.....
[চলবে]