'আমরা এই বিশ্বের বুকে গড়বো রংমহল,
সৃষ্টির নবমন্ত্রে মোরা করবো দিনবদল..' - দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে চলি আমরা প্রত্যেক এ,একদিন নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠবে এই আশা নিয়ে আমরা এই পাঁচ জন এগিয়ে চলি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে।।আগের পর্বে বলেছিলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের গাইড নিতে হয়েছিলো,পোর্টার নিই নি তাই আমাদের যে যার ব্যাগ বইতে হচ্ছিলো,ব্যাগ কাঁধে নিয়ে শুরু করলাম আমাদের যাত্রা,কুমু দা কোথা থেকে একটা লাঠি জোগাড় করে আনলো ভর দিয়ে হাঁটবে বলে,শুরু হলো প্রকৃতির বুকে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এক বুক নিঃশ্বাস নিতে নিতে এগিয়ে যাওয়া।।
জঙ্গলের নিজস্ব একটা শব্দ আছে,কয়েকহাজার ছোট ঘন্টা যেনো কানের কাছে মিহিসুরে বেজে চলেছে।।শাহরিক রা সে শব্দ শুনতে পায় না ,জাঙ্গলিক রা অভ্যাসের দরুন সে ডাক বুঝতে পারে না,কিন্তু জঙ্গল যদি কখনো কোনো শাহরিক কে একা পায় ,দুর্বোধ্য ডুডু মন্ত্রের মত সে শব্দ তাকে আকর্ষণ করতে থাকে।।জঙ্গল তাকে ডেকে চলে,এসো,শুকনো পাতার উপর হেঁটে এসে দেখো,দেখো চাঁদনী রাতে জঙ্গলের এক প্রান্তে নাচে মেতেছে খরগোশের দল,চাকভাঙ্গা মধু খেয়ে মাতাল হয়েছে ভালুক,অর্জুন গাছের নিচে নিজের শেষ কয়েকটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে বুড়ি শেয়াল।।এসো এই মধু তোমার প্রাপ্য,এই নাচ তোমার প্রাপ্য,এই মৃত্যু তোমার প্রাপ্য।।এখানে হিংসা আছে,ঈর্ষা নেই,জরা আছে,মৃত্যু আছে,শঠতা নেই।।এসো,ভালো যদি নাও হতে পারো,অন্তত সহজ হও।।
'এই আমার শিক্ষা হয়ে গেলো,আগে থেকে ভালোভাবে সব না জেনে আর কোথাও আসবো না'-হাপরের মত হাঁপাতে হাঁপাতে কোনরকমে এই কয়েকটা কথা বললো কুমু দা,মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি শেষ কয়েকটা নিঃশ্বাস পরে যাবে,আমরা টেনশন এ পড়ে গেলাম সত্যি সে রকম কিছু হয়ে গেলে এত বড় লাশ টা নামাবো কি করে নীচে!! এক কিলোমিটার এর মতো হেঁটেছি তাতে অনেকের অবস্থা ঢিলে হয়ে গেছে,কারুর গায়ে জামা নেই,জলের একটা বোতল শেষ।।গাইড কে বলতে হিন্দি তে উত্তর দিলো আরো পাঁচশ মিটার পরে একটা চায়ের দোকান আছে,ওই খান থেকে জল পাওয়া যাবে কিনতে,সেটা শুনে সবাই বাংলা তে মধুর বাণী দিলো।।পাঁচ মিনিট করে হাঁটছি,কুড়ি মিনিট করে বসে পড়ছি,এই অবস্থা আমাদের,কিছুক্ষনের মধ্যে ওই চায়ের দোকান চলে এলো,আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি বসে,পম দার খিদে পেয়েছে,ম্যাগি খাবে বলে লাফাচ্ছে।।কাহিল হয়ে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে,সত্যি বলতে কি,এরকম একটা বিশ্রাম এর জায়গা না থাকলে আমাদের পাঁচজনের মধ্যে দু এক জনের রেস্ট-ইন-পিস অবস্থা হয়ে যেতো।।
যাত্রার শুরু টা ঠিকঠাকই ছিলো,শালবনের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ উঠে যাওয়া বাঁধানো রাস্তা,সবার মধ্যে টগবগে এনারজি,ঝামেলার মধ্যে সবার পিঠে একটা করে ভারী ব্যাগ।।পরে থাকা সোয়েটার,জ্যাকেট গুলো ও ধীরে ধীরে ঠাঁই নিচ্ছে আর ব্যাগ গুলো পেটমোটা হচ্ছে।।পম দা কোথা থেকে জানি না একটা ব্যাগ কুড়িয়ে এনেছে,যার চেন ছিঁড়ে যাচ্ছে,ফিতে খুলে যাচ্ছে,এমনিতেই সকাল থেকে খেতে দিই নি বলে ঝিমোছিলো,এই ব্যাগ এর দয়ায় প্রথম কয়েক মিনিট হেঁটেই হাঁসফাঁস শুরু করছে ছেলেটা।।
কিছুক্ষন পর থেকে সবার সমস্যা শুরু হলো,এক তো গাইড বাবাজি লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে,তার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে সবারই দম ফুরিয়ে যাচ্ছে,আর চড়াই এর কোনো শেষ নেই,এমনকি সামান্য সমতল কোথাও নেই।।কুমু দাও নেতিয়ে আসছে,খালিখালি ওর নিজের বয়স মনে পড়ে যাচ্ছে,কৃশানু দা শক্ত মুখ করে হেঁটে যাচ্ছে,আমারও করুন দশা,দুটো কারণে আমি বাহাদূর সেজে আছি,এক হলো আমার প্ল্যান এটা আর পাহাড় আমার ছোটবেলার সঙ্গী।।হটাৎ আমাদের গাইড বললো আমাদের যদি পোর্টার লাগে,তবে সামনে একজন আসছে,তাকে নেওয়া যেতে পারে,আমরা সবাই রাজি ছিলাম,কিন্তু সেই মুহূর্তে পম দার বিবেক জেগে উঠলো 'আমরা নিজের নিজের ব্যাগ বইতে হিমশিম খাচ্ছি আর এই একটা ছেলে অতগুলো ব্যাগ বইবে!!এতোটা নিজেরাই বয়েছি বাকিটাও বয়ে নেবো।।'আমাদের চোখের সামনে দিয়ে পোর্টার নেমে চলে গেলো।।কিছুক্ষন পরে বোঝা গেলো কত বড় ভুল হয়ে গেছে,হাঁফ ধরিয়ে আমরা নাকি মাত্র দু কিলোমিটার এসেছি,আরো অনেক পথ বাকি,সেটা শুনেই সবার মাথায় হাত পড়লো।।
দাঁতে দাঁত চেপে উঠছি,কুমু দা ক্রমাগত আমার চোদ্দ গুষ্ঠি তুলে খিস্তি মেরে যাচ্ছে,বাকিরাও নিশ্চয় মনে মনে করছিল,মুখে বলেনি।।তারপরের রাস্তা তো আরো খাড়াই,এতক্ষনে পাকা রাস্তা ছিলো কিছুটা,এখন শুধুই মাটি-পাথর,আমার তো একবার পা মচকাতে গিয়েও মচকালো না।।আমি সকালে কিনে আনা বাতাসা সবাইকে দিলাম,এই রকম খাটনীর সময় বাতাসা মুখে রাখলে কিছুটা এনারজি মেলে।।শ্বাসকষ্ট থেকে মুক্তি পেতে নাকের পাশে অমৃতারঞ্জন লাগিয়ে নেওয়া হলো,কিন্তু 'ক্রিমিনাল কেস' এর চেয়েও দ্রুতগতিতে আমাদের এনারজি শেষ হয়ে যাচ্ছিল,কৃশানুদা সিগারেট ধরাতে চাইছিলো,আমি অনেক কষ্টে নিরস্ত করলাম।।
শেষমেশ তিন কিলোমিটার এর মাথায় একটি সুন্দর ঝর্ণা দেখতে পেলাম,পম দা প্রথমে বললো স্নান করবো,আমরা প্রথমের দিকে রাজি ছিলাম না,পরের দিকে রাজি হয়ে গেলাম,সামনে একটা চায়ের দোকান,সিদ্ধান্ত হলো চা খেয়ে স্নান করবো।।চায়ের দোকানে বসে বসলাম,তাতে বেঞ্চ পাতা,বসেই মনে হলো যেনো অরগ্যাজমিক সুখলাভ করলাম।।সবাই অল্প চাঙ্গা হয়ে উঠছি।।পাশের পাহাড়ের আড়ালে সূর্য লুকোচুরি খেলছে,বাগানের গাছে রঙ-বেরঙ এর ফুল,হালকা হাওয়ায় ঘামে জবজবে শরীরে কাঁপন ধরাচ্ছে।।হীরকদা চনমনে হয়ে ছবি তুলছে একের পর এক,একটু পরেই ধুমায়মান কাপে চা হাজির হলো,চা র আমেজের সাথে সিগারেটের ধোঁয়া মেখে বেশ ফুরফুরে লাগা শুরু হলো।।
[চলবে]
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ-সিগারেট স্বাস্থ্যের পক্ষ্যে ক্ষতিকারক।।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ১০:১৭