"আপনি আমায় শিক্ষা দিলেন,আলো দিলেন হৃদয় জুড়ে..
যদি আবার ফিরে আসি,এই ভুবনে ফের জনমে..
আমি আপনার ছাত্র হবো,আপনি হবেন মাস্টার মশাই..
আমার প্রিয় মাস্টার মশাই.."।
আজ একজন শিক্ষাগুরুর কথা বলবো,যার কাছে আমি শিখেছি কিভাবে মানুষ হতে হয়।।আজ বলবো সেই শিক্ষাগুরুর কথা, যার সামনে আসলে শ্রদ্ধায় আপ্লুত আমার মাথা বিনয়ে নুয়ে আসতো।।আজ বলবো এমন একজন শিক্ষাগুরুর কথা, যার আশীর্বাদ আমার এই বড় হয়ে ওঠার পেছনে অনেক অবদান রাখে।।
এই শিক্ষাগুরুর কাছে আমি কোনোদিন পড়ি নি,আলাদা স্কুল ছিল তাই সেই ভাবে ক্লাস করা হয়ে উঠে নি।।ইচ্ছে ছিলো আমি চুপিসাড়ে যেয়ে একদিন ক্লাস করে আসবো ওই স্কুলে,কিন্তু সময় এর অভাবে এবং কেউ কিছু ভাববে সেই ভেবে আর কোনোদিন যাওয়া হয় নি।।আফসোস হয়,ওই স্কুলের বন্ধু দের মুখে শুনেছি উনি যখন ইতিহাস পড়াতেন ছাত্র ছাত্রীরা সব মন্ত্রমুগ্ধ এর মত শুনে যেতো।।ইতিহাস আমায় চিরকাল খুব কাছে টানতো,তার উপর কেউ যদি আবার গল্প এর ছলে ইতিহাস পড়াতেন,খুব খুব হিংসে হতো ওই স্কুলের ছাত্র দের উপর।।এই সেই শিক্ষাগুরু যখন কোনো ছাত্র হয়তো পয়সার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুনলে তার বাড়ি যেয়ে তাকে বলে আসতেন "তুই স্কুল চল,তোর লেখাপড়ার সব দায়িত্ব আমি নিলাম"।।এই সেই শিক্ষাগুরু যিনি ক্লাসে কোনো ছেলে পরীক্ষায় ফেল করলে,হয়তো সে আর পড়াশোনা টা চালিয়ে যেতে পারবে না,সেটা শুনে তার বাড়ি ছুটে চলে যেতেন।।আমার মনে আছে মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর যদি কোনো ছেলে স্কুল না আসতো হয়তো সেই ছেলে স্কুল আসার থেকে বাড়িতে বাবাকে চাষ সাহায্য করছে শুনলে সটান তার বাড়ি হাজির কান ধরে তাকে ভালোবেসে স্কুল নিয়ে আসতেন।।এই সেই শিক্ষাগুরু যিনি জীবনের অনেক টা সময় স্কুল এর কি করলে ভালো হবে সেটা নিয়ে ভাবতেন,আজকাল এর যুগে এই রকম শিক্ষাগুরু পাওয়া যায় না বলতে গেলেই চলে।।সেই শিক্ষাগুরুর নাম আজো আমাদের মনের মণিকোঠায় রয়ে যায়,দেশ বিদেশের অসংখ্য অগুনতি ছাত্র ছাত্রীরা এখনো বলে উঠে আমরা "সাধন বাবুর" স্কুল এর ছাত্র বা ছাত্রী।
শিক্ষার জগৎ এর বাইরে উনার একটা মানবিক দিক ছিল,ভাবতেন নিজের মতো করে কিভাবে এই অজ পাড়া গ্রামে মানুষের উন্নয়ন করা যায়।।নিজের মস্তিক প্রসূত এক গাছ এর বাগান তৈরি করেছিলেন,অনেক প্রান্তিক মানুষ এর রুটি রোজগার এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।।আমার বাড়ির সাথে সু সম্পর্ক এর দরুন আমি জেঠু বলতাম,অনেক বার জেঠুর কাছে উনার বাগান বাড়ি গেছি,হাতে করে আমায় এবং আমার বন্ধুদের গাছ চিনিয়ে ছিলো।।
ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করতে গেলে জেঠু আমায় খুব ভালোবাসতো,ছোট থেকেই দেখে আসছে।।আমি অন্য স্কুলে পড়তাম,আমি জীবনে আমার ক্লাসে কোনোদিন ফার্স্ট হতে পারি নি,সব সময় থার্ড হতাম,একটা ঘটনার কথা মনে আছে আমি তখন ক্লাস ৮ এ পড়ি,স্কুলে রেজাল্ট বেরিয়েছে আমি যথারীতি থার্ড হয়েছি(আমাদের ক্লাসে তখন ভালো কমপিটিশন হতো),আমি রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি আসবো বলে বেড়িয়েছি জেঠু কোনো এক কারণে সেই দিন আমাদের স্কুলে গিয়েছিলো,আমায় দেখতে পেয়ে দূর থেকে ডাকলো বললো রেজাল্ট কি হয়েছে,বললাম মার্কশিট দেখলো,পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিল সাবাস "অমর বাবু(আমার মামা দাদু)র নাম রেখেছিস" বলে একটা মিষ্টির প্যাকেট বের করে দিয়েছিলো এবং বলেছিল এটা তোর ভালো রেজাল্ট এর গিফট।।মাধ্যমিক এর টেস্ট এর পরে আমার ইতিহাস আর ভূগোল এর টেস্ট পেপার এর খাতা আমি করে পাঠাতাম জেঠু চেক করে ঠিক আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিতো।।রাস্তায় দেখা হলেই গাড়ি দাঁড় করিয়ে ঠিক খবর নিতো আমার পড়াশোনার।।
ক্লাস 11 এ পড়ি তখন,আমি মামাবাড়িতে গাজন দেখতে গেছি হটাৎ করে খবর আসে জেঠু আর নেই।।চোখের সামনে আকাশ ভেঙে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল আমার,এক ছুটে সাইকেল নিয়ে চলে গিয়েছিলাম জেঠুর বাড়ি।।মন ভারাক্রান্ত অবস্থায় সেদিন বাড়ি এসেছিলাম।।জানি আমার সেই শিক্ষাগুরু,আমার সেই প্রিয় জেঠু আর হয়তো ফিরবেন না আমাদের মাঝে,মানুষের মাঝে।।জেঠুর আদর্শ কে জীবনে পাথেয় করে যদি চলতে পারি,সেটাই আমার কাছে বড় পাওনা।।এখন ভেসে আসে কানে সেই নম্রতা মাখা স্বর,যে পথ আপনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন সেই পথের দিকেই চলছি অবিরাম ভাবে চলবো আপনার দেখানো পথে,যেই খানেই থাকুন আপনি ভালো থাকুন,সেই খান থেকেই স্নেহ মাখা হাত নিয়ে আশীর্বাদ করে বলে উঠুন "বড় হ তোরা,মানুষের মত মানুষ হ"।।
পুনশ্চ:-আজ শিক্ষক দিবস উপলক্ষে আমার প্রিয় শিক্ষক এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৩৩