somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও পরিণাম (দ্বিতীয় পর্ব)

২৩ শে জুন, ২০১২ বিকাল ৫:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[Parental control: Violence. ১৬ বছরের নিচে ও গর্ভবতীদের জন্য গল্পটি নিষিদ্ধ]
প্রথম পর্ব
আমি আমার আত্মার কাছে পরাজিত হলাম। আমি পিছিয়ে গেলাম কয়েক কদম। মহিলার শিয়রে শুয়ে থাকা শিশুটিকে কোলে তুলে নিলাম। দ্রুত এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনে হাটতে থাকলাম। আমার মাথায় এখন একটিই চিন্তা__যদি ধরা পড়ে যাই, যদি এই মুহুর্তে মহিলার ঘুম ভেঙ্গে যায় তাহলে কি রকম পরিবেশের সৃষ্টি হবে তা কল্পনা করতে পারলাম না। মূলত চুরির কারণে অনাগত ভবিষ্যতে কল্পনা করতে করেই আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। অথবা আমি যদি চলে যাবার পর মহিলার ঘুম ভাঙ্গে তবে সে সময় কি ঘটবে ধারণা করাটা খুব একটা কঠিন কিছু হবে না। তখন মহিলাটির শুধু পাগল হওয়ারই বাকি থাকবে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
একাজ কেন করছি এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা তখন মাথায় আসেনি। আমার স্পষ্ট আমি স্বপ্ন দেখছিলাম চমৎকার এক ভবষ্যতের। স্বামী-সন্তান ও সংসারের। কিন্তু আমি জানি সব সুখ স্বপ্ন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়ও না, আমারটিও হয়নি।
গেটের কাছে ও্যার্ডবয়ের উনিফর্ম ধারী একজন দাড়িয়ে আছে। কুতকুতে চোখে এতক্ষণ আমাকেই দেখছিলো। গাইনী ওয়ার্ড পেরিয়ে এসেছি অনেক আগেই, কাজেই লোটার জানার কথা না যে আমার কোলাএর বাচ্চাটি চুরি করা। এই সমস্যার মোকাবিলা কিভাবে করবো বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের অজান্তে হাটার গতি মন্থর হয়ে এলো।
আমি কাছে আসতে লোকটা হেসে উঠলো, যেন শিকার হাতের মুঠোয় পেয়েছে। লোকটার হাসিটা পরিচিত একটা প্রাণীর কাছাকাছি খুব একটা ভয়াবহ না। হাসির মার্কা ভাবাবেগ শুন্য মলিন যেন হাসি দেওয়াটাই তার কাজ।
‘আফা কি অহনই রিলিজ পাইলেন?’
‘হ্যাঁ’ এক হাতে বাচ্চাটাকে ধরে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলাম আমি। তারাহুরো করে চলে আসতে চাইলাম কিন্তু লোকটা পথ আগলে দাঁড়ালো। তার চেহারা লাল হয়ে উঠতে দেখলাম আমি। আমার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকলো না যে ব্যাটা তার বখশিস চাইছে নিস্তব্দে।
আমার মনে হলো মাউন্ট এভারেস্ট আমার বুকের উপর থেকে নামিয়ে রাখা হলো, নইলে বুকটা এত ভাড়ি লাগছিলো কেন? বাচ্চাটার দিকে তাকালাম। বাচ্চাটা তখনও ঘুমুচ্ছে। নব-জন্মানো শিশুটির মুখে তখনও রক্তের লালচে ভাবটা লেগেছিলো।
পার্স খুলে লোকটাকে একশো টাকা বের করে দিলাম। আর বাচ্চাটাকে নিয়ে বীরদর্পে হেঁটে চলে এলাম। শেখ সাদীর গল্পটা মনে পড়ে গেলো। ভালো জামা-কাপড়ের জন্য তিনি এক দাওয়াতে ঢুকতে পেরেছিলেন। আমার সাথেও একই ঘটনা ঘটেছে। আমার আভিজাত বেশ দেখে ইমার্জেন্সি গেটের দারোয়ান অন্য কিছু সন্দেহ করে নি।
বাহিরে বেরোতেই বৃষ্টির পানি আমাদের দুজনকে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। সাথে ছাতা থাকায় বৃষ্টির পানি আমাদের সাথে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছিলো না। ততক্ষণে বাচ্চাটার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে জুড়ে দিয়েছে গগণবিদারি কান্না। কান্নাথামানোর উপায় জানা নেই আমার। আমার যতটুকু মনে পড়ে কোলে নিয়ে একটু দোলা-দুলি করলে বাচ্চারা কান্না থামিয়ে দেয়। কিন্তু এই রাস্তার মাঝখানে সেটা সম্ভব না।
বৃষ্টির মাঝে কোন রিকশা দেখা যাচ্ছে না, ট্যাক্সি ক্যাবও নেই। যে এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকবো। তাছারা অপেক্ষা করাটা উচিত হবে না। বৃষ্টির ভেতরেই বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে হাটতে শুরু করলাম আমি। বৃষ্টির ছাপট এসে আমার শাড়ির নিচের অংশ ভিজিয়ে দিচ্ছে, ফলে হাটার সময় শাড়ি পায়ের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে সাবধানে হাটতে হচ্ছে যেন শাড়ি পায়ের সাথে বেঁধে পরে না যাই।
শশুর বাড়িতে রাত সাড়ে আটটায় পৌছালাম। আমার কোলে বাচ্চা দেখে সাবাই নিজেরদের মধ্যে গুজবে মেতে উঠলো। শুরু হলো আমার উপরে এবার প্রশ্ন বৃষ্টি। সারাজীবনে একদিনে এত প্রশ্নের সম্মুখীন আমি হইনি। সব যোগ করলেও আমার সারাজীবনের সম্মুখীত হওয়া প্রশ্নের সমান হবে না। আমার মনে আছে প্রশ্ন গুলো ছিলো।
‘বাচ্চা কার?’
‘কোথায় পেলে?’
‘তোমার?’
‘রাস্তার কোথাও পড়েছিলো নাকি?’
‘কেন ওকে আনলে?’
‘উত্তর দিচ্ছো না কেন?’
ইত্যাদি, ইত্যাদি! আমি ওদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে ওদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর আমি দিবো, তবে আমাকে একটু সময় দিক তারা। আমি শান্ত হয়ে নিই। আমি এখন প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে আছে, কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমাকে যেন জুড়ি বোর্ডে তোলা হয়েছে। জবাব এখন দিতেই হবে।
অবশেষে সমস্ত ব্যাপাটা ওদের সাথে মেলে ধরলাম আমি। শ্বশুর বাড়ির লোক-জন এতটায় অবাক হলো যে, আমি যিদি অন্য কারো হাত ধরে ওদের ছেলেকে ফেলে পালিয়েও যেতাম তাহলেও ওরা এত অবাক হতো না। এমন কোন নেতিবাচক বিশেষণ বাকি থাকলো না যার দ্বারা আমাকে ভূষিত করা হলো না। আমি তো ভেবেছিলাম এ রাতেই বুঝি বাড়ি থেকে বের করে দেবে আমাকে। কিন্তু ইমরানকে বাসায় ফোন করে ডেকে আনার পর ব্যাপারটা আর বেশিদূর এগোলো না। ইমরান স্বাভাবিক ভাবেই নিলো ঘটনাটা। এবং অদ্ভুত হলেও সত্য সে আমাকে সমর্থনও করলো। আমি ভেবেছিলাম বোধহয় এবার জীবনে আমার পূর্ণতা এলো কিন্তু আমি ভূল ছিলাম।
দুই মাস পর
সময়ের সাথে সাথে ঘটনাটা পরিবারের জন্য একতা ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি করলো। তারা নিজেরাই বাচ্চাটার নাম দিলো পিয়াশা। নামটা ইমরানেরই ঠিক করা। একটা পরিবারে একটি সন্তান যেমন পরিবারটির প্রাণ হয়ে উঠে পিয়াশার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটলো। স্বামী, সন্তান, শ্বশুর-শাশুরী, ননদকে নিয়ে বেশ আনন্দেই কাটছিলো দিনগুলো। জীবনটা যেন রুপকথার মতো সুন্দর হয়ে এলো। মনে মমে যে ধরনের সংসার এত দিন সাজিয়ে এসেছি, সংসারটা আমার প্রত্যাশারও অনেক উর্ধ্বে এসে পৌছেছে। আমার মনে হচ্ছিলো কেউ বুঝি একটা যাদুর ছড়ি আমার হাতে এনে দিয়েছে যা আমি ঘুরাচ্ছি আর অমনি আমার পৃথিবী বদলে যাচ্ছে আমার মতো করে। আমি অনুভব করতে থাকলাম এটাই আমার জীবনের সবচাইতে বড় সফলতা ও বড় পাওয়া। এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো শ্রষ্ঠার কাছে আমার আর বুঝি কিছুই চাওয়ার নেই। কিন্তু পাঠক আপনিই বলুন মানুষের কি চাওয়ার শেষ আছে?
সুখের ষোলকলা পূর্ণ্য হলো যখন আমি বুঝতে পারলাম আমি গর্ভবতী। এ কথা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে যেন উৎসব শুরু হয়ে গেলো। সবার কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু ভালোবাসা পেতে থাকলাম। প্রথম প্রথম ভেবে ছিলাম ইমরানের নেতিবাচক সাড়া পাবো। কিন্তু সে দেখি আমার থেকেও বেশি খুশি। নিজেকে তার কাছে ছোট মনে হতে লাগলো। শুধু-শুধুই এতদিন তাকে আমি দোষারোপ করে আসছিলাম। ইমরানের এই আচরণ দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। আমার ধারণা আছিলো আমার স্বামীর কাছে আমার শরীর ও মনের এ দুয়ের মাঝে শরীরটাই বেশি প্রয়োজন। এই ধারণা যে ভুল ছিলো তা তো এখন বুজতেই পারছি।
যে দু-একটা হালকা-পাতলা কাজ করতাম আমার শশুর বাড়ির লোকজন এখন সেটুকুও আমাকের করতে দিতে নারাজ। যেন কিছু করলেই ক্ষতি হবে আমার অনাগত সন্তানের। যা আমার প্রত্যাশার থেকে বেশি।
এরই ভেতরে একরাতে স্বপ্নে দেখলাম আমি মা হয়েছি। সুন্দর একতা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে আমার। সে রাত থেকেই কেন জানি এক প্রকার দুশ্চিন্তা ঢুকে গেলো আমার চিন্তা-চেতনায়। আমার ভয় হতে লাগলো মেয়েটা যদি অন্ধ হয়, কিংবা প্রতিবন্ধী হয়, পিয়াশার মত যদি সুন্দর না হয়। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অশ্বস্তি অনুভব করতে থাকি। সে সময়টা বুকটা কেমন যেন খালি খালি লাগতে শুরু করে। যেন ভেতরে কিছুই নেই। শুন্য, ফাঁকা, অন্ধকার। শরীরে শক্তির অভাব অনুভব করি। প্রাচীন ভারতীয়দের উপরে আমার রাগ লাগতে শুরু করলো। ব্যাটারা কেন যে শুন্য আবিষ্কার করতে গেলো! অঙ্ক শাস্ত্রের সংখ্যা হীন শুন্য আর বুকের ভেতরে অনুভূতিহীন শুন্যতা একই বিষয়। আমার অনুভূতি আসে বাচ্চাতা যদি যৌনাঙ্গ ছাড়া জন্ম নেয়, কিংবা কোন অঙ্গ ছাড়া বা অতিরিক্ত কোন অঙ্গ নিয়ে। আমি দিব্য চোখে দেখতে থাকি একদল কালো ছায়া সবসময় আমাকে ঘিরে রেখেছে। যেন শুভ কিছু হতে দেবেনা। ভালো কিছু ঘেঁষতে দেবেনা আমার কাছে।
সেদিন রাতে আমি আর ইমরাণ শুয়ে ছিলাম বিছানায়। মাঝ রাতে হটাৎ অনুভব হতে অনুভব হতে লাগলো আমার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে পরে আছি। শরীরের কোন অঙ্গ আমি নারাতে পারছি না চোখ দুটো ছাড়া। বেশ অবাকই লাগলো ব্যাপারটা। কে জানতো আরো বিশ্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য। দেখলাম দোলনা থেকে নেমে পরেছে পিয়াশা। এতটুকু বাচ্চা কিভাবে দোলনা থেকে নামতে পারে আমি বুঝতে পারলাম না। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমাদের বিছানার দিকে। আমি উঠে বসতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। বিছানার পার্শ্বে ঠিক আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়েছে পিয়াশা। মুখে তার হাসি। হাসিটাতে আশুভ কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। ওর হাত উঠে আসছে আমার উরু সন্ধিতে। ধীরে ধীরে গোপন ও স্পর্শকাতর একটা রাস্তা দিয়ে পৌছাতে চাইছে আমার গর্ভের ভেতর, শরীরের ভেতর। আমার মনে হতে লাগলো আমার বুকের উপরে কেউ যেন হাতুরি পেটাতে লাগলো। শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যায় করেও এক চুলও নড়তে পারলাম না। হৃদপিন্ডটা বুঝি পিংপং বল হয়ে গেছে। সেটা ভয়ে না উত্তেজনায় এমন অবস্থায় সে আলোচনা নিস্প্রয়োজন। মনে হচ্ছে প্রখর রোদ্রে এখনই দু’মাইল সর্বচ্চ গতিতে দৌড়ে এসেছি।
আমি লক্ষ্য করলাম আমার কাপড়-চোপড় রক্তে ভিজে উঠেছে। পিয়াশা যেন আমার গর্ভের সন্তানকে গর্ভমুক্ত করতে চায়ছে। গলা চিরে যায় এমন একটা চিৎকার করলাম, যেন সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠে। কিন্তু বিধি বাম। গলা দিয়ে কোন আওয়াজও বেরুলো না।
অনুভব করলাম পিয়াশার হাতটা আমার গর্ভথেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে। তীব্র ব্যাথা অনুভব করার কথা আমার, কিন্তু কোন ব্যাথা পাচ্ছি না কেন আমি? পিয়াশা তার হাত বের করে এনেছে। ওর হাতটা রক্তে মাখা-মাখি হয়ে আছে, আর হাতের তালুতে একটা রক্তাক্ত মাংশ পিন্ড। আবার চিৎকার করতে চাইলাম আমি। এবার আগের থেকে বেশি শক্তি লাগালাম। কিন্তু কিছুই হলো না।
ভালো করে লক্ষ্য করলাম আমি পিয়াশার হাতটা। তার হাতের মাংশপিন্ডটা আসলে একটা মানব শিশুর মাথা। সাথে শরীরের বাকী অংশগুলো কিছুটা আমার গর্ভে আর কিছুটা ওর হাতে। হটাৎ করেই আমার অনাগত সন্তানের মাথাটা মেঝেতে ফেলে দিলো পিয়াশা, সাথে সাথে অপরিনত সন্তানটি আমার গর্ভথেকে বের হয়ে গেলো। এবার পিয়াশা চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো।
ঠিক এই সময় আমি অনুভব করলাম আমার শরীরের অসাড়তা করে গেছে। তীব্র একটা চিৎকার বের হয়ে এলো আমার গলা চিড়ে। চোখ মেলে তাকালাম কিন্তু নড়তে পারলাম না।
পিয়াশা দোলনায় শুয়ে কাঁদছে। পিয়াশার কান্নার শব্দেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সস্তি পেলাম এই ভেবে যে আমার চিৎকারে কারো ঘুমের কোন অসুবিধা হয় নি। অথচ আমি এতক্ষণ চাচ্ছিলাম সবাইকে ঘুমথেকে জাগিয়ে তুলতে। যদিও সেটা ছিলো স্বপ্নে। মানুষ খুব আশ্চর্যজনক একটা প্রানী। ঘুমিয়ে থেকে আশা করে এক আর ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর আশা করে অন্য কিছুর।
বিছানায় শুয়ে থাকলাম আরো কিছুক্ষণ আর বোঝার চেষ্টা করলাম স্বপ্নটা। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমার গর্ভের সন্তানকে পিয়াশা চায়না। ওর পক্ষে না চাওয়াটাই স্বভাবিক। ওর আকর্ষন ও গুরুত্ব দুটোই যে আমাদের সবার কাছে কমে আসছে এটা তার অতন্দ্র সত্তা ভালোই বুঝতে পেরেছে। আর চায়না বলেই স্বপ্ন হয়ে আমার কাছে এসেছিলো সে।
পিয়াশা তখনও কেঁদে যাচ্ছিলো। আমার বিরক্তভাবটা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো আমি বিছানা থেকে উঠে বাচ্চাটাকে আদর বা দুঁধ দেওয়া বাদ দিয়ে মারতে শুরু করলাম। আমি জানতাম এতে সে আরো কাঁদতে শুরু করবে, পিয়াশার কান্না আমাকে এক ধরনের পাশবিক প্রশান্তি দিচ্ছিলো। ওর সাথে আমি ওর চিৎকার বনাম আমার আঘাতের একটা খেলা শুরু করলাম। ও যত চিৎকার করছিলো আমি ততই ওকে আঘাত করছিলাম।
‘ওকে মারছো কেন?’ বিছানা থেকে জিজ্ঞাসা করলো ইমরান।
‘কাঁদছে তাই’
‘কাঁদছে তাই বলে মারতে হয়?’ বিছানা থাকে উঠে এসে আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিলো ইমরান, বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে শুরু করলো সে।
আমার সাথে পিয়াশার দ্বন্দের এটাই ছিলো শুরু। পিয়াশার শত মাতৃ অভাব থাকা সত্বেও আমি ওর থেকে এড়িয়ে চলতে থাকলাম। ইচ্ছে করে ওর নিয়মিত শাল খাবার দেওয়া থেকে বিরত থাকলাম আমি। এটা প্রথম বাড়ির অনেকেই খেয়াল করেনি কিন্তু যখন খেয়াল করলো তখন তারা অনেক দেড়ি করে ফেলেছিলো।
সে যাই হোক পিয়াশা আমার শত্রু হয়ে গেছিলো পুরো দমে। আমি ওর থেকে যত দূরে সরে থাকতে লাগলাম সে ততই আমার স্বপ্নে এসে হাজির হলো। ধীরে ধীরে পিয়াশা দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করলো আর কমে আসতে লাগলো আমার রাতের ভয়াবহ সব স্বপ্নগুলো। আমার চারপাশে ঘিরে থাকা কালো ছায়া গুলোও আমি এখন আর খুব একটা দেখতে পাইনা। আমার মনে হতে থাকে হাসপাতালের বাড়ান্দা থেকে চুরি করে নিয়ে আসা আশুভ প্রেতাত্মাটা আমাকে ধীরে ধীরে মুক্তি দিচ্ছে।
আমার গর্ভের সন্তান আমার গর্ভে বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। আমি যেন তার হৃদকম্পন অনুভব করতে পারছি। আমার সন্তান পরিপুর্ণ হচ্ছে আমার ভিতরে। আমার সাথে, আমার ভালোবাসায়। আমি অনুভব করছি মাতৃপ্রেম, কর্তব্য, ও দায়। কি ভাবতে হয় ভাবতে হয়না, কি করতে হয় আর কি করতে হয় না। কি গ্রহন করতে হয় আর কি বর্জন করতে হয়। এসব কিছু আমি শিখতে লাগলাম ধীরে ধীরে। সব যেন অদৃশ্য কোন সত্তা আমাকে শিখিয়ে দিচ্ছে পরম মমতার সাথে।
প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমন ও বীপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে; তা বৈষয়িক আর অপার্থিব যাই হোক না কেন। এ কথা আমি যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার সুখ কর্মের দুঃখ প্রতিক্রিয়া ভোগ করছিলো পিয়াশা আর সেটা সবার অজান্তে। ওর বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুর সিন্ধান্ত মন আমাকে নিইয়ে দিয়েছে তা বুঝতে আমার সময় বুঝি একটু বেশিই লেগে যায়। কিন্তু যখন আমি আর আমার পরিবার তা বুঝতে পারি আগেই বলেছি অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম আমরা।
পিয়াশার রুগ্ন অবস্থা দেখে বাধ্য হয়ে ইমরান তাকে ক্লিনিকে স্থানান্তর করে। ডাক্তার বাচ্চাটিকে দেখে বললেন ‘একে কি সুদানের কোন শরনার্থী শিবির থেকে তুলে আনা হয়েছে কিনা।’
সাথে সাথে পিয়াশাকে ভর্তি করিয়ে শরীরে স্যালাইন পুশ কতা হলো। আমি অবাক হলাম; কেন পিয়াশাকে ভর্তি করাতে হবে, ওর এমন কি হয়েছে যে ওকে ভর্তি করাতে হবে।
ডাক্তার জানালেন শিশুটি জন্মের পর থেকে পর্যাপ্ত শাল দুধের অভাবে যথেষ্ঠ পুষ্টি পায় নি। তাছাড়া তারা যে যে সমস্থ রিপোর্ট পেয়েছেন তাতে মনে হচ্ছে শিশুটি খাদ্যহীনতারও শিকার। বাচার আশা খুবই কম। আমি বুঝলাম পিয়াশাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ফল এটি। সামগ্রিক যত্নের অভাবে আজ ওর এই দশা। কিন্তু এতে আমার কিছু করার নেই। আমার মনের সেই পাপিষ্ঠ যেন এটাই চায়ছিলো। বিশ্বাস করুন পাঠক আমার মনে তখনও কোন অপরাধ বোধ সৃষ্টি হয়নি। আর এটাই আমার অপরাধ কিনা কে জানে। আমি বুঝতে অক্ষম আমি কোনদিনই এতটা আবেগ প্রবণ ছিলাম না।
পিয়াশাকে প্রথম দিনই দুটো স্যালাইন দেওয়া হলো, এতটুকু বাচ্চাকে এতগুলো স্যালাইন দেওয়া হয়েছে শুনে অবাকই লাগতে পারে কিন্তু পরদিন ওর লাশ যখন আমার শশুর বাড়িতে এসে পৌছলো তখন আমি বুঝতে পারি পিয়াশার জন্য চিকিৎসাটা যথেষ্ঠ ছিলো না। সেদিন বাড়িতে শোকার্তময় একটা অবস্থা। ইমরানের চোখ আমি প্রথম ভেজা দেখলাম, কিন্তু ক্ষোভ, কষ্ট নাকি ব্যার্থতার এটা ধরতে পারলাম না। পারার কথাও না কারণ আমি মনোবিশেষজ্ঞ নই। যারা মনো বিশেষজ্ঞ তারা হয়তো বলতে পারতো তার চোখে এটা কিসের অশ্রু।
আশ্রু ছিলো আমার চোখেও, কিন্তু কষ্ট কিংবা সহমর্মিতার ছিলো না। সেটা ছিলো জয়ের, কিছু একটা সম্পুর্ণ নিজের বলে পাবার। কোন জঞ্জালকে চিরদনের মত ফেলে দেবার। যেন আমি কোন অশুভকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি চিরতরে। অথচ এই বাচ্চাটাকে আমি কতই না ভালো বাসতাম, আমার হাত ধরেই নতুন একটা পরিবারে, নতুন একটা পরিবেশে আর নতুন একটা জীবন পেয়েছিলো সে। তাকে চলে যেতেও হলো আমার জন্যে। আমার মনের একটা সত্তা বলছে পিয়াশার মৃত্যু ওর আর আমার দুজনের জন্যই ভালো কোন পরিনাম বহন করছে, কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।
চলেবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:০০
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×