কারবালার ঘটনা আমাদের সবারই জানা। কিন্তু আজ ব্যাক্ত করবো কারবালার পরের ঘটনা। কি হয়েছিলো ইমাম হুসাইনের কারবালার প্রান্তরে মৃত্যুর পর। ইমাম পরিবার কি মু’আবিয়ার পরিবারকে ক্ষমা করে দিয়েছিলো? নাকি এর প্রতিশোধ নিয়ে ছিলো? সেই উপাখ্যানই ব্যাক্ত করবো আজ। যা কট্টরপন্থি শিয়াদের গাত্রদাহের কারণ হবে।
কারবালার ঘটনার প্রেক্ষাপট হজরত মুহাম্মদ (সা) প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হাসান (রা) হজরত আলীর মৃত্যুর পর মিসর ও সিরিয়া ছাড়া অন্যান্য সমস্ত অঞ্চলের খলিফা বলে স্বীকৃত হয়েছিলেন। অপরদিকে জেরুজালেমের মসজিদে মু’য়াবিয়া নিজেকে ইসলাম জগতের খলীফা বলে ঘোষনা করেন। কিন্তু ছয় মাস পরই ইমাম হাসান সেচ্ছায় মু’আবিয়ার আনুকূলে খিলাফাৎ পরিত্যাগ করে সপরিবারে মদীনায় বসবাস শুরু করেন ৪০ হিজরীতে।
এই ঘটনা সম্পর্কে মহানবী (সা) ভবিষ্যত বানী করেছিলেন ‘আমার মৃত্যুর পর খিলাফাৎ ত্রিশ বছর স্থায়ী হবে, তারপর মুসলিম বিশ্বে সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হবে।’ এই হাদিস অনুসারে ইমাম হাসানের খিলাফাৎ লাভের ছয় মাস পরে ‘খিলাফাতের ত্রিশ সময় কাল বছরপূর্ণ হয়।’ সরল হৃদয় হাসান মু’আবিয়ার কাছে নিম্ন লিখিত শর্তে খিলাফাৎ পরিত্যাগ করেছিলান।
১। মু’আবিয়া হাসানের পক্ষে খিলাফাতের দ্বায়ীত্ব পালন করবেন
২। মু’আবিয়া কাউকেও পরবর্তী উত্তরাধীকারী মনোনীত করতে পারবেন না।
৩। মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর হাসানের কনিষ্ঠ ভাই হুসাইন খিলাফাৎ লাভ করবেন।
৪। হাসানের পারিবাক ব্যায়ের জন্য কুফার রাজকোষ থেকে বার্ষিক পঞ্চাশ দিরহাম নিয়মিত হারে বৃত্তি প্রদান করবেন।
মু’আবিয়া শর্ত সমূহ স্বীকার করে পারস্যের একটি জিলার রাজস্ব ইমাম হাসানকে অতিরিক্ত প্রদান করতে অঙ্গীকার করলেন। (Vide- Hitti’s History of the Arabs-P.190)
কিন্তু সমস্যার শুরু হয় ৪৯ হিজরীতে (৬৬৯ খীষ্টাব্দ) ইমাম হাসান ৪৭ বছর বয়সে মদীনা শহরে শত্রু কতৃক বিষ প্রয়োগে নিহত হন এবং তাকে জিন্নাতুল বাকি গোরস্থানে দাফন করা হয়। শিয়া সম্প্রদায়ের ধারনা ও স্থির বিশ্বাস মু’আবিয়ার ষড়যন্ত্রেই তিনি নিহত হন। (Ibid-p190)
আর ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইমাম হুসাইন উমাইয়াদের বুরুদ্ধে যুদ্ধের ডাক দেন। যা একদম কল্পনা প্রসূত ছাড়া আর কিছুই না। হাসানের মৃত্যুর প্রায় ১০ বছর পর ইমাম হুসাইন নিহত হোন।
খ্রীষ্টাব্দ ৬৭৬ ও হিজরী ৫৭ সনে খলীফা মু’আবিয়া স্বীয় পূত্র ইয়াযিদকে সম্রাজ্যের ভাবী উত্তরাধিকারী বলে ঘোষনা করেন এবং প্রাদেশিক শাসককর্তা ও রাজ্যের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিগনকে কৌশলে ইয়াযিদের আনুগত্য স্বীকার করতে প্ররোচিত করেন। ইসলামের সনাতন নির্বাচন প্রথার বিরুদ্ধচারন ও ইমাম হাসানের সঙ্গে প্রতিশ্রুত সন্ধিশর্ত ভেঙ্গে ফেলায় ইমাম হোসেন, আবু বক্কর (রা) এর পুত্র আব্দুর রহমান, খলীফা উমরের পুত্র আব্দুল্লাহ এবং আব্দল্লাহ ইবনে যুবাইর মু’আবিয়ার কাজের প্রতিবাদ জানান। মু’আবিয়া একহাজার সৈন্য সহ মদীনা এবং মক্কা গিয়ে বিদ্রোহী নেতৃবর্গকে বাধ্য করার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু অন্য কারনে তাকে অচিরেই দামিস্ক ফিরে আসতে হয়।
৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে উমাইয়া বংশীয় প্রথম খলীফা দামেস্ক নগরে প্রাণ ত্যাগ করেন। তার পুত্র ইয়াযিদ সিংহাসনে আরোহন করেন। অপর দিকে সন্ধিশর্ত অনুযায়ী ইমাম হুসাইন খলীফা পদ দাবী করেন। ইয়াযিদের নাচ-গান ও মদ্যপান ছিলো তার দৈননন্দিন কাজ। আবু কায়স্ নামের তার এক পোষা বানরের সঙ্গে পালাক্রমে তিনি মদ পান করে আমোদ উপভোগ করতেন। ঐ বানরকে সুন্দর পোষাকে সাজিয়ে, গাধার পিঠে বসিয়ে তিনি রাজপথে অশ্বারোহন করতে ভালোবাসতেন। একারনেই ইরাকবাসীরা তাকে খলীফা হিসেবে মনতে নারাজ হয়।(Vide- Hitti’s History of the Arabs-P.227)
ইরাকবাসীর সমর্থনে আশ্বাস পেয়ে ইমাম হুসাইন (রা) সপরিবারে মদীনা থেকে ইরেকের রাজধানী তৎকালীন কূফা যাত্রা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা মরুভূমিতে পথ হারিয়ে কূফার পচিশ মাইল দূরবর্তী ‘কারবালা’নামক স্থানে উপস্থিত হলে ইয়াযিদ সেনাপতি উমর ইবনে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস চার হাজার সৈন্যসহ হুসাইনকে ফুরাত নদীর তীরে অবরুদ্ধ করেন। মরুভূমির উত্তপ্ত বায়ূ এবং শত্রুদের অবরোধের পানীয় জলের অভাবে কষ্টভোগ করে মুষ্টমেয় অনুচর সহ ইমাম হুসাইন অতি নির্মমভাবে নিহত হন।
এই লোমহর্ষক বিষাদপূর্ণ স্মৃতি চিরস্মরনীয়। হজরত আলী ও তার বংশধরদের প্রতি ভক্তের আতিশয্যে শিয়া মুসল্মানগন প্রতি বৎসর মহর্রম মাসের প্রথম দশ দিন পর্যন্ত শোক প্রকাশ করে থাকে। কারবালার যুদ্ধে ইয়াযিদের রাজনৈতিক বিজয় লাভ হলেও হুসাইন এবং তার অনুচরগণের প্রানের বিনিময়ে দুনিয়ার মুসলমানের হৃদয় রাজ্য জয় লাভ হয়। হজরত আলী অপেক্ষা ইমাম হুসাইনের হত্যায় মুসলিম সমাজ একতা সমধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হজরত মুহাম্মদের (স) থেকে নবুয়াত সমাপ্ত হলে পরবর্তীকালী হজরত আলীর বংশধরদের ‘ইমামতী’-এর প্রশ্ন নিয়ে নতুন নতুন মতবাদের উদ্ভব হলো।
কূফার শাসন কর্তা আব্দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ শিমার নামক সেনাপতির সঙ্গে ইমাম হুসাইনের দুই শিশু পুত্র, ও শহীদ ইমামের ছিন্ন মস্তকসহ পরিবারের মহিলাদের ইয়াযিদের নিকট প্রেরণ করেন। এই কথা কথিত না যে, ইমাম হুসাইনের ছিন্ন মাথা দেখে ইয়াযিদ অত্যান্ত মর্মাহত হন। মুসলিম জাহানের ক্ষুদ্ধতা ও রাষ্ট্র-বিপ্লব ও অরাজকতার আশঙ্কা করে ইয়াযিদ হুসাইন পরিবার বর্গকে সসন্মানে মদীনায় প্রেরন করেন। এবং মৃতদের কারবালার প্রেন্তরে সমাহিত করার আদেশ দেন।
এর পর থেকে যে ঘটনা কালের বিবর্তনে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গিয়েছে সেই ইতিহাস এখন তুলে ধরবো আমি।
৬৮০খ্রীষ্টাব্দে হুসাইন (রা) নিহত হলে মক্কা ও মদীনাবাসীর সমর্থনে আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর সমগ্র হিজযে খলীফা বলে ঘোষিত হন।
৬৮৩ খ্রীষ্টাব্দে দামেস্কে খলীফা ইয়াযিদ আফ্রিকা-বিজয়ী বীরবর উক্বার (এক চক্ষু বিশিষ্ঠ) পূত্র মুসলিমের নেতৃত্বে সিরিয়ান খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের দ্বারা গঠিত একদল সৈন্য হিজাযের খলীফা আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন, মদীনার পূর্ব দিকে অবস্থিত হারা প্রান্তরে মুসলিমের কাছে যুবাইরের সেনাদল পরাজিত হয়। দুর্দান্ত সিরিয়ান সৈন্যরা তিনদিন পর্যন্ত মদীনা নগর লুট-পাট করে। এর মধ্যে হটাৎ করেই সেনাপতি মুসলিম প্রাণ ত্যাগ করেন স্বাভাবিক ভাবে। আর মদীনার এই যুদ্ধ সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা) এর সুস্পষ্ট ভবিষ্যত বানী হাদীস ‘মিস্কাত শরীফ’-এর চতুর্থ খন্ডে ‘কিতাবুল ফেতন’-এ ব্যাখ্যা করা আছে। সিরিয়ান সৈন্যরা মদীনা লূটের সময় সেনাপতি মুসলিমের আকস্মিক মৃত্যু হয় এবং প্রায় সেই সময়েই রাজধানী দামেস্কে সম্রাট ইয়াযিদের মৃত্যুও ঘটে। এই বিষয়ে চিন্তা করলে হজরতের হাদীসে__ ‘যে ব্যাক্তি মদীনার অবমাননা ও ক্ষতি করবে, সে জলে মিশ্রিত লবনের ন্যায় বিলুপ্ত হবে। স্মৃতিপথে উদিত হয়।’
মুসলিমের মৃত্যুর পর সহকারী সেনাপতি মদীনা পরিত্যাগ করে মক্কা আক্রমন করে। মেন্জনিক যন্ত্রযোগে আগ্নিবান নিক্ষেপ করে তারা চল্লিশ দিন পর্যন্ত মক্কা আবোরোধ করে রাখে। ঐ অগ্নি নিক্ষেপের ফলে কাবা ঘরের গেলাফ (আচ্ছাদন) পুড়ে যায়। ইতোমধ্যে ইয়াযিদের মৃত্যুর কারণে সিরিয়ান সৈন্যদল মক্কা প্রস্থান করেন।
আপনাদের কি ধারণা প্রতিশোধ শেষ। বন্ধুরা এটা কেবল এক রক্তাক্ত অধ্যায়ে শুরু। চেয়ারে শক্ত হয়ে বসুন দ্বিতীয় পর্বের জন্যে।
মুসলমানদের এক রক্তিম অধ্যায়, যার অর্ধেকটা আমরা জানি (প্রথম পর্ব)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১১টি মন্তব্য ৮টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হবে একদিন।

ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।