কোহেকাফের সলতে
রায়ান নূর
৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷
নানা জল্পনা কল্পনা আর মন্ত্রসিদ্ধির পর অবশেষে এক ফকীর-দরবেশের জোর-তদবীরে জুলফা বেগমের গর্ভের এক পু্ত্রসন্তান পৃথিবীর আলো দেখলো ৷
সে দরবেশ ছিল এক কোহেকাফ পরিব্রাজক ৷ তাই তার জ্ঞানের পরিধি সাধারণের তুলনায় ছিল অনেক বেশি ৷ তিনি দিন আর রাতের ব্যবধান স্বচক্ষে দেখতে পেতেন ৷ এমনকি একটি ফুলের প্রস্ফুটিত হওয়ার মুহূর্ত অবলীলায় অনুধাবন করতে পারতেন ৷
দরবেশ আর শয়তানের বিরোধ তখনও লেগে ছিল ৷ সেই একমাত্র মানুষ যিনি কোহেকাফের সকল বিষয়ে অবগত ও কিতাবে কোহেকাফের সাহায্যপুষ্ট ৷ তাই তার অনিষ্ট করা অতটা সহজ ছিলনা ৷
দরবেশ যুবক বয়স থেকে নৈতিকভাবে অনেক বলীয়ান তাই তাকে কোহেকাফের এক অশরীরী মদদ দিয়েছিলেন পৃথিবীর মানুষের জন্য তোহফা হিসেবে ৷ যাতে ভালোমন্দের তফাৎ করতে পারেন তিনি যখন পৃথিবীর বুকে নষ্ট অশরীরী জ্বীন-পরীদের সঙ্গমজাত জাহেলিয়াত বংশানুক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে ৷
সেই থেকে শয়তান আর দরবেশের লুকোচুরি খেলা চলেই আসছে ৷ শয়তান তার জ্ঞানকে ভিন্নভাবে প্রবাহিত করার জন্য কোন কসরত বাঁকী রাখেনি ৷
কিন্তু তিনি শয়তানকে দেখতে পান আর অশরীরীদেরও দেখতে পান তার চোখে ৷ তার এই ক্ষমতা কেবল অলৌকিক নয়, বিস্তর জ্ঞানের ফল ৷
যারা মহাজ্ঞানী তারা সময়কে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারে, অলৌকিককে সজ্ঞা দিয়ে দেখতে পারে ৷ এমনকি একটা পিঁপড়ের গন্তব্যও জানতে পারে ৷
যে কোহেকাফ পরিব্রাজক তার অবশ্য সেই বিখ্যাত কিতাব ‘কিতাবে কোহেকাফ’ সম্বন্ধে জানা আছে কেননা সে সাধক যে অগোচরেই সেই বইয়ের সান্নিধ্য পায় বিপদে-আপদে ৷
কোহেকাফ নগরীর অতি উজ্জ্বল সভ্যতা সেই কবে ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে পৃথিবীর মানুষের কাছে ৷ যখন বাগদাদ-পারস্যে রাজ-জৌলুস ছিল,জ্ঞানবিজ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিল তখন কোহেকাফ নগরীও ভরপুর ছিল অশরীরীদের নিয়ে ৷ তাদের সভ্যতা ছিল আরো উন্নত ৷ পৃথিবীর সকল মূল্যবান জিনিসের উপর তাদের আধিপত্য ছিল ৷
এই উপমহাদেশেরই পাহাড়ী কিংবা পার্বত্য গুহার অন্তরালে মাটির তলদেশে অবস্থিত এই সেই বিখ্যাত কোহেকাফ নগর ৷ কোহেকাফবাসী রাজাদের যেমন খেলার পুতুল করে রাখতো তেমনি নিজের ক্ষমতা বিস্তারের জন্য রাজার গোলামীও করত ৷
এই অশরীরী জ্বীন-পরী সবসময় বহুরূপী ছিল ৷ তারা যেকোন সময় তাদের অবয়ব পরিবর্তন করতে পারতো ৷ তাদের একমাত্র স্থান ছিল কোহেকাফ ৷
শয়তানের মদদে তাদের ক্ষমতার লোভ পেয়ে বসে মানুষকে বশে রেখে আধিপত্য কায়েম করার জন্য ৷ উল্লেখ্য সে শয়তান আজাজীল ছিল একজন জ্বীন ৷ তাই তার কসরত আর কাজে জ্বীন ছিল ভরসা, মানুষকে ভয় দেখিয়ে তাদের পূজনীয় হবার এক সঠিক পন্থা ছিল ৷
যাদের ক্ষমতার লোভ ছিল তারা পৃথিবীতে তাদের সক্ষমতা প্রয়োগ করে কোহেকাফ রাজাররাজা উপর প্রভাব বিস্তার করত ৷ সেকালে যে জ্বীনের গোলামী পাণিপ্রার্থী ছিল সম্রাটগন তারা কোহেকাফ রাজদের চাপে রাখত ৷
তাদের সে চাপ তাও বেশি সম্ভব ছিলনা কোহেকাফ রাজের কারণে ৷ কারণ কোহেকাফ রাজ নিজেও অন্য কোন সম্রাটের আনুগত্য করে সেই সম্রাটের পতন ঘটাতো যুদ্ধে ৷ ফলে এই ক্ষমতাবান অশরীরীর ক্ষমতা কমে যেত আর কোহেকাফ রাজার বিরুদ্ধে সকল শয়তানি ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় রাজকিতাব ‘কিতাব-ই-কোহেকাফ’ তাদের আগলে রাখত ৷
কোহেকাফ রাজার সমর্থন সেইসব পৃথিবীর রাজাদের উপর পড়ত যারা অন্তত এক নীতিতে অটুট থাকতো ৷ যাদের নিজস্ব আইন ছিল প্রখর এবং অলঙ্ঘনীয় ৷ ফলে তাদের মায়া থমকে যেতো এবং অন্যভাবে তাদের উদ্দেশ্য সফল করার চেষ্টা করত ৷ তাদের সর্বশেষ একটি হাতিয়ার ছিল ‘চেরাগে কোহেকাফ ৷’ সে চেরাগের সান্নিধ্য সেই পায় যে সাধনা করে ভালো কাজ করার অঙ্গীকার করে ৷
কিন্তু তাতেও সুবিধা হাসিল করতে লাগল তারা ৷ নির্দিষ্ট সময় তারা সাধনা করে তার শক্তি হাসিল করে উদ্দেশ্য সফল হলে আবার পূর্বের সেই কাজ করতো ৷
চেরাগের কারণে কোহেকাফ রাজও বিব্রত ছিল ৷ যে রাজ-ওমরাহ কোহেকাফ রাজের অনেক অনুগত থাকতো এবং চেরাগের মদদ পাওয়ার সাধনা করত,যারা সফল হতো তারাই বিদ্রোহ করে তাদের অনুগত অশরীরীদের নিয়ে ভেগে পৃথিবীতে এসে ক্ষমতাবান হয়ে মানুষের অনিষ্ট করে ৷
ঠিক এই কারণে কোহেকাফরাজকে কোন সম্রাটের আনুগত্য করতেই হতো তাদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় ৷ ফলে পৃথিবীর বুকে সবসময় কলহ ছড়িয়ে ছিল ৷ মানুষের উপর মানুষ বিশ্বাস হারাতে শুরু করে ৷
অশরীরীরা বহুরূপ ধারণ করে সম্রাটদের উত্থান-পতন ঘটালেও কোহেকাফ ঠিক আগের মতোই আছে কিন্তু তাদের আর সমর্থন নেই পৃথিবীতে ৷ কেননা মানুষ এখন তাদের ছাড়াই অহরহ রূপ পাল্টাতে পারে ৷ এদিক থেকে আজাজীল সফল ৷
কোহেকাফ নগরীর সেই চেরাগ যার সলতেই আগুন দিলে বহুরূপ ধারণ করতো ৷ চোখের পলকে সলতের আগুন খেলা করতো নানা রঙে ৷ আর সেই চেরাগ জ্বলত দ্রাক্ষামদে ৷ পারস্যের সবচেয়ে দামী মদ দ্রাক্ষা অর্থাৎ আঙ্গুর ফলের মদ ৷ এই মদ ছাড়া সে চেরাগ জ্বলত না ৷ আর এই সলতে থাকত সেই বিখ্যাত শাহিন হীরার মাঝে ৷ যার অলৌকিক ক্ষমতা যে কারোর রূপ পরিবর্তন করে দিতে পারতো অবলীলায় ৷
বহুশতাব্দী পার হয়ে হয়ে গেছে ৷ এই উপমহাদেশে সম্রাটদের শাসন নেই তাই কোন প্রয়োজন পড়েনা এই ক্ষমতাবান অশরীরীদের ৷ যার বিশাল রাজ্য থাকতো তার অধীনে কোহেকাফ নগরীর এক অংশ সম্রাটের আনুগত্য করত তার শাসন পরিচালনায় ৷ কোহেকাফরাজ আনুগত্য করত আর আজাজীল আনুগত্য পেত ৷
ফলে মানুষের মাঝে তাদের জাহির করা সহজ হয় এবং রাজাদের বিরুদ্ধে নয় মানুষের বিরুদ্ধেই তারা ব্যস্ত থাকে ৷ কেউ থাকে নীতির পক্ষে আর কেউ কলহে ৷ আর সেই চেরাগের মহিমায় রূপ বদল করে মানুষকে ধোঁকা দিত সেইসব জ্বীন-পরী ৷ আর সেসব আচরণ বংশানুক্রমে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর মানুষের কাছে ৷
সম্রাটরা কেবল নিজের রাজত্ব টিকে রাখার জন্য পাণিপ্রার্থী হলেও তার ফল পৃথিবীর মানুষ ভোগ করছে অথচ কোন সম্রাট ও রাজ্যও শেষপর্যন্ত টিকেনি ৷
বহু বছর অতিক্রম হয়ে গেছে,হয়েছে পৃথিবীর হাওয়া পরিবর্তন ৷ প্রযুক্তির কারণে সভ্যতা উন্নত হয়েছে, দেশের বুকে নানা রকমের চলেছে পরিবর্তন ৷ তেমনি মানুষেরও পরিবর্তন এসেছে ৷ পোশাক-আশাক,আচার-ব্যবহার এমনকি ভাষাতেও গণ্ডগোল বেধে গেছে চরমে ৷
কিন্তু সেই দরবেশ বদলে নি এতটুকু ৷ সে থাকতো এক নিবিড় ঘন-পল্লীতে,সেখানেই তার খানকাহ শরীফ,পাশে একটা নদী ৷ প্রত্যহ সে নদীতে তিনি দিনে দুইবার গোসল করতেন ৷
নদীতে গোসলের সময় প্রত্যহ সেই কোহেকাফের বিখ্যাত চেরাগের দর্শন পেতেন কিন্তু তাকে কখনোই লোভের বর্শবর্তী হয়ে আহবান করেননি ৷ সে চেরাগ আবার যার কাছে আসবে তার অপব্যবহার মানুষ করবে ৷ পৃথিবীর বুকে আবার অতীত এসে যাবে এবং মানুষ পশুতুল্য হয়ে যাবে চেহারা পরিবর্তন করতে করতে ৷
দরবেশ সবসময় আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে সময় পার করতেন,খানকাহ শরীফেই শিক্ষাদান করে তিনি কঠোর নৈতিক জীবন যাপন করতেন ৷ তার ব্যক্তিত্ব এমনই ছিল যে কঠোর মনের মানুষও তার কাছে কেমন নরম হয়ে যেতো ! এর ভেদ বড়ই দুর্ভেদ্য ছিল মানুষরে কাছে ৷ এলাকার লোকজনেরা বলে ইনি পরম ধার্মিক এবং অনেক জ্ঞানের অধিকারী, তাই না যদি হবে তার কারামত থাকবে কেন?