somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুন্তী এবং মহাভারতের স্বর্গদেবতারা.....

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১১ রাত ১০:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুদীর্ঘ মহাভারতের দেবতা সহ নানা চরিত্রের বৈচিত্রময়তার মাঝে নিজস্ব আভায় বিকশিত কৌশলী এক নারী কুন্তী। রাজা কুন্তীভোজের পালক কণ্যা হবার সুবাদে তার নাম হয় কুন্তী। তবে জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন যদুবংশীয় রাজা শুরের কন্যা ও কৃষ্ণের পিতা বাসুদেবের বোন। তার প্রকৃত নাম - পৃথা।

দেবতা আর মুনি-ঋষিদের পরিতৃপ্ত করে (তা যেভাবেই হোক!!!.) বর বা মন্ত্র পাওয়া ছিল সে যুগের স্বাভাবিক ঘটনা। মূলত: কৃত কোন কাজের ব্যাখ্যা দিতে হয়না এমনই একটি কৌশল ছিল মন্ত্রবিদ্যা। দূর্বাসা মুনিকে সেবাযত্ন করে তেমনই এক মন্ত্র লাভ করেণ কুন্তী, যে মন্ত্র কখনো বিফল হবার নয়। সে মন্ত্রের এমনই ক্ষমতা যে কুন্তী যে দেবতাকে স্মরণ করবে সেই তার অনুগত হবে আর কুন্তী লাভ করবে পুত্র সন্তান (এক কথায় স্মরণেই সহবা!!)। তবে দূর্বাসা মুনীর ইচ্ছা যদিও ছিল কুন্তী কারও সহধর্মিনী হয়ে এ বর কাজে লাগাবে, তাতে সম্ভ্রম আর বংশমর্যাদা দুই রক্ষা হবে। কিন্তু তরিঘরি করে যাবার সময় এই অতি প্রয়োজনীয় উপদেশটি দিতে কেন যেন ভুলে গিয়েছিলেন দূর্বাসা। বুঝতে পারনেনি, দেবদত্ত উপায়টি প্রয়োগের জন্য কুমারী অবস্থাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠবেন রাজনন্দিনী কুন্তী এবং তার ফলাফলা হবে সুদুর প্রসারী। এর ফলেই জন্ম হয় সূর্য-কুন্তীর অবৈধ পুত্র মহাবীর কর্ণের, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যিনি মূল সহায় ছিলেন দূর্যোধনের। আর কর্ণ না থাকলে হয়তোবা দূর্যোধন কুন্তী পুত্র পঞ্চপান্ডবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে সাহস পেতেন না।


যাইহোক, দূর্বাসা বিদায় নেবার সাথে সাথেই মন্ত্রের ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যই হোক বা দেবসঙ্গ উপোভোগ করার জন্যই হোক, কুন্তী আহবান করে বসেন দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জলকান্তী পুরুষ সূর্যকে।


শিল্পীর তুলিতে সূর্য-কুন্তী[/si

সূর্য এসে বললেন "কল্যানি! আমি মন্ত্রপ্রভাবে তোমার নিত্যন্ত বংশবদ হইয়াছি, এক্ষুনে তোমার কি করিব বলো?"
হায়রে স্বর্গের দেবতা!!
কুন্তী বললেন ক্ষমা করুন, "আমি শুধু কৌতুহল বশত: আপনাকে আহবান করে ফেলেছি"।
কিন্তু এই কথায় সূর্যকে বোকা বানানো গেলনা। তিনি বললেন "আমি বুঝিয়াছি আমা হইতে শৌর্যশালী কবচ কুন্ডলধারী সন্তান উৎপাদন করা তোমার অভিসন্ধি। অতএব এক্ষেন আত্মদান করো, তোমার অভিলষিত পুত্র উৎপাদন হইবে"।
সুতরাং তখন এই দেবতা আর মানুষের মিলনে (মন্ত্র বলে!!) জন্ম হলো মহাভারতের প্রখ্যাত বীর কর্ণের, যাকে দেবতা এবং কুন্তী কেউই নিজের সন্তান বলে পরিচয় দেননি। এই অবৈধ দেবপুত্রটিকে করুক্ষেত্রের যুদ্ধের সংকটময় মূহূর্তেও কুন্তী নিজের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেননি, সন্তানের চেয়ে নিজের মহিমাময় ভাবমূর্তি বজায় রাখতেই তিনি বেশি সচেষ্ট ছিলেন।

পরবর্তিকালে কুন্তী নিজের পছন্দমতো পান্ডু রাজাকে বিয়ে করেন, তবে তার আরেকজন সপত্নি ছিল মাদ্রী নামে।
এই পান্ডু রাজ ছিলেন আবার সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থায় পুত্র সন্তান না থাকেল মরার পরে শ্রাদ্ধ হতো না, তাই পান্ডু রাজা মুনি ঋষিদের দ্বারস্থ হলেন কিভাবে এর সমাধান করা যায়।
অনেক বেদবেদান্ত ঘেটে মুনি-ঋষিগণ রায় দিলেন যে, কোন উত্তম বর্ণের পুরুষ বা দেবতার দ্বারা তার স্ত্রীরা সন্তান লাভ করতে পারবে, এতে ধর্মের কোন ক্ষতি হবে না।

(দেখা যাচ্ছে সু্প্রাচীন কাল থেকেই ধর্মকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারের বহু নজির রয়েছে।)

সুতরাং কুন্তী তখন ভাবলেন, অন্য পুরুষ থেকেই যখন সন্তান নিতে হবে তখন দেবসন্তান লাভই সবচেয়ে লাভজনক, কারণ এতে দেবতাদের সমর্থন পেতে সুবিধা!!
বিচক্ষনা কুন্তি তখন পান্ডুর পরামর্শ অনুসারে একে একে দেবতা ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্রকে অহবান করেন, এবং একে একে যুধিষ্ঠির, ভীল, ও অর্জুনের জন্ম হয়। দেবপুত্র লাভ করে দেবতাদের সহায়তায় হয়ত তিনি চেয়েছিলেন পুত্রদের মাধ্যমে হস্তিনাপুরের ক্ষমতা করায়ত্ব করতে।

কুন্তীর চতুরতার অরেকটি অধ্যায় দেখা যায়, স্বামী পান্ডুর মৃত্যুর পরে। মহাভারতের বর্ণানা অনুযায়ী পান্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী (নকুল আর সহদেবের মা) কুন্তীকে নিরস্ত্র করে নিজে স্বামীর সাথে সহমরণে যান। এখানে কি প্রশ্ন জাগে না যে, প্রথম স্ত্রী কুন্তী থাকতে সতী হবার দ্বায়িত্বটা সেই কেন নিল? তারো তো দুটো সন্তান ছিল, নাকি কুন্তী নিজেই সপত্নীকে রাজনৈতিকভাবে সরিয়ে দিয়েছিলেন?

রবি বর্মার আচড়ে কুন্তী ও মাদ্রী

কুন্তী চরিত্রটির চমৎকারিত্ব এখানেই। স্বামীর মৃত্যুর পরে যখন তার শোকব্যাকুল হবার কথা তখন বিচক্ষন কুন্তী সপত্নীকে স্বামীর সাথে সহমরণে পাঠিয়ে দিয়ে সন্তানদের নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে চলে আসলেন শশ্বড়বাড়ি হস্তিনাপুরে। যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় হেরে গিয়ে শর্ত অনুসারে বনবাসে যাবার আগ পর্যন্ত তিনি এখানেই থাকেন।
পরে পঞ্চপান্ডব বনবাসে গেলে, কুন্তী তার দেবর বিদুরের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

গান্ধারী শিল্পরিতীতে কুন্তী
কুন্তী শুধুমাত্র পান্ডব জননীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক পরামর্শদাত্রী। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শুরুর দিকে সন্ধির জন্য কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে এসে কুন্তির সাথে দেখা করেন, কিন্তু কুন্তী তাতে রাজি হননি। পান্ডবদের তিনি প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করে রাজ্য জয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তিনি বলেন "পান্ডব জননী হয়ে তিনি পরের দয়ার বাঁচতে চান না।"কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়ও আমরা দেখতে পাই নিজের পুত্রদের প্রতি স্নেহবশে তাকে গোপনে গঙ্গাতীরে কর্ণের (কর্ণ দূর্যোধনের পক্ষে ছিলেন) সাথে দেখা করে তাকে তার জন্মবৃতান্ত জানিয়ে পান্ডবদের পক্ষ নিতে প্ররোচিত করতে।

এত কিছুর পরও কুন্তীর শেষ বয়সটা কি সুখে কেটেছিল?

কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের পরে, কুন্তি যখন পান্ডবদের কাছে কর্ণের জন্মের কথা আর পরিচয় তুলে ধরেন, তখন কিন্তু পান্ডবরা তা মেনে নিতে পারেন নি। যুধুষ্ঠির তখন অভিশাপ দেন যে "স্ত্রী জাতি কোন বিষয়কেই কখনও গোপন রাখতে পারবে না"।
কুন্তী শেষ জীবনটা কিন্তু নিজের ছেলেদের সেই অর্জিত রাজ্যে থাকেননি, তিনি শতযুপ নামের একটা অশ্রমে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হন এবং একদিন বনের মধ্যে হঠাৎ দাবানলে তার মৃত্যূ হয়।

মহাভারতে কুন্তীকে একজন দৃঢ়চরিত্রের তেজস্বিনী ও আদর্শ জননী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, তবে আসলেই কি তিনি তাই ছিলেন


তিলোত্তমার খোজে...........

গ্রন্থ সূত্র:
১। মহাভারত (বন খন্ড, আদি খন্ড)...কালী প্রসন্ন সিংহ।
২। পৌরনিক অভিধান......সুধীর চন্দ্র সরকার।
৩। দানিকেনতত্ব ও মহাভারতের স্বর্গদেবতা....বীরেন্দ্র মিত্র।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৪৯
১০৯টি মন্তব্য ১১২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×