ট্যাঙ্ক এর নাম শুনলেই মনে পড়ে ঘড় ঘড় আওয়াজ করে তেড়ে আসা কোন যান্ত্রিক দৈত্য এর কথা। যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাঙ্ক এর সবথেকে বেশি ব্যবহার হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধে। এই সময় এসে প্রমানিত হয় ট্যাঙ্ক হল যুদ্ধক্ষেত্রের রাজা। চলুন দেখি যাওয়া যাক সেই রক্তে শিহরণ তোলা সময়ে আর জেনে নেই সেই সময়ের ভয়াবহ কিছু কিলিং মেশিনের কথা।
যোসেফ স্তালিন ট্যাঙ্কঃ
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটা রাশিয়ার (সোভিয়েত রাশিয়া) তৈরি ট্যাঙ্ক। এটাকে আই-এস ট্যাঙ্ক নামে ডাকা হত। জার্মান আক্রমণে পর্যুদস্ত সোভিয়েত বাহিনী যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় থেকে এই ট্যাঙ্ক বিপুল পরিমানে উৎপাদন শুরু করে। এর পুরু আর্মার ৮৮ মিমি কামানের গোলাও অনায়াসে হজম করে নিতে পারত। আর অন্যদিকে জার্মান টাইগার ট্যাঙ্ক ও দ্রুতগতির প্যান্থার ট্যাঙ্ক এর বিরুদ্ধে ছিল অত্যন্ত কার্যকর। বিশ্বযুদ্ধের শেষ অর্ধে সোভিয়েত অগ্রযাত্রার পুরোভাগে থাকত আই-এস ট্যাঙ্ক।
আপপ্যান্থার ট্যাঙ্কঃ
ফিল্ড মার্শাল রোমেল মনে করতেন ট্যাঙ্ক ই যুদ্ধের মাঠের মূল খেলোয়াড়। এই ভাবনা কে মাথায় রেখে জার্মানরা প্রথম যুদ্ধের ময়দানে ট্যাঙ্কের বিপুল ব্যবহার শুরু করে। তারা হালকা, ভারী অনেক রকম ট্যাঙ্ক এর সফল ব্যবহার করে যুদ্ধের ময়দানে আর এর মধ্যে আলাদা করে অবশ্যই বলতে হয় আপপ্যান্থারের কথা। কোন প্রতিরক্ষা বুহ্যের ক্ষমতা ছিল না এর ভয়াবহ ৮.৮ সেমি কামানের ধ্বংস ক্ষমতার সামনে টিকে থাকে।
এম-৪ শেরম্যানঃ
এটি ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটি মাঝারি ট্যাঙ্ক। আমেরিকার তৈরি। পরে মিত্র বাহিনীও এটি ব্যবহার করে। এর প্রধান অস্ত্র ছিল 75 mm M3 L/40 কামান। এর সব থেকে বড় কার্যকরী দিক হল নিখুঁত নিশানা। এমনকি চলন্ত অবস্থায়ও নিশানা ভেদে অব্যর্থ ছিল এম-৪ শেরম্যান। আর এই বৈশিষ্ট্য একে মিত্র বাহিনীর মধ্যে ব্যপক জনপ্রিয় করে তোলে। ঐতিহাসিকদের মতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৫০০০০ এর অধিক এম-৪ শেরম্যান ট্যাঙ্ক তৈরি হয়েছিল।
প্যান্থার ট্যাঙ্কঃ
মাঝারি এই ট্যাঙ্ক ১৯৪৩ সালে যুদ্ধে মোতায়েন করা হয় এবং যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ায়। রাশিয়ান টি-৩৪ ট্যাঙ্কের মুখোমুখি দাড় করাতে একে প্রস্তুত করা হয়। এর সাফল্য জার্মানদের অনুপ্রাণিত করে প্যাঞ্জার-৩ ও প্যাঞ্জার-৪ এর বদলে প্যান্থার কে মূল অ্যাসাল্ট ট্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করতে। প্যান্থার এর মূল শক্তি ছিল বিধ্বংসী ফায়ার পাওয়ার ও দ্রুত গতি। সেই সাথে এর শক্তিশালী বর্ম একে শত্রুর কাছে অজেয় করে তোলে। এর নিখুঁত ডিজাইন এর কারণে যুদ্ধের পরেও অনেক দেশ প্যান্থার এর মডেল অনুসরন করে ট্যাঙ্ক বানাতে। দ্রুত গতি, ভারী আর্মার আর বিধ্বংসী ক্ষমতার জন্য অনেকেই একে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সেরা ট্যাঙ্ক বলে একবাক্যে স্বীকার করেন।
প্যাঞ্জার-৪
২য় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে নাৎসি জার্মানির প্রধান ট্যাঙ্ক ছিল প্যাঞ্জার-৪। ১৯৩০ সাল থেকে এটি জার্মান সেনাবাহিনীতে ব্যবহার করা হয়। এটি একটি মাঝারি ট্যাঙ্ক। শুরুতে একে স্থল আর্মির সাপোর্ট পাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হত। পরে একে মূল যুদ্ধে প্রাথমিক আঘাত হানতে ব্যবহার করা হত। ফিল্ড মার্শাল রোমেলের ট্যাঙ্ক ডিভিশনের মূল শক্তি ছিল এই প্যাঞ্জার-৪। এটি যুদ্ধের সময় সবথেকে বেশি তৈরি করা জার্মান ট্যাঙ্ক।
শেরম্যান ফায়ারফ্লাইঃ
এটি আমেরিকান শেরম্যান ট্যাঙ্ক এর মডেলে তৈরি করা ব্রিটিশ ট্যাঙ্ক। ব্রিটিশরা তাদের ১৭ পাউন্ডের ভয়াবহ এন্টি ট্যাঙ্ক গান এতে যুক্ত করে। নতুন মডেলের ব্রিটিশ ট্যাঙ্ক আসার আগে ব্রিটিশরা একেই তাদের মূল ট্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করে। শেরম্যান ফায়ারফ্লাই ছিল একমাত্র ব্রিটিশ ট্যাঙ্ক যা জার্মান টাইগার ও প্যান্থার উভয়ের বিপক্ষে কার্যকর ছিল। তাই জার্মান ডিভিশন গুলোর আর্টিলারি ইউনিট গুলোকে বলা থাকত ব্রিটিশ আর্মি এর সাথে যুদ্ধে যেন সবার আগে শেরম্যান ফায়ারফ্লাই কে অ্যাটাক করা হয়।
টি-৩৪ ট্যাঙ্কঃ
এটিও একটি মাঝারি ট্যাঙ্ক। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রধান ট্যাঙ্ক ছিল এটি। টি-৩৪ কে ২য় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম সফল ও বহুল ব্যবহৃত ট্যাঙ্ক বলা হয়। সংখ্যার দিক দিয়ে এটি ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সর্বাধিক উতপাদিত ট্যাঙ্ক। যুদ্ধের পর রাশিয়া অনেক দেশে এই ট্যাঙ্ক রপ্তানি করে আর এখনো অনেক দেশেই টি-৩৪ অপারেশনাল আছে।
টি-৪৪ ট্যাঙ্কঃ
রাশিয়ার তৈরি মাঝারি এই ট্যাঙ্ক আসলে টি-৩৪ এর পরের প্রজন্ম। বিশ্বযুদ্ধে সফল ভাবে ব্যবহার হলে ও মাত্র ২০০০ এর মত তৈরি করা হয়েছিল এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর আর তৈরি করা হয়নি। যদিও এর ডিজাইন পরে ব্যবহার করা হয় বিশ্বের সব থেকে বেশি তৈরি করা টি-৫৪/৫৫ ট্যাঙ্ক তৈরিতে।
টাইগার-১ ট্যাঙ্কঃ
জার্মানদের বহুল ব্যবহৃত ট্যাঙ্ক। সব গুলো যুদ্ধক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে এই ট্যাঙ্ক। ১৯৪২ সালে ডিজাইন করা এই ভারী ট্যাঙ্ক ছিল মিত্র বাহিনীর আতঙ্ক। ৮৮ মিমি মাউন্টেড কামান আকাশ ও মাটি উভয় জায়গার শত্রু নিধনে পারদর্শী ছিল।
টাইগার-২ ট্যাঙ্কঃ
এই ভারী ট্যাঙ্ক ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে যায়গা করে নিয়েছে এর ভয়াবহ ক্ষমতাশালী কামান আর অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা। সম্মুখ যুদ্ধে এটি প্রমাণ করেছিল যে মিত্র বাহিনীর যেকোন ট্যাঙ্ক এর থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী টাইগার-২। যদিও ক্ষমতার তুলনায় দুর্বল ইঞ্জিন আর ফুয়েলের অতি ব্যবহার এর কারণে এর উৎপাদন বৃহৎ আকারের ছিলনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ৮:২৬