somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীরার চিঠি

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মাস্টার সাহেব,
চোখ মেলে দেখি সাদা পরী আকাশী রঙের খাম হাতে দাড়িয়ে আছে । সামনে বিস্তীর্ন জলরাশি । সমুদ্র পাড়ের বেঞ্চে শরীর এলিয়ে শুয়ে আছি । হাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর “ সাঁতারু ও জলকন্যা” । সমুদ্রের ঢেউ এর আছড়ে পড়ার শব্দ আর ঝিরি ঝিরি বাতাসে খুব বেশিক্ষন বইটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি নি । কয়েকপাতা পড়তেই চোখের পাতাজোড়া এক হয়ে এসেছে । মাস্টার সাহেব ডাকটা শুনেই তন্দ্রা ভাবকেটে গেলো । আমার এক ছাত্রী আমাকে এই নামে ডাকতো । নীরা । নদীর মত শান্ত । যতটা বিনয়ী হলে একজন অপরিচিত মানুষ কাউকে সন্মান করে, ততটাই সে বিনয়ী । নীরার ধারণা আমি নীরাকে এড়িয়ে চলতাম । পৃথিবীতে অনেক রকমের মানুষ আছে । তার মধ্যে এক রকম আছে যারা অনাকাঙ্কিত ঝামেলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বা ঝামেলায় না জড়ানোর জন্য সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে । আমি আপাদমস্তক সেই দলের সক্রিয় সদস্য । যার কারণে নীরা কখনো জানেই নি, তার চলাফেরা, আনাগোনা, উপস্থিতি আমার হৃদস্পন্দনকে অস্বাভাবিক করে তুলতো । আমার ভাবনার বড় একটা জায়গা জুড়ে ছিল নীরা । ভাবাতো ওর ছোট ছোট করে কথা বলা কিংবা নিঃশব্দে হেটে যাওয়া । ও কখন জানেও নি আমি দূর থেকে ওর ফিরে যাবার দিকে চেয়ে থেকেছি । পরীর চুলগুলো সুন্দর করে ক্লিপ দিয়ে আটকানো । সাদা ফ্রক পরনে । বয়স কত হবে । ৭ বা ৮ বছর । পরী আমার হাতে খামটা দিয়ে , আর এক মহুর্ত দাড়ালো না । দৌড়ে চলে গেল । এই খাম আমার খুবই পরিচিত । বছরের একটা নিদির্ষ্ট মাস জুড়ে প্রায় প্রতিদিনই নীরা আমাকে এই খাম দিত । ভেতরে কয়েকটা চকলেট । খামের উপর লেখা থাকতো , হ্যাপি বার্থডে । নীরার বিয়ের পর আমি আর ওর সাথে যোগাযোগ করি নি । এমন না যে আগেও বেশ যোগাযোগ ছিল । ওর বিয়ের পর বেশ কয়েক বছর আমার অফিসের ঠিকানা প্রেরক বিহিন এই খাম এসেছে । তবে এই খামের মুখটা আটকানো না । ভেতরে চকলেট ছাড়াও একটা চিঠির অস্তিত্ব বুঝতে পারলাম । কেন জানি পরীর ফিরে যাবার দিকে তাকাতে ইচ্ছে হল না । মন বলছিল নীরা হয়ত কিছুটা দূরেই দাড়িয়ে আছে । কি মনে হল , নীরা দেখে যাক আমি তাঁর চিঠি পড়ছি । চিঠিটা বের করলাম । গোটা গোটা হাতের লেখা । পরিচিত । বেশ পরিচিত ।

মাস্টার সাহেব,
আমি কে এটা এতক্ষণে আপনার বুঝে যাবার কথা । আপনাকে আমি যতদূর চিনি তাতে করে, আমি কে এটা জানার জন্য আপনার নিউরন গুলো হয়ত খুব বেশি দৌড়াদৌডি করবে না । সকালে আপনি যখন হোটলের কাউন্টারে কথা বলছিলেন, কথার শব্দ শুনে আমার মনে হয়েছিল , এই শব্দ আমার চেনা । তারপর চাবি নিয়ে যখন লিফটের দিকে যাচ্ছিলেন , তখনই নিশ্চিত হয়েছি এটা আপনি । বেশ মোটা হয়ে গেছেন । আগের চেয়ে বেশ ধীর । মোটা ফ্রেমের চশমা নিয়েছেন । আপনার চুল বড় রাখার অভ্যাসটা যায় নি এখন । আমরা সপরিবারে ঘুরতে এসেছি । আজকে আপনার জন্মদিন আমি প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম । আপনাকে দেখে মনে পড়লো । ২০ বছর আগে আপনাকে যে চকলেট দিতাম সেটা এখানে খুজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে । খামটা আমার নিজের বানানো । আপনি যখন এই চিঠি পড়ছেন , আমি বেশ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আপনাকে দেখছি । জানি , আপনি পিছনে ফিরে তাকাবেন না ।আর, অনেকটা সেই ভরসাই দাড়িয়ে আছি । পরী , আমার মেয়ে । আমার চেয়ে বেশি শান্ত । আপনার অনেক গল্পই পরীর জানা । প্রথম দিকে পরী ভাবতো , মাস্টার হয়তো অন্য কোন প্রজাতি । ওকে বোঝাতে বেশ সময় লেগেছে । ওর কথা , মাস্টার কেন? টিচার নাহয় স্যার বলবা । ওকে বুঝিয়েছি আমার মাস্টার সাহেব একজনই । বাকীরা শিক্ষক । আপনাকে শেষ দেখেছিলাম প্রায় ৮ বছর আগে । আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে টা খুব কষ্টে সংবরণ করেছি । আপনার মনে আছে, একবার আমি খুব জিদ করেছিলাম নৌকা করে ঘুরবো বলে (যদিও এ ছাড়া আপনাকে কোথাও যেতে রাজি করাতে পারি নি ।) , আপনি নদীর পাড় পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসেছিলেন । খুব কান্না করেছিলাম । পরে আমার রুমমেট কে নিয়ে গেছিলাম । আপনাকে ছবি পাঠিয়েছিলাম । আপনি শুধু বলেছিলেন ভাল । আমি জানতে চেয়েছিলাম , কেন আমাকে নৌকা করে ঘুরিয়েছিলেন না । আপনি বলেছিলেন, স্মৃতি বাড়িয়ে লাভ কি । এগুলো বেশ কষ্ট দিবে । কি জানি আপনি আগেই জানতেন আজকে এই দিন আসবে হয়ত । আপনি যখন পড়াতেন মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থাকতাম । কতটা সহজ , সাবলীল । মাঝে মাঝে ভাবতাম আপনি বোধহয় আমাকে এড়িয়ে যান, তাই পড়ানোর সময় আমার দিয়ে খেয়াল করতেন না । পরে বুঝতাম, ক্লাসে আপনি আপনার সর্বোচ্চটা দিতেন । তাই সবার দিকে সমান ভাবে লক্ষ রাখতেন । আর সেজন্যই হয়ত ছাত্রদের মধ্যে আপনার এত জনপ্রিয়তা ।
খুব ইচ্ছে হয় আপনাকে ফোন দিয়ে বলি, মাস্টার সাহেব , কেমন আছেন । পড়ানোর আগে সিগারেট খেয়ে চুইঙ্গাম চিবাতেন , সেগুলো এখনও করেন কি না । এখন একা একা খুব সকালে নদীর পাড় ধরে হাটেন কি না । বিবেকের তাড়নায় সেটা আর হয়ে উঠে না । পেরে উঠি না । সেদিন নাকি আব্বার সাথে আপনার দেখা হয়েছিল । আব্বা এসে গল্প করছিল । মা প্রায়ই আপনার কথা জিজ্ঞেস করে । ভাল লাগে এই ভেবে যে , এই মানুষগুলোর কাছে আপনাকে অসম্মানিত করি নি । সবাই আপনাকে এখন ছেলের মতই জানে । অনেক কথা বলার ছিল । বলতে পারলাম না । কথা গুলো কেমন জানি সব অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। দোয়া করি সুস্থ থাকেন ভাল থাকেন ।
নীরা

বিস্তীর্ন জলরাশির ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে । সামনে ছোট বড় সব বয়সের মানুষ দৌড়াদৌড়ি করছে । কেউ ছবি তোলায় ব্যস্ত । কোন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা ছেলে মেয়েরা গলা মিলিয়ে গান গায়ছে , “আবার এলো যে সন্ধ্যে” । আমি বসে আছি । হাতে নীরার চিঠি । “সাঁতারু ও জলকন্যার” মাঝে চিঠিখানা রেখা , বইটা দুইহাতে বুকে ধরে সমুদ্রের কিনারে এসে দাড়িয়েছি । নীরার সামনে দাড়িয়ে বলতে পারলে ভাল লাগতো , ভালো থেকো ।অনেক অনেক ভালো থেকো ।

২৪শে মাঘ, ১৪২৬।
নাজমুল ইসলাম সাদ্দাম
[ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ।]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:০৮
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×