ব্লগস্ফিয়ার বলতে আমরা বুঝি ব্লগের দুনিয়া (Universe of blogs) তথা ব্লগারদের ব্লগস্মূহ এবং সেইগুলোর পরস্পরসংযুক্ততা (Interconnections)। উদাহরণস্বরূপ আপনি সামুতে ঢুকলে দেখবেন ব্লগাররা আলাদা আলাদাভাবে ব্লগ লিখছেন ঠিকই, কিন্তু প্রত্যেকেরই নিজস্ব ফেভারিট লিস্ট এবং সাম্প্রতিক মন্তব্য লিস্টে আপনি আরো অনেক ব্লগারের লিঙ্ক পেয়ে যাবেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত Jodi Dean এর Blog Theory বইতে ব্লগস্ফিয়ারকে সাধারণভাবে সংজ্ঞায়িত করেন কমিউনিটি হিসেবে। এখানে উল্লেখ্য যে অন্যান্য দেশে কমিউনিটি ব্লগ নেই, ব্লগাররা নিজেরাই অনেকটা একক ওয়েবসাইট চালানোর মতো ব্লগ চালায় এবং তাদের সকল ব্লগ মিলিয়েই ব্লগস্ফিয়ার বা ব্লগ কমিউনিটি বিবেচনা করা হয়। কমিউনিটি ব্লগিং বাংলা ব্লগের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। সামু নিজেই একটি আলাদা ব্লগ কমিউনিটি যেখনানে ব্লগারদের ব্লগসমূহ নানাভাবে পরস্পর সংযুক্ত। সুতরাং আপনারা যারা এই লেখাটি এখন পড়ছেন তারা সামুর ব্লগস্ফিয়ারে আছেন। আবার সামু, সচল, আমারব্লগ, প্রথম আলো, ইস্টিশন সহ অন্যান্য বাংলা ব্লগসাইটগুলো একত্র করে আমরা এটাকে বলতে পারি বাংলা ব্লগস্ফিয়ার।
জডি ডিন ব্লগোস্ফিয়ারের একটি বিপরীত শব্দও ব্যাবহার করেছেন যেটি হলো ব্লগিপিলাগো (Blogipelago)। ব্লগগুলো যখন কমিউনিটি হিসেবে থাকে তখন সেটি ব্লগস্ফিয়ার হয়, আবার যখন ব্লগগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে তখন তাকে বলা যায় ব্লগিপিলাগো। বাংলা ব্লগসাইটগুলোর বেশীরভাগই কমিউনিটি ব্লগ, মানে ব্লগারদের ব্লগগুলো একটি ওয়েবসাইটে একসাথে থাকে। কিন্তু গত এক বছরে ব্লগসাইটগুলোতে ব্লগারদের মধ্যে ইন্টারেকশন বেশ কমে যাচ্ছে। ব্লগস্ফিয়ারের ভেতর থেকেও কি তাহলে আমরা ব্লগিপিলাগোর শিকার হচ্ছি মানে ব্লগ কমিউনিটিগুলো ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যাচ্ছে? ব্লগার একরামুল হক শামীম তার ‘বাংলা ব্লগের ইতিবৃত্ত” বইতে লিখেছেন "ব্লগার কমিউনিটির প্রথম দৃশ্যমান ভাঙ্গন হয় মডারেশনকে কেন্দ্র করে। তখন মডারেশন চলতো অলিখিত নীতিমালাতে। মাসুদা ভাট্টির পোস্ট 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' এনেছে যুক্তিতে মুছে দেয়া হয়। সেই সময় কিছু ব্লগারের পক্ষ থেকে ব্লগ বিরতির ঘোষনা আসে এবং সেইসময়কার বিরোধ অবিভাজিত ব্লগ কমিউনিটিকে ভেঙ্গে দেয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ এ সচলায়তন ও ২০০৮ সালে আমার ব্লগের যাত্রা শুরু হয়।
খালিদের সরলতার প্রতিমা গানে একটি লাইন আছে “আমি তোমাকে গড়ি ভেঙ্গে চুড়ে শতবার”। ব্লগ কমিউনিটি গুলোর অবস্থা অনেকটা সেরকম। এরা ভাঙ্গা গড়ার ভেতরেই আছে। তবে সবক্ষেত্রেই যে ব্লগাররা একজোট হয়ে ঘোষনা দিয়ে ব্লগ ছেড়ে গিয়েছে এমনটা নয়। যারা নীরবে ব্লগিং কমিয়ে দিয়েছেন তাদেরটা কিন্তু চোখে পড়ে না।আমার মতে গত এক বছরে এই সাইলেন্টলি ব্লগ ব্রেকারদের সংখ্যাই বেশি। তথা ব্লগাররাই এখানে কমিউনিটি বিল্ডার আবার ব্লগ ব্রেকার। এই ব্রেকিং শুধু বাংলা ব্লগসাইটেই চলছে না, অন্যান্য দেশের ব্লগসাইটগুলোতে দেখা যাচ্ছে। এখানে আমাদের দ্বারস্থ হতে হবে জডি ডিন এর কাছে। তিনি তার বইতে লিখেছেন, মূলধারার গণমাধ্যমের প্রতি আস্থাহীনতা থেকেই মানুষ একসময় ব্লগে মতামত দেয়া শুরু করেছিলো। নিজের একটি উদাহরণ দেই। বছরখানেক আগে ঢাবি কলা ভবনে হঠাত টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক আপু আমার মুখের সামনে মাইক ধরে জিজ্ঞেস করলেন “এই যে ইন্টারনেটের যুগে প্রেমিক-প্রেমিকাদের দ্রুত ব্রেক আপ হচ্ছে এ ব্যাপার আমার অনুভূতি কি”? ঐ যে দেখুন, ব্লগ কমিউনিটিগুলোর মতো প্রেম ভালোবাসাও ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমরা ভাঙ্গার যুগে বসবাস করছি। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমিও আপুকে সবকিছু ভেংগে আমার অনুভূতি প্রকাশ করলাম। কিন্তু টিভিতে সেটা কেটে ছেটে এমনভাবে উপস্থাপিত হলো আমি নিজের ভাঙ্গাচোরা চেহারায় নিজের বক্তব্য শুনে নিজেই থ হলাম “ওসব কি আমি বলেছিলাম”? ব্লগে যদি কথাগুলো লিখতাম নিশ্চই এভাবে এডিটিং এর শিকার হতে হতো না। সুতরাং ব্লগ আপনাকে ইমপাওয়ার করে, ২০১১ সালের দিকে অনেকেই ব্লগে ইমপাওয়ারড ফিল করেছে। কিন্তু ব্লগে যে অপশনগুলো পাওয়া যেতো সেগুলো ফেসবুকে চলে আসায় অনেকেই এখন ফেসবুকে লিখছে (আমার তাই ধারণা)। এ কারণে ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটকে জডি ডিন বলেছেন ব্লগ কিলারস। আমরা কি শামীম ভাই-এর বিশ্লেষন আর জডি ডিন এর বিশ্লেষণ মিলিয়ে কি বলতে পারি এই ব্লগ কিলারস সাইটগুলো ব্লগারদের ব্লগ ব্রেকার্স বানিয়ে দিচ্ছে ???
এরকম কিছু প্রশ্নসহ আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর খোজার চেষ্টা করেছি আমি আমার বর্তমান গবেষণায়। বর্তমানে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধিনে মাস্টার্সের থিসিস হিসেবে যে গবেষনাটি করছি তার টাইটেল হলো Social media and the culture of online public opinion: A study on the bloggers of Bangla Blogosphere. এই গবেষণার একটি অংশ হলো ব্লগ ও ফেসবুকের নানা কার্যক্রম নিয়ে ব্লগারদের উপরে জরিপ করা। যেকোন বাংলা ব্লগসাইটে ব্লগিং করার অভিজ্ঞতা থাকলে আপনি নিজেও এখানে অংশ নিতে পারেন। এ জন্য এই লিঙ্কে ক্লিক করুন। গুগল ডকের একটি ফর্ম পাবেন। শুরুতেই যে ইন্সট্রাকশন দেয়া আছে ভালো করে পড়ুন। এছাড়া প্রতিটি প্রশ্নের সাথে গাইডলাইন দেয়া আছে। ফর্মটি ফিল আপ করতে ৬-৭ মিনিটের বেশী লাগবে না। সামহোয়ারইনে আমার আগের পোস্টে গবেষণা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত পাবেন। এই গবেষণা করতে গিয়ে Social media নিয়ে যা কিছু জানতে পেরেছি, সিরিজের সামনের পোস্টগুলোতে ব্লগারদের সাথে সেগুলো শেয়ার করবো।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:২২