এমনিতেই আমি নেই কাজ খই ভাঁজ টাইপ কাজে কর্মে অর্থাৎ যাকে বলা হয় ইজি কাজে বিজি থাকি সারা বছরই। আমার অকাজের শেষ নেই। কিন্তু এই অকাজগুলিই আমার কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ করে আমার নিজস্ব সত্ত্বায় আমার জীবনে বিশেষ অবদান রেখেছে। প্রতি বছর সামার ভ্যাকেশন আর উইন্টার ভ্যাকেশনে চলে আমার নিত্য নতুন গবেষনামূলক কার্য্যকলাপ বা আনন্দময় শিল্প চর্চা। এছাড়াও সারা বছর জুড়েই যখন তখন নানা রকম শিল্পচর্চা, কাব্যচর্চা, লেখ্যচর্চা এবং অংবং চর্চা তো আছেই।
আসলে আমি জীবনের কোনো মুহুর্তই অকারনে বিলিয়ে দিতে রাজী নই। কিছু না কিছু নিয়ে থাকতেই হবে আমাকে। তো গতবছর ছিলো আমার মাথায় নতুন বাড়ি ঘর সাজাবার ভূত আর সে কারণেই ওয়ালের জন্য বড় বড় পেইন্টিং কিনতে গিয়ে ২ লাখ ৩ লাখ দাম দেখে ভাবলাম দূর দূর মানুষের আঁকা ছবি কে কিনে তার থেকে নিজেই বানিয়ে ফেলি কিছু অং বং। কেউ মূল্য দিক আর না দিক আমার কাছে সেসব তো অমূল্য আর তাই একের পর এক এঁকে চলেছিলাম যতক্ষন পর্যন্ত আমার প্রতিটা রুমের দেওয়াল ভরে না ওঠে। আমার বাসায় কেউ এলে সেই সব অং বং পাগলামী আর্ট দেখে মনে মনে নিশ্চয়ই হাসে। তাতে কি যায় আসে? আমি নিজের আঁকা জলরং, তেল রং, মানডালা, সানডালা দিয়ে সারা বাড়ি ঘর ভরিয়ে আমি নিজেই খুশি।
এই যে আমার মান্ডালা..... আই মিন ডট আর্ট। এই মান্ডালা ভূত ঘাড়ে চাপার সময় অবশ্য দেওয়াল, ক্যানভাস, চার্ট পেপার, আর্ট পেপার, কাপ বাটি চামচ প্লেট কিছুই বাকী রাখিনি। পরে ভূত নেমে যেতে আবার কিছু ঘসে মেজে পুরান চেহারায় ফিরিয়েও এনেছি। আচ্ছা বলি তবে একটু এই বিশ্ববিখ্যাত মান্ডালা আর্টের কাহানী...
মান্ডালা চিত্রকলা।
প্রায় দু'হাজার বছরের প্রাচীন ব্যতিক্রমী এক চিত্রকলা মান্ডালা চিত্রকলা।"মান্ডালা" শব্দটির অর্থ সংস্কৃতে হল বৃত্ত ।হিন্দুধর্মে ও বৌদ্ধধর্মে এই ধরণের চিত্রকলা আধ্যাত্মিক ও বিভিন্ন ধর্মীয় আচারের প্রতীক রূপে পরিগনিত হয়। বৃত্তাকারে অঙ্কিত এই চিত্রকলার মাধ্যমে বোঝানো হয় যে জীবনের শেষ নেই। তা অন্তহীন। সংযুক্ত অবস্থায় চক্রাকারে যা বহমান।মান্ডালার কেন্দ্রবিন্দুকে আত্মারূপে প্রকাশ করা হয়।
অত্যন্ত জটিল আকারের নকশা যা একটি কেন্দ্রবিন্দু থেকে শুরু করে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ে। সূক্ষ্ম ও বিচিত্র নকশায় তৈরি এই চিত্রকলা জ্যামিতিক ও প্রাকৃতিক আকারের ব্যবহারে তৈরি হয়। চিত্রে ব্যবহৃত নকশার মাধ্যমে চিত্রকরের মানসিক প্রকৃতি প্রতিফলিত হয়। চিত্রের নকশা বহিজগতের সাথে ব্যক্তির অন্তর্জগতের যোগসূত্র স্থাপন করে। ধর্মীয় বিশ্বাস হল মান্ডালায় প্রবেশ করে ক্রমশ কেন্দ্রের অভিমুখে গমন করলে এক মহাজাগতিক আনন্দ ও সুখ লাভ হয়। বহির্বিশ্বের যাবতীয় দুর্ভোগ, দুঃখ, কষ্ট সব মান্ডালার বাইরে ত্যাগ করে আসা হয়।
মান্ডালা চিত্রকলায় ব্যবহৃত রঙের অর্থঃ
মান্ডালা চিত্রকলায় ব্যবহৃত প্রতিটি রঙ বিভিন্ন অর্থ বহন করে। যেমন-
লাল - শক্তি, স্ফূর্তি এবং আবেগ
গোলাপি - প্রেম, নারীত্ব ও অন্তর্দৃষ্টি
কমলা - সৃজনশীলতা, স্ব-সচেতনতা, অন্তর্দৃষ্টি এবং রূপান্তরৃ
হলুদ - প্রজ্ঞা, শিক্ষা , হাসি এবং সুখ
সবুজ - শারীরিক নিরাময়, মানসিক ক্ষমতা, প্রকৃতি এবং যত্নশীল
নীল - আবেগ নিরাময়, অভ্যন্তরীণ শান্তি এবং ধ্যান
বেগুনী - আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশের জন্য সমস্ত বস্তু আধ্যাত্মিক
কালো - গভীর চিন্তাভাবনা, রহস্য এবং স্বতন্ত্রতা।
আমি অবশ্য কোনো লাল নীল হলুদ সবুজের অর্থের ধার না ধেরেই মনের সুখে এঁকেছি। আর মানুষের মুখটা ডট ডট দিয়ে গয়নাগুলো এঁকেছি
মান্ডালা চিত্রকলা
এবার আমার এক্রেলিক পেইন্টিংকলা...... কোনো কিছু শিক্ষা ও দীক্ষার ধার না ধেরে আমি এই সব চিত্রকলা কয়েক রকম ব্রাশ ও এক্রেলিক পেইন্টের টিউব দিয়ে বিশাল সব ক্যানভাসে সাহস করে অসমসাহসী আমি একের পর এক এঁকে ফেলেছি আর আঁকবার পর নিজেই নিজের চিত্রকর্মে মুগ্ধ হয়ে দেওয়ালে টাঙ্গিয়েও দিয়েছি।
এসব আমার পুরোনো ঘড়ির কাজ .. ঘড়ির ভেতরের নাড়িভুড়ি ফেলে দিয়ে ছবি এঁকে তার উপর ছোট ছোট পাথর , পুতুল ও লাইট জুড়ে গড়েছি আমার রুপকথার স্বপ্নপূরী।শেষের ছবিটা অবশ্য ঘড়ি ওয়ার্ক না। এটা রাউন্ড শেইপ ক্যানভাসে ছবি একে ছোট ছোট নুড়ি পাথর পুতুল জুড়ে ব্রাশের হ্যান্ডেল দিয়ে টেনে টুনে কি এঁকেছি নিজেই জানিনা।
মাঝে মাঝে আবার আমার নানারকম শো পিস ও লাইটিং দিয়েও স্বপ্নপুরী সাজসজ্জা ছিলো।
যাইহোক এবারের শীতে বিয়ের পর বিয়ে তার উপর বিয়ে শাদী, বৌভাত হলুদ সন্ধ্যা, মেহেদী সন্ধ্যা কত কিছু। বিয়ে খেতে খেতে আমার সময় নষ্ট হচ্ছিলো শিল্প চর্চার আর তাই বিয়ে বাড়ির সাজুগুজুতেই শিল্পচর্চা অন ফেস শুরু করে দিলাম সময় না নষ্ট করে। নিজের মুখটাকেই ক্যানভাস বানিয়ে তাতে নানা রকম ইউটিউব শিক্ষনীয় আর্ট চর্চা করে দেখি নিজেকেই আর চিনতে পারিনা।
এই চর্চা করতে গিয়ে আমি কি কি বুদ্ধি করলাম সেটা বলি-
১। নিজে একজন দক্ষ বিউটিশিয়ানের কাছে গিয়ে বললাম সাজিয়ে দিতে। তারপর সে যাই লাগায় এক চোখ বন্ করে আড়চোখে কানি চোখে দেখে নেই।
২। মাঝে মাঝে জিগাসাও করি কি লাগাও এইটা? আমার এলার্জী আছে তো হেন আছে তো তেন আছে তো আসল উদ্দেশ্য জেনে নেওয়া কি দিচ্ছে না দিচ্ছে।
৩। ফিরে এসে রোজ রাতে ৩ টা করে বিউটীকেশন কোর্স দেখা। ইউটিউব, জিউটিউব যেখানে দেখেছি ছাই উড়াইয়া দেখি তাই।
৪। সকালে উঠে নিজের মুখ ক্যানভাস ধুয়ে মুছে সেই ক্যানভাসে রং লাগাতে বসা। হা হা হা
৫। ওহ সাথে কি কি কসমেটিকস লাগবে কোন ব্রান্ড হেন তেন যেমন ছবি আঁকতে রং তুলি লাগে তেমনই যব যোগাড় যন্ত্র যোগাড় করাও আরেকটা কাজ ছিলো।
লাল গিফ্টিং
নীল গিফ্টিং
বিয়েবাড়ি যেতে যেতে আর গিফ্ট র্যাপ করতে করতে সুন্দর করে র্যাপিং করার প্রজেক্টও হাতে নিয়ে নিলাম তারপর শুরু হলো নানা রকম গিফ্ট র্যাপিং শিল্প চর্চা।
তবে এবারের সবচেয়ে বড় আনন্দের শিল্প হয়েছে আমার একুয়াস্কেপিং বা জলের তলের বাগানবিলাস। একুরিয়াম বা টেরারিয়াম বা আপার বা আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড নিয়ে খেলাধুলা ও স্বপ্নের জগতে হারিয়ে যাওয়া সে আমার বহু পুরানো অভ্যাস। কিন্তু এবার ইউনিমার্টে এমন সব অদ্ভুত সুন্দর একুরিয়ামের সাজসজ্জা ও জলের তলের রুপকথা দেখে তো আমি অবাক। দাম জিগাসা করতেই বলে ১০/২০ এমনকি ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত নাকি দাম সে সবের হতে পারে। সাথে সাথেই মাথায় এলো আমার মাথা থাকতে তাদেরকে কেনো ২০/৪০ হাজার দেবো। সোজা বললাম ভাই একটু ছবি তুলে নিয়ে যাই? বাসায় গিয়ে উনাকে একটু দেখাতে হবে তো। তারা বললো ইয়েস ম্যাম মানে আমার মতন গুড কাস্টোমার রাগিয়ে মরবে নাকি??
আমিও হে হে করে সেই ছবি তুলে নিয়ে সোজা গাড়ি হাঁকিয়ে কালাচাদপুর গ্লাসের দোকান। গিয়ে বললাম এই যে এত বড় দৈর্ঘ্য এত বড় প্রস্তের ক্রিস্টাল গ্লাস কেটে জোড়া দিয়ে আমাকে কালকের মধ্যে দেন আর উপরে বর্ডার এমনে হবে ওমনে হবে। ব্যাস পরদিন সেই কাঁচ জোড়া দিয়ে তাতে সাজাতে বসলাম ওদের চাইতেও সুন্দর করে। জলের তলের সেই বাগান গুল্ম সাজিয়ে মাছেদের নতুন বাড়িঘর বানিয়ে দিয়ে যেই না ছবি দিয়েছি একটু ফেসবুকে। শিপুভাইয়া বলে গুড গুড এটা একুয়াস্কেপিং।
একুয়াস্কেপিং ! সেটা আবার কি ? তাড়াতাড়ি সার্চ দিয়ে দেখি আমি নিজের অজান্তেই একুয়াস্কেপিং শিল্পচর্চা করিয়া ফালাইয়াছি।
আহা আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! এখন আমি জেনেছি একুয়াস্কেপিং কি। এবার সবাইকে একটু জানাই।
একুয়াস্কেপিং কী?
বাগানে, ল্যান্ডস্কেপিং আপনার চারপাশের ডিজাইনের সমস্ত বিষয়। অ্যাকোয়াস্পিংয়ের মাধ্যমে, আপনি কেবল একই জিনিসটি করছেন তবে একটি জলজ সেটিংয়ে - সাধারণত অ্যাকোরিয়ামে। প্রাকৃতিক বক্ররেখা এবং opালু গাছগুলিতে ক্রমবর্ধমান গাছপালা সহ জলের নীচে আড়াআড়ি তৈরির জন্য এটি মজাদার উপায় হতে পারে। মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
জলপথ ব্যবহারের জন্য প্রচুর গাছপালা ব্যবহার করা যেতে পারে। কার্পেটিং গাছপালা এবং শ্যাওসগুলি সরাসরি স্তরটিতে যুক্ত করা হয় নীচে বরাবর সবুজ গালিচা তৈরি করতে। এর মধ্যে বামন শিশুর অশ্রু, বামন হেয়ারগ্রাস, মার্সিলিয়া, জাভা শ্যাওলা, লিভারওয়োর্ট এবং গ্লোসোস্টিগমা এল্যাটিনয়েডস। ভাসমান উদ্ভিদগুলি আশ্রয় এবং আংশিক ছায়া দেয়। ডাকউইডস, ফ্রগবিট, ভাসমান শ্যাওলা এবং বামন জলের লেটুস আদর্শ। অ্যানুবিয়াস, অ্যামাজন তরোয়াল, লুডভিগিয়া repens ভাল বিকল্প হয়।
বেশিরভাগ মাছের প্রজাতিগুলি এই জলের নীচে ল্যান্ডস্কেপগুলি দিয়ে ভালভাবে কাজ করে তবে কয়েকটি শীর্ষ পছন্দগুলির মধ্যে রয়েছে টেট্রাস, ডিস্ক, অ্যাঞ্জেলফিশ, অস্ট্রেলিয়ান রেইনবো এবং লাইভ বিয়ার include
Aquascaping
এবার বলি আমি না জেনে নিজের অজান্তেই একুয়াস্কেপিং করে ফেলেছি তো তাই জানতাম না আমার এই বিশাল বড় বড় মাছগুলি একুয়াস্কেপিং এর জন্য ঠিক প্রযোজ্য নহে। ছোট ছোট এক ঝাঁক লাল নীল হলুদ রঙ্গিন মাছ এর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে। এই জলজ উদ্যানে মাছ মুখ্য নহে গাছ মুখ্য। এটাও অবশ্য শিপুভাইয়ার কথা থেকেই প্রথম জেনেছি।
সবাই আমার একুয়াস্কেপিং এর ভিডিও দেখো
সে যাইহোক এসব শিল্পচর্চা নিয়েই এ বছর ছিলাম আমি। সাথে অবশ্য আরও কিছু অংবং চর্চাও ছিলো...... তবুও তবুও সকল চর্চাই আমার অতীব প্রিয়.......
এটাও আমার আরেকটা একুয়াস্কেপিং ভিডিও
ওহ একুয়াস্কেপিং এর জন্য এল ই ডি দিয়ে একটা সুন্দর আন্ডার ওয়াটার লাইটিং এর ব্যবস্তাও করে ফেলা হচ্ছে। শেষ হলেই ছবি আপডেট করে দেবো।
আমার নিজ হস্তে স্যুইমিং পুল সাজুগুজু (অনেকগুলো হেল্পিং হ্যান্ডস নিয়ে অবশ্য)
হিহি লাল লাল
কমলা কমলা
সবুজ সবুজ
এসব আমার গার্ডেন আর্ট
আসে বসন্ত ফুলবনে...
সাজে বনভূমি সুন্দরী
চরণে পায়েলা রুমুঝুমু
মধুপ উঠিছে গুঞ্জরী
ইহা একখানা বর্ষা বিলাস
যদি মন কাঁদে চলে এসো এক বরষায়....
সে যাইহোক কে কে ক্যানভাস আর্ট, পুরান জিনিস নতুন করিয়া বানানো আর্ট বা একুয়াস্কেপিং করিতে চাহো বলো বলো বলো? সবাইকে ফ্রি ফ্রি শিখায় দেবো।
আর কোন কোন আপুরা আর্ট অন ফেস ক্যানভাস করতে চাও তারাও বলো বলো বলো। মনিরা আপু অবশ্য তার ফেসখানা ক্যানভাস হিসাবে অলরেডি দিয়ে দিয়েছেন।
তাই এই পোস্ট ইজ ফর মনিরা আপু আর অবশ্য অবশ্য ফর শিপু ভাইয়া।
যাইহোক আমার এই সকল ফেস পেইন্টিং, ডট পেইন্টিং, ক্যানভাস পেইন্টিং আর একুয়াস্কেপিং গার্ডেন স্কেপিং, পুল স্কেপিং বর্ষা বিলাসিং সবগুলির মধ্যে বেশি বেশি কোনটা ভালো হয়েছে সেটাও বলে দিয়ে আমাকে উৎসাহিত করে একে নাচুনী বুড়ি তার উপরে ঢাকের বাড়ি দিয়ে যাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। কিন্তু খারাপ বলেও লাভ নেই কারণ মনের আনন্দে করা অং বং কাজ কেউ খারাপ বললে তাতেও আমার আনন্দই লাগে। কারণ এই সব শিল্পচর্চার সময় সেসব ভুতপ্রেত যাই দেখাক তাই দেখে হয় আমি আনন্দে ভাসি বা ভুত দেখে হাসি। কখনও কাঁদি না।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ৯:০৯